ডিসেম্বরের এই সময়টায় শ্রীমঙ্গলের চা-বাগানগুলোতে বড্ড শীতের প্রকোপ। শ্রীমঙ্গল থেকে শমসেরনগর যাবার পথে রাস্তার দু-ধারে সারি সারি চা-বাগান। শ্রীমঙ্গল থেকে শমসেরনগরের পথ ধরে কয়েক মাইল সামনে এগোলেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বড় রাস্তা থেকে ২০০ গজ ভেতরে ঢুকলেই আতিক সাহেবের বাংলো। আতিক সাহেব ফিনলের ডেপুটি ম্যানেজার, পরিবার ঢাকায় থাকে, তিনি বাগানের দেয়া বাংলোতেই থাকেন।
পরিবারের সাথে দেখা করতে সপ্তাহান্তে ঢাকায় যাওয়া-আসা করেন, শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফ্রিকুয়েন্ট বাস সার্ভিস আছে এখন, কোন অসুবিধা হয়না।
সন্ধ্যার দিকে দরজায় নক শুনে আতিক সাহেব বের হলেন। বেরিয়ে দেখলেন খাটো মতন একজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। চিকন গোঁফ, মাথায় অল্প চুল, ক্লান্ত চোখ-লোকটিকে অন্য যে কোন মানুষ থেকে সহজেই আলাদা করা যাবে। গায়ে যে ড্রেস চাপানো তাতে মনে হচ্ছে শারীরিক আকারে বড় অন্য কারো ড্রেস পড়ে আছে সে।
আতিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
- কী চাই?
-একটু রাইড দেয়া যাবে, আমার আত্মীয় কাছেই থাকে, কয়েক মাইল দূরে।
খাটো লোকটির কথা জড়িয়ে আসছিলো, অতিরিক্ত পান করেছে মনে হচ্ছে।
-এখনতো আমি পারবোনা, তবে আপনি সামনের রাস্তা ধরে ডানে একটু হাঁটলেই একটা ছোট বাজারের মতো পাবেন। সেখানে রিক্সা, অটোরিক্সা থাকে। সেগুলো একটা নিয়ে আপনি চলে যেতে পারবেন।
-আচ্ছা থাক, আপনি বরং আমাকে এক গ্লাস পানি দেন এবং এই নাম্বারে একটা কল দিয়ে আমার কথা বলেন। তাহলে আমাকে এসে নিয়ে যাবে।
এই শীতের সন্ধ্যায় রাইড দেয়ার চেয়ে এটাকেই সুবিধাজনক অপশন মনে হলো আতিক সাহেবের কাছে। তিনি ভেতর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে লোকটিকে দিলেন,
-বসুন আপনি, পানি খান। আর হ্যা, ফোন নাম্বারটা দেনতো।
লোকটি একটি কাগজে লেখা ফোন নাম্বার বের করে আতিক সাহেবের হাতে দিলো, আতিক সাহেব নাম্বারটি ডায়াল করে বিস্তারিত বললেন। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি এই খাটো লোকটিকে চিনতে পারলো মনে হলো। আতিক সাহেবের মনে হলো, ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি যেন দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচলো, ঠিক যেমন বাবা-মা হারিয়ে যাওয়া সন্তানের সন্ধান পেয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে।
ফোনে কথা বলতে বলতে সামনে বসে থাকা লোকটির পানি পান করা শেষ, লোকটি মুচকি হাসলো এবং ধন্যবাদ জানালো। অল্প সময়ের ব্যবধানেই একটি গাড়ি এসে থামলো, দুজন লম্বা মতন আলখেল্লায় ঢাকা মানুষ গাড়ি থেকে নামলো এবং খাটো লোকটিকে নিয়ে চলে গেলো।
যাবার আগে তারাও আতিক সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকার পথে বারান্দার মেঝেতে আতিক সাহেব কি যেনো একটা আঁকা আছে দেখলেন, এটা আগে এখানে ছিলনা। মাথা নুয়ে কাছে থেকে দেখতে যেয়ে দেখলেন 'হব' সাইন। সাহায্য পাওয়া যায় এমন স্থান এবং ফ্যাসিলিটিজ চিহ্নিত করতে ইদানিং 'হব' সাইন ইউজ করা হচ্ছে। এর মানে, পানি দিয়ে আতিক সাহেব যখন ফোনে কথা বলছিলেন তখন খাটো লোকটি এটা এঁকেছে।
ব্যাপারটা ক্ষণিকের জন্য রহস্যজনক মনে হলেও মুহুর্তের মাঝে সেটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন আতিক সাহেব।
পরদিন সকাল বেলা অফিসে যেতেই সহকর্মী সাধন মজুমদার আতিক সাহেবের রুমে ঢুকলেন, ঢুকেই দরজা চাপিয়ে দিলেন। আতিক সাহেবের কাছাকাছি ঘেঁষে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ''গত সন্ধ্যায় একটা ঘটনা ঘটেছে,....................................''সাধন সাহেবের কথা শেষ হবার পর আতিক সাহেবের চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হলো। একইরকম ভাবে রাইড চাওয়া, পানি খেতে চাওয়া, ফোন করে আসতে বলা এমন দুটি ঘটনা একই সময়ে কীভাবে সম্ভব?
চিন্তা করতে করতে রুমে থাকা টিভিটা রিমোট দিয়ে অন করলেন আতিক সাহেব। চ্যানেল আই সংবাদ চলছে, শিরোনামে একটা সংবাদ শুনে চমকে উঠলেন-
''গতরাতে সিলেট অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যে ইউএফও নিয়ে গুজব শুনা যাচ্ছিল, তা স্পারসোর ১ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
ওই সময় সিলেট অঞ্চলের রেডিও ওয়েবলেন্থেও গন্ডগোল তৈরী হয়েছে বলেও সংবাদ পাওয়া গেছে। ''
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আতিক সাহেবের অফিস রুমে ঢুকলো এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ইশতিয়াক, ঢুকেই একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লো সে, বলতে লাগলো,
''গত সন্ধ্যায় হরিণছড়া ২ চা-বাগানের গলফ কোর্সে রকেট নেমেছিল, পুরো গলফ কোর্স দেখে মনে হচ্ছে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ''
আতিক সাহেব এবং সাধন সাহেব একে অন্যের দিকে তাকালেন, মৃদু হাসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাসির চেয়ে দুশ্চিন্তাই বেশি দেখা গেল তাদের চোখে-মুখে।
শব্দ পথিক
ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩
----------------------------------------------------
পূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ:
১. গল্প ছোট, কিন্তু দু:খ নয়
২. সিলেক্টিভ মানবতা এবং অন্যান্য
৩. ঈশ্বর দৌড়
৪. দিব্যদৃষ্টি
৫. স্যাটেলাইট দুর্ঘটনা
৬. আগুনে সমাপ্তি
৭. আমার বন্ধু রাশেদ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।