এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের ফাঁসিকে উচ্চ আদালত সম্প্রতি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে স্থান পেলেও তবে সব ছাপিয়ে গেছে কাদের মোল্লার ফাঁসির খবর। তার ফাঁসি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রধান খবর হিসেবে জায়গা পায়।
কর্নেল তাহের
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে ফাঁসি দেয়া হয়। ওই বিচার অবৈধ ঘোষণা করে তাকে হাই কোর্ট দেশপ্রেমিক ঘোষণা করে।
মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে গর্ব করতে পছন্দ করা কর্নেল তাহেরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর, আসামের বদরপুরে। নেত্রকোনার পূর্বধলা থানার কাজলা গ্রামে তার পৈত্রিক নিবাস।
কৈশোরে চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ স্কুলে পড়ার সময়ই ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন তাহের। ১৯৫৯ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে নেন স্নাতক ডিগ্রি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন তাহের।
এরপর ১৯৬০ সালে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর ও শিয়ালকোট রণাঙ্গনে লড়াই করে আহত হলে বীরত্বের জন্য খেতাব পান তাহের। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সেনানিবাসে থাকাকালে স্বাধীনতাকামী একদল বাঙালি যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২০ জুলাই মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন পাটোয়ারিকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ থেকে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান তাহের, যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান তিনি।
১৪ নভেম্বর নিজের জন্মদিনে ঢাকার প্রবেশদ্বার কামালপুরের শত্রু ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানোর সময় আহত হন তাহের। তার বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিলে প্রথম অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নিযুক্ত হন তাহের। সেনাবাহিনী ছাড়ার পর ১৯৭২ সালের অক্টোবরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর টালমাটাল পরিস্থিতির তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি হলেও ৭ নভেম্বর তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্ত হন তিনি।
একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনে এই আমৃত্যু সংগ্রামী ওই অভ্যুত্থানে সমর্থন দেন জিয়াকে।
ওই ঘটনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়া, হন দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক। ওই সরকারে যোগ দিতে তাহেরকেও যোগ দিতে বলেন।
কর্নেল তাহেরের ওয়েবসাইটে বলা হয়, কিন্তু তাঁর বিপ্লব হিতে বিপরীত হয়ে যায়। পাল্টা অভ্যুত্থানের পর মেজর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর ‘চিফ অফ স্টাফ’ নিযুক্ত হয়ে রাষ্ট্রকে পুনরায় সামরিক জান্তার কবলে পতিত করেন।
“জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে সামরিক সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তাহের জিয়াউর রহমানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ”
“সামরিক সরকার তার চরিত্র অনুযায়ী কর্নেল তাহেরসহ জাসদের ৩৩ জন নেতাকে বন্দী করে। তারপর তাঁর সমগ্র পরিবার রাষ্ট্রীয় ক্রোধের মধ্যে পড়ে। ১৯৭৬ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় কারাগারে তারকাঁটা দিয়ে স্থান নির্দিষ্ট করে কর্নেল তাহেরসহ ৩৩ জন বন্দীর বিচার শুরু হয়৷”
“১৭ জুলাই বিশেষ সামরিক আদালত জিয়ার ইচ্ছায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির আদেশ দেয়।
২১ জুলাই ভোরবেলা কর্নেল তাহের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে যান। সমাপ্তি ঘটে এক বিপ্লবী জীবনের। ”
এর কিছুদিন পর তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তাকে দাফন করা হয় নেত্রকোনার কাজলায় পারিবারিক গোরস্তানে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে কর্নেল তাহেরের আরো ছয় ভাই ও দুই বোন সরাসরি অংশ নেন। এদের মধ্যে চারজন বীরত্বসূচক খেতাব পান। চার সহোদরের খেতাব পাওয়ার দৃষ্টান্ত মুক্তিযুদ্ধে আর নেই।
২০১১ সালের ২২ মার্চ হাই কোর্ট ওই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এতে তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি কথিত সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করারও নির্দেশ দেয়া হয়।
রায়ে বলা হয়, তখনকার সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার তাহেরকে বিচারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল।
জিয়া জীবিত না থাকায় তার বিচার সম্ভব নয়। তারপরও এ হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা উচিত বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনি
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কার্যকর হয় বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা সদস্য ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হানা দিয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর সাতজনের মধ্যে আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মোসলেমউদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও আব্দুল মাজেদ বিদেশে পালিয়ে আছেন। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। দণ্ডিত অপরজন আব্দুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কোনো মামলা করতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও দেশে ফিরতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা।
প্রথমে বাধা, এরপর হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য ’৭৫ এর ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন খোন্দকার মোশতাক সরকার ইন্ডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে।
দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল করলে ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়।
এরশাদ শিকদার
২০০৪ সালের ১০ মে ফাঁসি দেয়া হয় এরশাদ শিকদারকে। যুবলীগ নেতা খালেদ হোসেনকে হত্যার অভিযোগে খুলনার একটি আদালত ২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরপর তিনি উচ্চ আদালতে আসলেও দণ্ড কমেনি।
খারিজ হয় প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থণার আবেদনও। ১৯৯৯ সালের ১৬ মে শিকদার নিজে খালেদকে হত্যা করেন।
শায়খ রহমান ও বাংলা ভাই
২০০৭ সালের মার্চ ৩০ শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয়।
শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে কুমিল্লা কারাগারে। সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও আবদুল আওয়ালকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ কারাগারে।
খালেদ সাইফুল্লাহকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে পাবনা কারাগারে। কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে আতাউর রহমান সানি ও ইফতেখার হাসান মামুনকে ।
জেএমবি জঙ্গিরা ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে। এই মামলায় তাদের দণ্ড দেয়া হয়।
২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলা ভাইকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা গ্রেপ্তার করে।
এর চারদিন আগে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খ রহমানকে।
মনির হোসেন
১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল স্ত্রী শারমির রীমাকে হত্যা করেন মনির হোসেন। ঘটনার পরদিন তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৯০ সালের ২১ মে ঢাকার জেলা ও দায়রা আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তিনি এই মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হোসনে আরা বেগম খুকু পরে হাই কোর্ট থেকে খালাস পেলেও মনিরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমোদন দেয় উচ্চ আদালত। ১৯৯৩ সালের ২০ জুন আপিল বিভাগ ওই দণ্ড বহাল রাখে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।