আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৈয়দ শামসুল হক এবং ছোটদের কবিতা

ছোটদের জন্য দু-একটি গল্প-উপন্যাস লেখেননি এমন কথাসাহিত্যিক খুঁজলে হয়তো আমরা পাব, কিন্তু ছড়া-কবিতা লেখেননি এমন কবি বোধহয় পাওয়া যাবে না। জসীম উদ্দীন, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখ কবি আমাদের ছড়া-কবিতা শাখায় রীতিমতো বিশেষ বিশেষ মাত্রা সংযোজন করে গেছেন। যাঁরা প্রধানত বড়দের জন্য লেখালেখি করেন, তাঁরা যখন ছোটদের জন্য লেখেন, তখন তাঁদের রচনায় যুক্ত হয় একেবারে নতুন ধরনের স্বাদ-শৈলী। সাহিত্যের বড় পরিসরে কাজ করার বিপুল অভিজ্ঞতা, গভীরতর অনুভব, সূক্ষাতিসূক্ষ উপলব্ধি, বিচিত্র উপমা-চিত্রকল্প ও শ্রেয়তর শব্দ-কুশলতায় ব্যঞ্জনার প্রকাশ তাঁরা সহজেই তাঁদের রচনায় ঘটাতে পারেন। এ কথাগুলো আবার নতুন করে মনে হল সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ছোটদের কবিতা পড়তে গিয়ে।


আমাদের দেশের একমাত্র সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা, নাটক, গল্প-উপন্যাসসহ সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর প্রতিভার দীপ্তি প্রবাদতুল্য। এক সময় বড়দের সাহিত্য রচনার পাশাপাশি ছোটদের রচনায়ও তিনি মোটামুটি সক্রিয় ছিলেন। রোকনুজ্জামান খান সম্পাদিত মাসিক ‘কচি ও কাঁচা’ এবং এখলাসউদ্দিন আহ্মদ সম্পাদিত মাসিক ‘টাপুর টুপুর’ পত্রিকার প্রায় নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। এখন শিশুসাহিত্য অঙ্গনে তাঁর বিচরণ খুব একটা চোখে পড়ে না।

অবশ্য এ অভিযোগ তিনি মানতে নারাজ। তাঁর ‘শিশু-কিশোর কবিতাসমগ্র’ গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন--
 
বয়স তো হলো সত্তর কাছাকাছি-
ঘণ্টা পড়েছে, পাইনি এখনও ছুটি,
বালকের দলে বহাল এখনও আছি।
এখনও পদ্য সবুজ কালিতে লিখি,
আকাশের নীল রঙে করি কাটাকুটি,
তাই দেখে আজও তারা হাসে ঝিকিমিকি। ...
 




সৈয়দ শামসুল হকের সবকটি ছোটদের কবিতা বিষয়-বৈচিত্র্য, কল্পনার বৈভব, হাস্যরসের দ্যোতনা, ছন্দনৈপুণ্য স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বাংলার শিশু-কিশোরদের আবেগ-স্বপ্ন-কল্পনা-বেদনা-হতাশা-কৌতূহল থেকে শুরু করে তাদের চারপাশের চেনা জীবন-জগৎ, জনমানুষ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বীরগাথা, নিসর্গ-প্রকৃতি, উৎসব-পার্বণ ইত্যাদি লেখাগুলোর বিষয়-অনুষঙ্গ।

বিচিত্র বিষয়বস্তু উপস্থাপনার চমৎকারিত্বে পেয়েছে অপূর্ব ব্যঞ্জনা। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গীতিময় কবিতা যেমন আছে, তেমনি আছে চমকপ্রদ গল্পধর্মী কবিতা, কোনোটি আবার নিটোল হাস্যরস প্রধান। তবে সব লেখার লক্ষ একটাই- শুভ, কল্যাণবোধ জাগিয়ে তোলা ও নির্মল আনন্দ দান করা।
রচনার উদ্দেশ্য শিশু-কিশোর হতে পারে, কিন্তু এগুলোর সাহিত্যমান এমন উঁচুস্তরের যে, সব বয়সের কবিতামোদী পাঠকের রসনাই এতে তৃপ্ত হয়। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক :
একটা পুষি বেড়াল ছিল হিংসুটে বদমাশ।


 
এমনি সেটা হতচ্ছাড়া
দুই ঠ্যাংয়ে সে দাঁড়িয়ে খাড়া
লাফিয়ে বেয়ে উঠত ধেয়ে লাল করমচার গাছ।
চোখ পাকিয়ে চাকুমচুকুম খেত ইলিশ মাছ।
 
আমার একটা হাতি ছিল তৈরি তুলো দিয়ে।
দেখতে ছিল খুব সুন্দর
রেখেছিলাম নাম কুঞ্জর
ঢং দেখাত চিৎ হয়ে সে শুঁড়টা উঁচিয়ে।
সেদিন পুষি ফেলল ছিঁড়ে পেটটা খুঁচিয়ে।


 
বেরিয়ে গেল তুলোর ঢিপি, রইল না আর হাতি
আমার হল ভারি দুঃখ
সেদিকে তো নাই লক্ষ
নাচল পুষি মাথায় দিয়ে পেলাস্টিকের ছাতি।
আমার এখন সাত বচ্ছর, কেমন করে কাঁদি?
[হাতিশোক]
 
লেখাটিতে আমরা কী দেখি? পশুপ্রীতির সঙ্গে শিশু-মনস্তত্ত্বের সমন্বয়। সাত বছর বয়সী মানবশিশুর, বিশেষ করে বাঙালি শিশুদের এমনই আধপাকা দশা হয়, দুঃখ পেলেও তারা কাঁদতে পারে না। শিশুমনের এ অবস্থাটা সত্যি মর্মঘাতী। এবার আরেকটি উদাহরণ :
 
একটি দুটি পাতার ফাঁকে ভোরের আলো পড়ছে।


রাতের কালো লোহার গায়ে একটু একটু মর্চে।
সেই মর্চের গা ঘষবে সূর্যমামা কামার।
সোনার মতো ফুটে উঠবে। ঘুম ভাঙবে আমার।
ঘুম ভাঙবে জেগে উঠবে এক্ষুনি রাজধানী।


ভরবে কলরবে শহর, কলে আসবে পানি।
বাজার জমে উঠবে, ঘড়ি বেজে উঠবে টং।
জানালাতে ফুটে উঠবে সোনার মতো রং।
ঘুম ভাঙাতে এলে? আমি কখন জেগেছি।
এই দ্যাখো না আমিও চোখে সকাল মেখেছি।


এই দ্যাখো না হাতে আমার সোনালি রোদ লেগে-
তোমার চোখে ঘুমজাগানি আমি দিচ্ছি মেখে।
[ঘুমজাগানি]
 




এটি কিশোর কবিতার একটি অনন্য উদাহরণ। বিষয়ের দিক থেকে যেমন, কাব্যভাষার দিক থেকেও এটি অতুলনীয়। ‘রাতের কালো লোহার গায়ে একটু একটু মর্চে’- কী সুন্দর চিত্রকল্প! সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বিশেষত্বই যেন এখানে।
বিষয়োপযোগী চিত্রকল্প-দৃশ্যকল্প-রূপকল্প নির্মাণ যেন তাঁর একটি মজার খেলা।

একান্ত পোষা পাখির মতো কবিতার আঙিনায় এসব কারুকাজ হাজির করেন তিনি। এমন উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প সমৃদ্ধ কবিতা এই গ্রন্থে আরও অনেক আছে। কত উদাহরণ দেব! এসব থাক। এবার আমাদের ঐতিহ্য-সংলগ্ন একটি কবিতার কথা বলি।
 
বিচার যদি করতে চাও
ঝড়তি এবং পড়তি কে?
খবর তবে দিতেই হলো
বিনয় চক্রবর্তীকে।


 
লোকটা বুঝি সংখ্যালঘু?
বিদ্যেতে সে লঘু নয়।
সার্টিফিকেট দিচ্ছি লিখে।
মনঃপূত তবু নয়?
 
বেশ তো ডাকো সাইমনকে-
চলন বলন মিষ্ট,
পালন করেন বলেন যাহা
প্রভু যিশু খ্রিস্ট।
 
তাকেও না? তাকেও না!
-তোমরা তুলো ধুয়া।
সর্বশেষ ডাকছি তবে
সরোজ বড়ুয়া।


 
নাড়ছ মাথা ঘন ঘন,
বন্ধ করে রাখছ কান।
খবর যদি দিতেই হয়
ডাকো তবে মুসলমান?
 
কিন্তু এই দেশটা তো আর
শুধু মুসলমানের নয়-
এমনকি সে খ্রিস্টানের
হিন্দুর বা বৌদ্ধের নয়।
 
মানুষ এই পরিচয়েই
আমরা সব বাঙালি তো!
কেউ এখানে কক্ষনো নয়
ঝড়তি এবং পড়তিও।
[সবার দেশ]
 




চির সহঅবস্থানের দেশ এই বাংলা। অনাদিকাল থেকে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মাবলম্বী এই ভূখণ্ডের অধিবাসী।

তবু কালবৈশাখী ঝড়ের মতো বারবার এই জনপদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত। এটা কখনও সুস্থ সভ্য সমাজের কাম্য নয়। শিশু-কিশোর-তরুণ পাঠকদের মধ্যে এই বোধ সঞ্চার করার লক্ষেই নিশ্চয়ই কবির এই উদাত্ত উচ্চারণ।
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য-চেতনার প্রধান দিকই হল ঐতিহ্য-সংলগ্নতা। তাঁর সিংহভাগ কবিতা ধারণ করে আছে বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য, লোকজ আচার, সংস্কৃতি, জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামের বর্ণিল সব অনুষঙ্গ।


এই ধারার উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে আছে ‘আমার পরিচয়’, ‘বিদিতাকে চিঠি’, ‘বর্ণমালায় শোনো যুদ্ধের ডাক’, ‘ইতিহাসের গান’, ‘সংক্ষেপে আমাদের ইতিহাস’ ও ‘পরিমলদের বাড়ি’। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গ্রন্থে আছে একাধিক কবিতা।
এমনই অসামান্য হৃদয়গ্রাহী একটি কবিতা ‘গল্প বলো, মাগো’। এ কবিতায় কাজলাদিদির মতো ছোট্ট খোকা মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইয়ের কথা শুনতে চায়। মা মুখে কোনো কথা বলে না, আকাশের তারায় তারায় খোঁজে তার হারিয়ে যাওয়া খোকাকে।

মার দেখাদেখি ছোট্ট খোকাও তার দাদাকে খোঁজে আকাশের তারা-জ্যোৎস্নায়। পরিবেশনার গুণে কবিতার এই করুণরস আচ্ছন্ন করে পাঠককেও।



জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও আছে একাধিক কবিতা। এমনই একটি চিরায়ত কবিতা ‘মুজিব! মুজিব!’। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে লেখা ‘বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে’ গীতিময় ধারার একটি মনোজ্ঞ কবিতা।


কাহিনিধর্মী সুখপাঠ্য সরস কবিতাগুলোর মধ্যে ‘রহিমের পেরেশানি পুরান ঢাকায়’ ও ‘কদমতলি’র নাম করা যায়। এছাড়া সাধারণ বিষয়ের বেশকিছু হাস্যরসাত্মক কবিতাও রয়েছে। ছোটদের কবিতার রকমফের ও শৈলী বুঝতে হলে উৎসাহী পাঠকদের জন্য সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ছোটদের কবিতা অবশ্যপাঠ্য।
সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো শিশু-কিশোর কবিতায়ও যে কবির সাম্রাজ্যের এমন ব্যাপক বিস্তৃতি তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। আমরা আশা করব, শিশুসাহিত্যের আসরগুলোতে তাঁর নিয়মিত উপস্থিতি থাকবে।

বয়স তাঁর যতই বাড়ুক ছোটদের লেখা থেকে তিনি ছুটি নেবেন না। সবুজ কালিতে অবিরাম পদ্য লিখবেন আর আকাশের নীল রংয়ে কাটাকুটি করবেন।
 

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.