সৈয়দ শামসুল হক। কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্য, সিনেমা, চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ শিল্পকলার বিবিধ শাখা-প্রশাখায় একজন সফল কারিগর। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রামে জন্মেছেন এই সব্যসাচী লেখক। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় এলেন। চোখের সামনে দেখলেন একটি ছোট ছিমছাম ঢাকা শহর কীভাবে বড় হতে হতে এক মহানগরীতে পরিণত হলো।
দেখলেন, ভাষার জন্য রাজপথে আত্দাহুতি দিল বাংলার মানুষ, দেখলেন কীভাবে একটি দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পর চার দশক পেরিয়ে এসেও সদা প্রাণবন্ত সৈয়দ হক এখনো সচল লেখক। মাঝখানে লন্ডনেও ছিলেন বেশ কিছু বছর। এখনো দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার নানামুখী অনুষ্ঠানে হরহামেশা উপস্থিত থাকছেন। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাভাষায় এই মুখর সৃজনকার জীবনের ৭৯ বছরে পেঁৗছবেন।
আলাপের আগেও একটি আলাপ থাকে, শুরু হলো আলাপ। পুরো সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ ছাপা হলো- টোকন ঠাকুর
হক ভাই, ৭৮ শেষ করে ৭৯-তে পা দিচ্ছেন। ২৭ তারিখ আপনার জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আপনার কিছু কথাবার্তা শুনব।
আমি কোনো গোছানো প্রশ্ন করব না। আপনিও খোলামেলা বললেই ভালো। কারণ, দেখা যায় প্রথাগত প্রশ্ন যাকে করছি তিনিও তৈরি হয়ে নিচ্ছেন কীভাবে উত্তরটি দিতে হবে- প্রশ্নের ভেতরেই উত্তর তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা ওসবের মধ্যে যাব না। স্বতঃস্ফূর্ত আলাপচারিতার মাধ্যমে একটা সহজ মাত্রায় পেঁৗছানোর চেষ্টা করতে পারি।
হ্যাঁ, বল না বল। আমি তো সাক্ষাৎকার দিচ্ছি না- একজন কবির সঙ্গে কথা বলছি। আড্ডা দিচ্ছি।
কালকে রাতে আমার মনে হচ্ছিল আপনার উদ্দেশে কয়েকটি প্রশ্ন লিখি। প্রথম প্রশ্নটা লিখলামও।
লেখার পর মনে হলো_ না না এ রীতিতে যাব না। তো সেই প্রশ্ন যেটা লিখছিলাম সেটা হচ্ছে এ রকম, এই যে আপনি আটাত্তর বছর বয়স পার করলেন_ এ রকম বয়সে বাংলাদেশের জীবনে মানুষ সাধারণত ঝিমিয়ে পড়ে। সেই জায়গায় আপনার মধ্যে যে রকম তারুণ্য, স্বতঃস্ফূর্ত তারুণ্য, সদা তারুণ্য- এটা কি আপনার নিজের জীবনেরই সঞ্চিত তারুণ্য খরচ করে চলেছেন নাকি আজকের তারুণ্য থেকে তারুণ্যটা লুট করে নিচ্ছেন? এ তারুণ্যের উৎস কোথায়?
তুমি যদি চাও তবে তোমার সাক্ষাতে না হয় ঝিমিয়ে পড়ি। না, ঝিমিয়ে পড়ার বিষয়টা দেখ এভাবে দেখতে হবে, সেটা হচ্ছে এমন, তোমার চারপাশে যা ঘটছে, যার ভেতর দিয়ে তুমি যাচ্ছ তা তুমি তোমার ভেতরে অনুভব করতে পারছ কি না। যেই মুহূর্তেই তুমি ঝিমিয়ে পড়ছ, তুমি মৃত।
আর যদি বল সতেজ আছি কি নেই- আমি এভাবে দেখি না। আমি কাজ করে যাচ্ছি। সেই জীবনের প্রথম যে কাজ শুরু করেছিলাম- লেখার কাজ, এ কাজ তো কেউ আমাকে দেয়নি, আমিই আমার নিজেকে দিয়েছি এবং আমার কারও কাছে অবসর নেওয়ারও নেই। কারণ কাজটা আমিই আমাকে দিয়েছি এবং সেই কাজটা করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কাজটা কী? কাজটা হচ্ছে লেখার ভেতর দিয়ে আমার জীবনের অনুভবকে প্রকাশ করা।
আমি যে বেঁচে আছি প্রথমত এটা আমাকে অনুভব করতে হয়। দ্বিতীয়ত সেই অনুভবটা আমার ভেতরে কিছু শব্দের জন্ম দেয়, কিছু চিত্রের জন্ম দেয়, কিছু উপমার জন্ম দেয়। তুলনা, প্রতিতুলনা করি। এর সবটা মিলিয়ে যে কাজ সেটিই আমার কাজ।
আপনার কাজের ধরন কেমন? লেখালেখির ভাষায় আপনি সব্যসাচী।
আপনার গল্প-কবিতা-উপন্যাস শিশু সাহিত্য-নিবন্ধ-জার্নাল বা কত রকম রচনা- চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা, মঞ্চনাটকের জন্য প্লে-রাইটিং অর্থাৎ বহু শাখায়ই নিজেকে চারণ করিয়েছেন- তারপরও সৈয়দ হককে কবি হিসেবে গোপনে গোপনে আমার ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের যে এত শাখা-প্রশাখায় কাজ করলেন, এরপরও কি আপনার পিপাসা মেটে না?
আমার কাজ তো হচ্ছে উপকরণের দিক থেকে ভাষা মাধ্যমে কাজ করা। ভাষা মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে ভাষার যতগুলো সৃজনশীল প্রকাশক্ষেত্র আছে- কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ- সবগুলোতেই আমি কাজ করেছি, কাজ করে যাচ্ছি। এটা এ রকম যে, আমি আলাদা করে দেখি না কোনো একটি মাধ্যমকে। আমি মনে করি যে, কিছু বলবার কথা আছে এবং সেই বলবার কথাটি বলবার জন্যই সমূহ যে মাধ্যমটি আমার কাছে সবচেয়ে উপযোগী মনে হয় সেটিকে ব্যবহার করি।
কখনো সেটি কবিতায় আসে, কখনো সেটি গল্পে আসে, কখনো উপন্যাসে আসে, কখনো নাটকে এবং প্রতিটি মাধ্যমই কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে সমান শক্তিশালী। এটা আমি কখনো বলি না, এটা বড়, ওটা ছোট।
মাধ্যমের ছোট-বড়র কিছুই নেই বলছেন?
না না না, হ্যাঁ; এটা আমি কখনো বলি না। কিন্তু তারপরও বলব, কবিতাই হচ্ছে ভাষার সর্বোত্তম সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে সাংকেতিক ব্যবহার। সেটি আমি যখন করি বা সেটি যখন কেউ খুব সফলভাবে করেন যিনি অন্য মাধ্যমে কাজ করছেন তিনিও মূলত কবি, প্রধানত একজন কবি।
তার সেই কবিসত্তা থেকেই উৎসারিত হয় সবগুলো মাধ্যমের দিক।
হয়তো তিনি হতে পারেন একজন ভাস্কর, তারপরও তিনি কবি!
হ্যাঁ, তারপরও। তবে ভাস্কর্য বা চিত্রকলার কথাই যদি বলি সেটা কিন্তু ভাষা থেকে একেবারেই ভিন্ন একটি মাধ্যম। কীভাবে? এটি আমরা দেখি, চোখে দেখি। আবার ভাস্কর্য দেখ ঘুরেফিরে দেখতে হয়।
এটার কিন্তু একটা কোনো দৃষ্টিকোণ নেই, দৃষ্টিপথ নেই। আবার অাঁকা ছবিতে তুমি একটি দ্বিমাত্রিক ছবির সামনে দাঁড়াচ্ছ এবং একবারে নিচ্ছ। একটা কবিতা তোমাকে প্রথম থেকে শেষঅব্দি পড়ে তবে ভেতরে নিতে হচ্ছে। কিন্তু ছবি, একবারেই আমার সামনে চলে আসছে, এক দেখাতে। এবং তারপর আমি বিশেষভাবে দেখি।
এবং সেখানে হচ্ছে ওই সৃজনশিল্পী ওই চিত্রকরের বিশেষ শক্তির পরিচয় যে, তিনি আমার চোখটাকে কীভাবে ভ্রমণ করাচ্ছেন সমগ্র ছবিটাতে। এটা কিন্তু আলাদা কাজ। আমি নিজে যে অবসরে ছবি অাঁকি, আমার আপন আনন্দে ছবি অাঁকি, সেখানে আমার ভেতরের কিছু রং আমার ভেতরের কিছু বিন্যাস মনের ভেতরে আসে...
সে ক্ষেত্রে জলরঙের প্রতি বেশি ভালো লাগা কাজ করে কি না?
না না। আমি প্রধানত কাজ করেছি অ্যাক্রেলিকে। অ্যাক্রেলিকে দুটো সুবিধা আছে- সেটা হচ্ছে আমার মতো অবসরের চিত্রকর, সময়টাকে আমি খুব দ্রুত ব্যবহার করতে পারি।
আমার ভেতরে যা রং এবং বিন্যাসের যে ছবিটা রয়েছে, যে জমিটা আমার ভেতরে রয়েছে সে জমিটাকে এক চাপেই আমি এনে ফেলতে পারি। রংটা দ্রুত শুকোয়, রংটাকে ইচ্ছা করলে জলরঙের আকারেও ব্যবহার করা যায়, প্রকারেও ব্যবহার করা যায়। আবার তেলরঙের ঘনত্বেও ব্যবহার করা যায়। তুমি তো নিজে ছবি অাঁকো, তুমি তো জান যে, অ্যাক্রেলিকের এই সুবিধা আছে। এবং জলরঙ হিসেবেও কিন্তু এটাতে কাজ করা যায়...
এবং দ্রুত করা যায়।
দ্রুত করা যায়, শুকিয়ে যায়, সময় নেয় কম।
হক ভাই ঢাকা শহরে আপনার আগমন কোন সময়কালে? তখনকার ঢাকা নিয়ে আমরা কিছু কথা শুনব। আপনাদের ছাত্রজীবন বা তখনকার সামাজিক-সংস্কৃতি, আজকের সামাজিক-সংস্কৃতি এসব জায়গায় একটু কথায় কথায় ঘুরে আসতে চাই।
এই শীত-সকালে একেবারে পেছন ফিরে তাকাতে বলছ?...শীতের মাস। এই শীতের ভেতরে কুড়িগ্রামের কথা মনে পড়ে।
ঘন কুয়াশা, কী শীত কী শীত! হিমালয় তো খুব কাছে। আর বরফ পড়ে না বটে কিন্তু ভোরবেলায় ঘাসের ওপর শিশির জমে কাচের মতো প্রায় স্বচ্ছ হয়ে যায় এবং সেই শিশিরে বোধ হয় কাচের মতো নিরেট কাঠিন্য থাকে। হাঁটলে পায়ের নিচে মর্মর মর্মর করে সেই জমাট শিশির ভেঙে যায়। সেটি মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে ভোরবেলায় হাঁটতে হাঁটতে ধরলা নদীর পাড় পর্যন্ত যেতাম, ফুল কুড়োতাম, কচুর গুঁড়ি নিয়ে আসতাম, শিউলি ফুল নিয়ে আসতাম মায়ের জন্য।
কেন? ওই শিউলির বোঁটা, মা ওগুলোকে শুকোবেন। শুকিয়ে পায়েসে যাবে, পোলাওতে যাবে, রং হবে। গরিবের ঘরে আর জাফরান কোথায়? ওই শিউলির বোঁটাই খাবারের রং। আমি কিন্তু একেবারেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। খুব কষ্টের ভেতর দিয়ে দিন গেছে।
বিশেষ করে আমার মনে পড়ে ১৯৪৩ সাল, পঞ্চাশের মন্বন্তর। ওই সময় আমার বয়স সাত সাড়ে সাত। সেই সময় একবেলা খাচ্ছি, লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেখছি নিরন্ন অনাহারী শীর্ণ কঙ্কালসার মানুষ সারি দিয়ে বসেছে। এক খাবলা খিচুড়ি পড়ছে কলার পাতে।
তাই কি গোগ্রাসে খাচ্ছে এবং তার ভেতর থেকে বাঁচিয়ে মুড়ে আবার রেখে দিচ্ছে যে পরের বেলা খাবে। এ বেলা না হয় আধাপেটাই খেলাম। আমি চিন্তা করি আমার বাবার না জানি কত কষ্ট হতো, আমার মায়ের বুক ভেঙে যেত যে সন্তানের মুখে দুবেলা দুটো ভাত গুঁজে দিতে পারছেন না। ছোট ছোট আলু হতো, বড়ির মতো- সেই আলুসেদ্ধ, ছোলাসেদ্ধ কোনোরকমে খাচ্ছি আরেক বেলা ফেনাভাত একটুখানি, তাও ভরপেট নয়।
সে ক্ষেত্রে শীতকালটা নিয়েও একটা প্রশ্ন হয়ে আছে।
আপনার জন্ম এমন সময় যখন বাংলাদেশে শীতকাল এবং এ মুহূর্তেও শীতকাল। এবং উত্তরবঙ্গে বা কুড়িগ্রামের দিকটায় শীত একটু বেশিই পড়ে। আপনার কবিতায়...
শীত আমার খুব পছন্দ। কিন্তু আমার কবিতায় গ্রীষ্ম এবং বৈশাখ বহুবার করে এসেছে। আমার তো একটি দীর্ঘ কবিতাই আছে...
বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা-
...এটা, বৈশাখের কি বিবরণ ওর ভেতরে আছে সেটা সন্ধান করবার আগে এটা বলা ভালো যে, গরমের ভেতরে আমি খুব উত্তেজিত বোধ করি।
কিছু লেখার জন্য, কিছু করার জন্য, কিছু বলার জন্য, এমনকি কিছু অাঁকার জন্যও।
আপনার ভেতরের রুদ্ররূপটা ওই সময়ে ধরা পড়ে?
রুদ্ররূপ আমি বলব না। আমি বলব যে, আমার মধ্যে একটা মানুষ কাজ করে যে মানুষটা অনুরণিত হয় চারদিকের বাস্তব দিয়ে।
বাংলা কবিতা প্রসঙ্গে আসি। বাংলা কবিতার এখনকার তরুণরা যা করছে সে ক্ষেত্রে তরুণদের প্রতি আপনার যে পর্যবেক্ষণ তা থেকে কি মনে হচ্ছে উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধতর একটি জায়গায় আমরা পেঁৗছাতে পেরেছি? নাকি কিছুটা অ্যানার্কিও তৈরি হয়ে গেছে বা হচ্ছে?
একদম পরিষ্কার ভাষায় বলি।
অত্যন্ত বেশি প্রাণশক্তি রয়েছে, খুব প্রাণশক্তি আমি লক্ষ্য করি। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু মনোযোগের অভাবও আমি লক্ষ্য করি এর নির্মাণের দিকটায়, যাকে বলি আঙ্গিক। কী বলছি, কীভাবে বলছি- দুটিই কিন্তু সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটু নয় অনেকখানি মনোযোগী হওয়ার আছে। যেমন কবিতার কারিগর হিসেবে দুয়েকটা দিক আমি বলতে পারি।
এ মুহূর্তে করছি_ যেমন তুমি যখন কবিতায় একটি চিত্রকল্প আনছ... সেই চিত্রকল্পের আওতাধীন ক্ষেত্র তা থেকেই বাকি চিত্রকল্পগুলো উঠে আসবার কথা। কিন্তু দেখা যায়, সে রকম হচ্ছে না। তার মানে মনোযোগী নয়।
একটু উল্লম্ফন বা একটু অমনোযোগী হয়ে গেলেই তো তার কেটে যাওয়া...
তার কেটে যাওয়া না, একদম ভিন্ন ক্ষেত্রে চলে যাচ্ছে। এক জায়গায় নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে ছন্দজ্ঞান_ ছন্দ এ রকম নয় যে, আমি পয়ার অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্তের কথা বলছি তা না। ছন্দ- গদ্যে লিখলেও_ যে স্পন্দন...
মানে বুননের মধ্যেই যে ছন্দ থাকে...
যে স্পন্দনটা আছে যে ধ্বনিস্পন্দন সে সম্পর্কে আমার মনে হয় মনোযোগী হওয়ার আছে। এখানে যথেষ্ট মনোযোগ পায় না। আরেকটি বিষয় পায় না, সেটি হচ্ছে যে একটি রচনা কখন সম্পূর্ণ হয়। ... কখনো কখনো কোনো কবিতা আমার মনে হয় ভালো লাগছে; কিন্তু একটু অতিকথন।
আবার কখনো মনে হয় না, শেষ করতে পারল না। ভারি সুন্দর এগুচ্ছিল; কিন্তু শেষ করতে পারল না। এটি কিন্তু সাধারণভাবে বলছি। আবার কিছু রচনা আমি এমনও দেখছি, পেয়েছি, পাচ্ছি যে সেটি শব্দের দিক থেকে তৃপ্তিকর। কিন্তু এটা সার্বিকভাবে যদি আমাকে বলতে হয় তো আমি বলব যে, যেমন প্রচুরভাবে আমি প্রাণশক্তি লক্ষ্য করি যে, একটা নতুন কণ্ঠস্বর নতুনভাবে অবলোকন, এর যে একটা ভেতরের আকাঙ্ক্ষা এটি যেমন ছত্রে ছত্রে পাই, তেমনি কীভাবে বলছি এটিকে এখনো অনেকখানি প্রত্যাশিত রয়ে গেছে বলে আমি মনে করছি।
গদ্যের ক্ষেত্রে আপনার মূল্যায়ন...
গদ্যের খুব খারাপ অবস্থা বাংলাদেশে। খুব খারাপ অবস্থা। আর গদ্য তো কেবল সাহিত্যে কেন সারা দিন সারা জীবন ভরেই দেখ না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখ না, গদ্যের খুব খারাপ অবস্থা। বাংলা রাষ্ট্র ভাষার জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছি, বড় বড় কথা বলি_ শব্দ ব্যবহারে অসচেতনতা। যারা সৃজনশীল গদ্য লেখক তাদের গদ্যে আমি দেখতে পাই অমনোযোগিতা।
পদবন্ধ, বাক্যের পর বাক্যে যে একটা স্পন্দন তৈরি হয়_ কোথায়? পাই না।
এগুলো না থাকার কারণ কী? এদের পাঠের অভিজ্ঞতা কম নাকি মনোযোগের অভাব?
মনোযোগ মনোযোগ। মুশকিলটা কোথায় জান? মুশকিলটা হচ্ছে, ভাষাকে আমরা প্রতিদিনের জীবন নির্বাহে ব্যবহার করি- অফিস-আদালত বাজার-সংসার সবই ভাষায় করছি। আবার যখন লিখতে বসি তখন ভাষাতেই লিখি। কিন্তু দুটো ভাষা আলাদা।
সৃজনশীল মুহূর্তে ভাষা কিন্তু প্রতিদিনের ভাষা থেকে বিযুক্ত। আবার প্রতিদিনের ভাষার ভেতর থেকেই কিন্তু তার উদ্ভব। শুধু এটাকে ব্যবহার করতে হয় কীভাবে_ তুমি তো ছবি অাঁক। ছবি অাঁকার মানুষ, কবিতাও লেখ বা কবিতাই লেখ ছবি অাঁক খুব কম- তোমাকে বলি ভাষায় একজন লেখক কীভাবে শব্দ ব্যবহার করে_ চিত্রকর যেমন তার রংকে, নর্তক যেমন তার হাতের মুদ্রা, পায়ের মুদ্রা, শরীরের ছন্দ_ ভাস্কর যেমন তার পাথরকে, ঠিক সে রকমভাবে- বা সংগীত যিনি করেন তিনি স্বরগ্রাম সেই সপ্তস্বরকে যে রকমভাবে ব্যবহার করেন ঠিক সে রকমভাবে ভাষাকেও লেখক ব্যবহার করেন কিছু একটা বলার জন্য। কিন্তু সেটা ব্যবহারিক ভাষা নয় এটা বুঝতে হবে।
সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার একটি বড় জায়গা, সাবেক বড় জায়গা বলব পশ্চিমবঙ্গ- পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা বিশেষ করে আজকের দিনে তরুণদের একটা বিভাজন হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা মনে করি। আপনাদের সময় তো এটা শুরু হয়েছে, সেটার উত্তরাধিকার বহন করার ভেতর দিয়ে আজকের প্রজন্ম হয়তো খানিকটা স্বাধীনতা নিয়ে ফেলে এবং সে ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় হয়তো অভিজ্ঞতারও অভাব থাকে। আমি নিজেকে দিয়েই টের পাই এবং এটাও টের পাই যে, আজ বোধ হয় আর সেদিন নেই যে পশ্চিম বাংলা থেকে আগত কোনো ঔপন্যাসিকের উপন্যাস বা কবির কবিতার বই পড়ার মধ্য দিয়েই যেমন এক সময় এখানকার পাঠকের স্বাদ, এমনকি লেখকেরও লেখক হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রস্তুতি থাকত। এখন আর সে অবস্থায় বাংলাদেশ নেই।
আমি অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে দেখছি।
আমি বলেছি যে, ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে চিত্রকরের রঙের মতো, নর্তকের মুদ্রার মতো, সংগীতকারের সপ্তস্বরের মতো ব্যবহার করতে হবে। আর তুমি যে বলছ, নতুন কিছু করতে চাচ্ছ; না, এভাবে কেমনে এগুবে। আর এখানে পশ্চিমবঙ্গের কথা এনো না। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার কারণে ভাষা এক হলেও তার ভেতর ব্যঞ্জনা ভিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশের রক্ত বললে যা বোঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গের রক্ত বললে তা বোঝা যায়? তা বোঝা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আপনার কাছে দু'একটি কথা শুনতে চাই। রবীন্দ্রনাথকে আপনি কীভাবে পেলেন, কীভাবে রাখলেন, কীভাবে বিদায় করলেন?
অত দীর্ঘ গল্পে যাব না। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমি যা নিয়েছি সেটা হচ্ছে তার বলবার কথা নয়, সেটা হচ্ছে তিনি কীভাবে বলেছেন তার সেই বলবার আঙ্গিকটিকে এখনো আমি পর্যবেক্ষণ করি, বোঝার চেষ্টা করি; কীভাবে তার কাছ থেকে আহরণ করা যায়।
তিনি ভাষার সবচেয়ে বড় কারিগর। এত বড় কারিগর, ভাষার কারিগর আমার ভাষায় আর আসেনি।
সেই কারিগরের কাছ থেকে তার কারিগরি দিকটা আমি পাই, নিই, দেখি এবং বুঝে দেখার চেষ্টা করি এবং আমি কি করছি তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
সে ক্ষেত্রে ঈর্ষা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো বিষয় ফিল করেন কি না?
আমার খেলা মহাকালের সঙ্গে, ব্যক্তির সঙ্গে নয়- তিনি যত বড়ই হোন। তিনি শেকসপিয়র হন কি কালিদাস হন, কি রবীন্দ্রনাথ হন, বার্ল্টড ব্রেশট হন, কি তলস্তয় হন- আমার খেলা হচ্ছে মহাকালের সঙ্গে। সেখানে আমি এবং মহাকাল; আমরা একটা বিশাল সমুদ্রতীরে বসে গোধূলিলগ্নে- গোধূলি মানে ভোর কিংবা সন্ধ্যা দুটিই হতে পারে বাংলা ভাষায়- সে রকম একটি আলোছায়ার ভেতরে আমরা বসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। দেখি মহাকাল আমাকে বিলীন বিলুপ্ত করতে পারে কি না...
নাকি কোলে তুলে নেয়।
আবারও একটি হাসির আমেজ রুমের মধ্যে। তিনজনই হাসছি তখন আমরা। সৈয়দ হক বয়সে তরুণ বলেই তার সঙ্গে আড্ডায় বসে প্রাণ খুলে হাসা যায় সহজেই। কোনো দ্বিধা লাগে না, বাধা থাকে না। সত্যি সত্যি সৈয়দ শামসুল হককে সবসময় একজন সমৃদ্ধ তরুণ বন্ধু হিসেবে ভাবা যায়, পাওয়া যায়।
এখনকার যারা কবিতা, গল্প, উপন্যাসের পাঠক; টেলিভিশন এবং নানারকম মাধ্যমের কারণে পাঠের সেই রীতি বোধ হয় ভেঙে যাচ্ছে। সেই সনাতনী পাঠের রীতি এখন আর...
আমি জানি। এমন প্রশ্নের সঙ্গে আমি পরিচিত। লোকজন যাই বলুক না কেন, আমি মনে করি না যে, সে ক্ষেত্রে আমাদের বিচলিত হওয়ার কিছু আছে। প্রযুক্তির একটা বিপ্লব ঘটে গেছে।
কোনো কিছু নতুন নতুন হলে যা হয় এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। বই বই-ই থাকবে, পড়ার অভ্যাস পড়ার অভ্যাসই থাকবে। এখনো তো বই পড়েই লেখাপড়া শিখতে হয় শিশুকাল থেকেই। এই যে কবিতার কথা বল, অনেকে বলে যে কবিতা কি থাকবে? আরে, একটা বাচ্চাকে আমরা প্রথম কী শেখাই? কবিতা শেখাই। একজন অতিথি এলে বলি, বাবা একটা কবিতা বলো তো, মা একটা কবিতা তোলো তো।
ফলে আমি তো দেখি যে, ওখানে এখনো কবিতার কাজ রয়ে গেছে। এখনো যারা প্রেমে পড়ছেন বই কিনে প্রেমিকাকে কবিতা শোনাচ্ছেন, বই উপহার দিচ্ছেন। এই যে কবিতাও একটি কাজে লেগে গেছে। বই পড়া_ বই পড়তে সবচেয়ে কম আয়োজনের দরকার হয়। এর জন্য ব্যাটারি লাগে না, ইলেকট্রিসিটি লাগে না।
তুমি পড়ছ, ব্যাক নাই ফরোয়ার্ড নাই; ইচ্ছামতো তুমি পড়তে পাচ্ছ। এবং তুমি যে কথা বলছ সে কথাগুলো কে কীভাবে একজন ব্যবহার করেছে এ একটা আলাদা আনন্দ, এটা একটা আলাদা মজা। এটি হাজার হাজার বছর টিকে আছে। তখন হয়তো আজকের মতো ছাপা কাগজে বই ছিল না। কিন্তু পাথরের ফলকে, পোড়ামাটির ফলকে, পশুর চামড়ায়, ধাতব পাতের উপরে লিখেছি, তালপাতায় লিখেছি।
এই যে লিখিত যে ভাবনাচিন্তাগুলো রেকর্ডেড থটস, দ্য রেকর্ডেড ইমাজিনেশন এটার বিকল্প আমার মনে হয় না যে টেলিভিশন বা ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের স্ক্রিন। এগুলো দিয়ে কি হয়? এগুলো দিয়ে হয় না।
প্রযুক্তিতে মেতে ওঠে এখন হ্যাঁ যে ছেলেটি, যে মেয়েটি, ৩০ বছর আগে ২০ বছর আগে একটা বই নিয়ে বসত; সে হয়তো আজকে ল্যাপটপ খুলে দেখছে কিছু একটা করছে। সময়টা বইয়ে না দিয়ে অন্য কিছুতে দিচ্ছে কিন্তু এটা কেটে যাবে। যে কোনো প্রযুক্তি বিপ্লবেই এটি হয়।
প্রথম প্রথম খুব মেতে ওঠে, খুব মাতোয়ারা হয়ে যায়। এই যে নতুন নতুন বিয়ে করলে যেমন হয়_ সারাক্ষণ তুমি-আমি চলছি, তারপর যখন ওই জিনিসটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তখন ঘোর কেটে যায়। আমি তো অনুভব করি আমি বেঁচে আছি। আমি তোমাদের মধ্যে বেঁচে আছি তো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।