বছর খানেক ধরেই দেশে-বিদেশে ঘুরেফিরে একটা আলোচনা কানে এসেছে। আলোচনার বিষয়বস্তু বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের ঝুঁকি। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এ আলোচনা আরও তীব্র হয়েছে। এ আলোচনায় এক পক্ষের যুক্তি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য গ্রহণযোগ্য ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চেয়েও জরুরি হচ্ছে ইসলামি জঙ্গিবাদ নির্মূল করা। আর তাদের ভাষায়, ইসলামি জঙ্গিবাদের মূল পৃষ্ঠপোষক হলেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি।
তাদের বিবেচনায় ক্ষমতাসীন জোট সরকারের গত পাঁচ বছরের ব্যর্থতা কিংবা কথিত ‘কুশাসন‘ বা ‘অপশাসন’-এর অভিযোগ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে যতটা না প্রভাবিত করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে নব-আবির্ভূত আধা রাজনৈতিক গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম।
কূটনৈতিক অঙ্গনেও একটি অংশের মধ্যে এ ধারণা চালু আছে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে জঙ্গিবাদের পুনরুত্থানের ঝুঁকি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। সরকারের কূটনৈতিক কৌশলের কথিত কিছু সাফল্যের মধ্যে এটা অন্যতম।
সম্ভবত সে কারণেই লন্ডন ও ওয়াশিংটনের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর শহরে নানা আসরে এ বিষয়ে বাংলাদেশিদের অগুনতি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে সংকট ও প্রাণঘাতী সহিংসতা চলছে, এর শেষ কোথায়? দুই নেত্রীর মধ্যে কোনোভাবেই কি আপস সম্ভব নয়? ইসলামি উগ্রপন্থার ঝুঁকি কতটা? ঘোষিত তফসিলে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কি সম্ভব? সেই নির্বাচনে কি ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার অংশ নিতে পারেন? সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হতে পারে? আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর করণীয় কী? মিসরে ইসলামপন্থীদের বিপরীতে প্রগতিবাদীদের রাজনৈতিক লড়াইয়ে যেমনটি দেখা গেছে, বাংলাদেশে উদারপন্থীরা সে রকমটি কেন ভাববে না? গেল সপ্তাহে লন্ডনে বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধি, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের এক সেমিনারে এসব প্রশ্নই উত্থাপিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিষয়ে এসব আগ্রহী ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রতিনিধি, ভারত, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও অস্ট্রেলীয় দূতাবাসের প্রতিনিধি। আরও ছিলেন জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা ও কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির উপদেষ্টা। বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে তাঁদের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে ডাক পড়েছিল বাংলাদেশে বিবিসির সাবেক সংবাদদাতাদের একজন ফ্রান্সিস হ্যারিসন ও আমার। সেমিনারের আয়োজক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)। গত সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব কমনওয়েলথ স্টাডিজের (আইসিএস) এক অনুষ্ঠানেও আমার অভিজ্ঞতা একই রকম।
বৈশ্বিক রাজনীতি, কূটনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ে আইআইএসএসের অগ্রণী ভূমিকা সুবিদিত। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আলামত দৃশ্যমান হলেই আইআইএসএস সেই সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে তার প্রবণতা ও গতিপথ সম্পর্কে আগাম দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।
ভারতীয় দূতাবাসের উপদেষ্টা গুরুচরণ সিং বেদি জানতে চেয়েছিলেন, এ সংকট থেকে উত্তরণে বিএনপির তরফ থেকে কোনো ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। দ্য রিস্ক অ্যাডভাইজরি গ্রুপের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ভাবিন ভিয়াস তাঁর সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, সে সময়ে অনেকেই তাঁকে বলেছেন, বিরোধী দল সহিংসতা এমনভাবে ছড়াতে চায়, যাতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ বক্তব্য ঠিক কি না, এমন প্রশ্ন ছিল তাঁর।
বহুজাতিক একটি জ্বালানি কোম্পানির কান্ট্রি রিস্ক অ্যাডভাইজার আইনুর ক্যাডিলবেকের প্রশ্ন ছিল, প্রধান দুই দলের নেতাদের উত্তরাধিকারী কারা এবং তাঁরা ভবিষ্যতের জন্য কোনো আশার আলো দেখাতে পারেন কি না। আইসিএসের সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম ক্রলির প্রশ্ন ছিল, রাজনৈতিক মেরুকরণে ইসলামপন্থীরা সবাই কি একমুখী? রাজনীতিতে সুফিবাদের অনুসারী ইসলামপন্থীদের কোনো ভূমিকা আছে কি না।
আইআইএসএসের সিনিয়র ফেলো রাহুল রায় চৌধুরীর প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি ছিল, নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতির সম্ভাবনা কতটুকু? আইআইএসএসের আরেকজন গবেষক অ্যান্টনিও লেভেসকুর প্রশ্ন ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কী ধরনের ভূমিকা নিতে পারে?
এসব প্রশ্নের কোনোটিরই কোনো স্বতঃসিদ্ধ উত্তর নেই। এমনকি, উভয় নেত্রীর সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী কারা, সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়াও কঠিন। একজন নেত্রীর ক্ষেত্রে তা কিছুটা স্পষ্ট হলেও অন্য জনের ক্ষেত্রে এখনো দোদুল্যমানতার আলামত বিদ্যমান।
তবে এসব আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে একটিই উদ্বেগ, বিশ্বের তৃতীয় মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রটিতে জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কা। সুতরাং, ঢাকায় ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের আলোচনায় জঙ্গিবাদের ঝুঁকির কথা যে আলোচিত হবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে বিষয়টি কারও কারও কাছে দৃষ্টিকটু মনে হওয়াটাও স্বাভাবিক। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সেই বাস্তবতা অস্বীকারের কোনো উপায় কি আছে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার ও জোটের নেতারা জঙ্গিবাদের ঝুঁকির বিষয়কে দেশের বাইরে বৈশ্বিক পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সফল হলেও সেই সাফল্যই কি এখন তাঁর জন্য কিছুটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে? বিএনপির সমর্থকদের প্রচারণার জোরেই হোক অথবা আওয়ামী পরিবারের অতি প্রচারের কারণেই হোক, অনেকের মনে এখন সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে আওয়ামী লীগ আসলে কোনোভাবেই বিএনপিকে নির্বাচনে চায় না। সে কারণেই বাধ্য না হলে তাদের কোনো ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও বিদেশি বন্ধুদের মধ্যেও এ ধারণা ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। সম্ভবত সে কারণেই এখন তাঁদের কণ্ঠে একই আওয়াজ যে তাঁরা চান, সবার অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও অবাধ একটি নির্বাচন। কথিত জঙ্গি দমনের নীতি জঙ্গিবাদকে যে আরও উসকে দেবে না, সে প্রশ্নেও তাঁরা আশ্বস্ত নন।
বিষয়টিতে একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত, যারা প্রকাশ্যেই বলেছে সর্বোচ্চসংখ্যক দলের অংশগ্রহণের কথা। ভারতের এ অবস্থান যতটা না আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব, তার চেয়ে বেশি তাদের নিজেদের হিসাব বলেই মনে হয়।
ভারত সম্ভবত তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কারণেই বিএনপির নেত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারেনি। বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করা আওয়ামী লীগের জন্য কতটা দুরূহ হবে, তা নিয়েও ভারতীয় কূটনীতিকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। আর সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কৌশল ইতিমধ্যেই একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তাদের আশা ছিল, খালেদা জিয়া নির্বাচনে না গেলেও বিএনপির কোনো না কোনো উপদল বা নেতাকে নির্বাচনে আনা সম্ভব হবে। তাদের সেই চেষ্টা ও আশা বিফলে গেছে।
খালেদা জিয়া অন্তত নির্বাচন বর্জনের ক্ষেত্রে ছিয়াশির মতোই তাঁর দলের ঐক্যের প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন।
এর সঙ্গে বাড়তি প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে জেনারেল এরশাদের ভূমিকায়। তাঁর দল ভাঙলেও তিনি নিজে যদি নির্বাচন থেকে দূরে থাকেন, তাহলে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আর নির্বাচন থাকে কি না, সেটাই তো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। কৌতুককর নানা মন্তব্যের জন্য খ্যাতিমান অর্থমন্ত্রীর গত সোমবারের নীরস এক মন্তব্যে সেই বাস্তবতার স্বীকৃতি মেলে। তাতে তাঁর সতীর্থদের বা দলীয় প্রধানের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তনের আশা নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও নির্বাচন বিষয়ে বিদেশিদের নিবিড় তৎপরতায় অনেকেই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু ৫ ডিসেম্বরের কথাই ধরুন। সেদিন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মধ্য ও ডানপন্থী ২৭টি দলের জোট ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) গ্রুপের আমন্ত্রণে ব্রাসেলসে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা। কিন্তু সেই পার্লামেন্টারি কমিটি কক্ষে এক দলের নেতারা প্রতিপক্ষের কাছে যেভাবে অপদস্থ হলেন, সেটা ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা কেন নীরবে মেনে নেবেন? সুতরাং, তাঁরা যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াই বাংলাদেশের মাটিতেই নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে তাঁদের কূটনীতিকদের নির্দেশনা দেন, তাহলে সেটা কি খুবই অযৌক্তিক হবে?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।