আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশিষ্ট বিপ্লবী ছাত্রনেতা, সংগঠক, সাংবাদিক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী আ,ন,ম, গোলাম মোস্তফার মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমি সত্য জানতে চাই
বিপ্লবী ছাত্রনেতা, সংগঠক, সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আ,ন,ম, বজলুর রশীদ। পর্যায়ক্রমে তিনি দৈনিক সংবাদ, দৈনিক আজাদ এবং দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের সাক্ষাৎকারের সঙ্কলন গ্রন্থ অন্তরঙ্গ আলোকে সম্পাদনা করে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন তিনি। এই অপরাধে ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী আল-বদর বাহিনী তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করে।

আজ এই বুদ্ধিজীবীর ৪২তম শাহাদৎবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকীতে আ,ন,ম, গোলাম মোস্তফার জন্য আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। গোলাম মোস্তফা বাংলা ১৩৪৮ সালের ২৪ অগ্রহায়ণ দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জহিরউদ্দিন আহমেদ। জহির উদ্দিন ছিলেন আইনজীবী সহকারী।

মা গৃহিনী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মোস্তফাই ছিলেন সবার বড়। গোলাম মোস্তফার শিক্ষাজীবন শুরু হয় দিনাজপুরের মেলাপাঙ্গা মাদ্রাসায়। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দিনাজপুর জেলা স্কুলে। ১৯৫৮ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।

কিন্তু আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তত্‍কালীন সময়ে দিনাজপুর শহরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে জেলার তত্‍কালীন অধিকর্তা এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। ১৯৬০ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ১৯৬৩-তে একই কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন গোলাম মোস্তফা। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পাকিস্তান বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি অন্যতম ছাত্রনেতার ভূমিকা পালন করেন। তত্‍কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬২-তে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সারা দেশে ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে তোলে, দিনাজপুরে সে আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে গোলাম মোস্তফার ছিল ব্যাপক ভূমিকা।

এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। একটানা প্রায় আট মাস বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় ছাত্র আন্দোলনে দ্বিগুণ মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেন। ফলে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার গ্রেফতার করে। পাক্স্তিানী গারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গোলাম মোস্তফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন।

প্রথমে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর বার্তা বিভাগে। কিছুদিন সংবাদে কাজ করার পর চলে যান ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায়। সেখানে তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের ভার পান। পাশাপাশি মাসিক 'মোহাম্মদী'র সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করতেন৷ ১৯৬৯-এর আগস্ট মাসে ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসাবে যোগদান করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন।

দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময়ই গোলাম মোস্তফা সাহিত্যচর্চার ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সাহিত্যচর্চার জন্য দিনাজপুর শহরে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। এ সময় তিনি স্থানীয় সাহিত্য আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দেন। ‘অন্তরঙ্গ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। গোলাম মোস্তফা রচিত দু'টি পুস্তকের মধ্যে আছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাত্‍কার সম্বলিত ‘অন্তরঙ্গ আলোকে’ এবং অনুবাদ গ্রন্থ ‘শ্বেত কুণ্ডলা’।

১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলায় গোলাম মোস্তফা সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। তখন তিনি ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তিনি চাইতেন না, পূর্বদেশ পত্রিকায় পাকিস্তানিদের কোনো খবরাখবর যাক। শুধু পত্রিকায় লিখে নয়, ঢাকায় থেকেই তিনি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করছিলেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ঢাকায় আসত তাদের অনেকের সঙ্গেই মোস্তফা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, অর্থ, ঔষধসহ নানা জিনিস তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তাদের হাতে তুলে দিতেন। মোস্তফার ভাবনা ছিল সবাই যদি দেশত্যাগ করে তাহলে দেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে কে? যারা যুদ্ধ করছে তাদের কাজটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানাভাবে সহযোগিতা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এটা যুদ্ধের অংশ। মোস্তফার এই আচরণ পাকিস্তান-ভক্তরা মেনে নিতে পারত না। পাকিস্তান-ভক্ত এই ব্যক্তিরা পূর্বদেশে কর্মরত সকল স্বাধীনতাপন্থী সাংবাদিকদের খররাখবর পাক হানাদার বাহিনীর কাছে পৌছে দিতো। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদেরকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।

কারণ, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। ওরা আরো মনে করেছিল যে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে ওরা এ মাটিতে বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন করতে দেশের এসব বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা ও কর্মস্থল থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় দৈনিক পূর্বদেশ প্রত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী আল-বদর বাহিনী কর্তৃক নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হন আ,ন,ম, গোলাম মোস্তফা। যুদ্ধাপরাধী ও পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছেলে।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তাঁর বাবাসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে মুঈনুদ্দীন জড়িত ছিলেন। জবানবন্দিতে অনির্বাণ মোস্তফা বলেন, একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল নয় মাস। তিনি বড় হয়ে মা, চাচা ও বাবার সহকর্মীদের কাছ থেকে দুজন মানুষ সম্পর্কে জেনেছেন। তাঁদের একজন তাঁর বাবা ও অপরজন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। একাত্তরে তাঁর বাবা পূর্বদেশ পত্রিকায় সহসম্পাদক ছিলেন।

বাবার সহকর্মী মুঈনুদ্দীন ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) সক্রিয় নেতা ও আলবদরের অপারেশন ইনচার্জ। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের মানুষ যখন একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছিলেন, কেউ উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারতেন না, তখন বাবা তাঁর কর্মস্থলে পাকিস্তানি সেনা ও পাকিস্তানি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতেন। একপর্যায়ে সহকর্মী মুঈনুদ্দীনের সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে বাগিবতণ্ডা হয়। এর ফলাফল ভালো হবে না বলে মুঈনুদ্দীন হুমকি দেন। তিনি বড় হয়ে একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারির পূর্বদেশ পত্রিকায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ছবিসহ প্রতিবেদন দেখেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী অনির্বাণ মোস্তফা বলেন, তিনি জেনেছেন, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর রাতে তাঁর ঘুম হয়নি বলে পরদিন (১১ ডিসেম্বর) ভোরে তাঁকে নিয়ে তাঁর বাবা বারান্দায় হাঁটছিলেন। এ সময় তাঁর বড় মামা প্রকৌশলী শামসুজ্জোহাকে নিয়ে কয়েকজন একটি জিপে করে তাঁদের গোপীবাগের বাসায় এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর চাচা গোলাম রহমান বাবাকে খুঁজতে পূর্বদেশ পত্রিকায় গিয়ে বাবার সহকর্মী প্রধান প্রতিবেদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও আতিকুর রহমানকে বিষয়টি জানান। তাঁরা তখন মুঈনুদ্দীনকে ডেকে পাঠান ও তাঁর বাবাকে খুঁজতে বলেন। তাঁর চাচাকে সঙ্গে নিয়ে মুঈনুদ্দীন বিভিন্ন স্থানে যান।

এর মধ্যে মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে গেলে সেখানকার প্রহরীরা মুঈনুদ্দীনকে দেখে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। সে সময় তাঁর বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীনের পরও বিভিন্ন স্থানে খুঁজে তাঁকে পাওয়া যায়নি। আজ এই বুদ্ধিজীবীর ৪২তম শাহাদৎবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকীতে আ,ন,ম, গোলাম মোস্তফার জন্য আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.