হাসন রাজায় কয়, আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয় !
ঈশ্বরের চোখ
-----------------------------------------------------------------
‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’ লেখাটির এই নিয়ে তিনটি পর্ব হলো । ‘স্মিথসোনিয়ান’ এর কঠিন আর্টিকেল টাইপ লেখা । আমি সেই জাতীয় লেখার মধ্যে কিছু আবেগ, কিছু নিজস্ব চিন্তাভাবনা ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি । চেষ্টা করেছি পড়লে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে এটা কাটখোট্টা বিজ্ঞান । লেখাটা হবে খুব সহজ-সরল-আন্তরিক ভাষায়, যাতে পাঠকের পড়তে পড়তে মনে হয়, ‘আরে ! এই ব্যাপারটাতো আগে খেয়াল করে দেখিনি !’ ।
লেখাটি প্রগাঢ় আনন্দ নিয়ে লিখছি । আর আমি মোটামুটি নিশ্চিত যিনি বা যারাই লেখার পর্বগুলি পড়ছেন, খুব আনন্দ নিয়েই পড়ছেন । কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে মেইলে কিছু চমৎকার কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন । নবীন লেখক হিসেবে আসলেই অনেক বড় পাওয়া । তবু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে হয়নি, তা নয় ।
আমি গত পর্বের কোন এক জায়গাতে বিভিন্ন প্রানীর দৃষ্টিশক্তি বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের চিন্তাধারা থেকে লিখেছিলাম,
...স্রষ্টা এদের চোখ দিয়ে পাঠিয়েছেন, অথচ দৃষ্টিশক্তি দিতে ভুলে গেছেন । ভাগ্যিস ছুঁচো হয়ে জন্মাতে হয় নি ! নয়ত অন্ধত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হতো...
এক পাঠক আমার এই লেখাতে খুব আহত হলেন । তিনি তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় লিখলেনঃ
“তাহলে, দায়ভার তো সৃষ্টিকর্তার উপরেই বর্তালেন নাকি? কিন্তু আমরা তো হরহামেশাই বলে থাকি, সৃষ্টিকর্তা যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন। তাহলে, আপনার চোখ আছে বলে আপনি ভাগ্যবান আর চোখ আছে কিন্তু দৃষ্টিশক্তি নেই বলে ছুচোরা ভাগ্যহীন এটা মনে করা কি স্রষ্টার নিপুনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নয়? জেনে বুঝে স্রষ্টার কর্মপ্রয়াস কে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন---কাজটা কি ঠিক করলেন?”
তাঁর এই কমেন্টটি পড়ে আমার প্রথম যেই চিন্তাটি মাথায় এলো, সেটি হচ্ছেঃ আমি সবার চোখ নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছি, সেখানে ঈশ্বরের চোখ নেই কেন ? ভেবে দেখলাম, ঈশ্বরের চোখের ব্যাপারটা তো প্রথমেই আসা উচিত ছিল । কেননা ঈশ্বরের চোখ সম্পর্কে কিছু জানার বিষয়টাই মজার ।
আসলে আমরা যা কিছু ‘এবসল্যুট’ভাবে জানি না, তার সবটাই আকর্ষনীয় । এই বিষয়ে বিরাট বিতং করে প্রথম পর্বেই লেখা উচিত ছিল । যাই হোক, প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছি । আজ তাই লেখার নামই দিয়ে নিয়েছি ‘ঈশ্বরের চোখ’ !
-------------------------------------------------------------------
এখানে না দেখলাম যারে
চিনব তারে কেমন করে
ভাগ্যেতে আখেরে তারে
দেখিতে যদি পাই । ।
(লালন ফকির)
লালন সাঁইজী এভাবেই ঈশ্বরকে খুঁজেছেন দেহলোকে । তিনি অদেখা ঈশ্বরকে ওপারে গিয়ে চিনেছিলেন কি না জানি না, তবে তাঁর এই চিন্তা নিয়ে অতীতে ইহলোকেই বলে গিয়েছিলেন মহামানব গৌতম বুদ্ধ । বুদ্ধের সাথে বাশিষ্ঠের কথোপকথনকে আমরা সাঁইজীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে কল্পনা করে নিতে চেষ্টা করিঃ
" 'বাশিষ্ঠ!...... ত্রৈবিদ্য ব্রাহ্মনের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি নিজের চোখে ব্রহ্মাকে দেখেছেন ? .....এক আশ্চর্য.... এক আচার্য-প্রাচার্য..... সপ্ত-পর্যায় ধরেও আচার্যই হতে পারে না .... ব্রাহ্মনগণের পূর্বজ ঋষি, মন্ত্রকর্তা, প্রবক্তা.... অষ্টক,বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু....... এদের মধ্যে কি কেউ ব্রহ্মাকে স্বচক্ষে দেখেছেন ? ......যাঁকে দেখেননি, জানেননি তাঁরই অস্তিত্ব নিয়ে উপদেশ করেন!........ বাশিষ্ঠ...! এ যেন সেই অন্ধগণকে ক্রমপর্যায়ে পংক্তিবদ্ধ করা; প্রথমজনও দেখতে পায় না, দ্বিতীয়জনও দেখতে পায় না, তৃতীয়জনও নয়....। '" (তেবিজ্জসূত্র, ১/১৩)
কঠিন উত্তর ! বুদ্ধদেবের কথায় একথা স্পষ্ট যে, ঈশ্বরের পরম ভক্তরাও কখনও ঈশ্বরের দেখা পান নি । রোমান পুরানে কামদেবতা কিউপিডকে শুধুমাত্র এক নজর চোখের দেখা দেখে ফেলায় তাঁর মানবী স্ত্রীকে বরন করে নিতে হয়েছিল ‘বনবাস-জাতীয়’ শাস্তি ।
পাঠকরা কি এই গল্পটা জানেন ? রোমান সাহিত্যিক অ্যাপুলিয়াস তাঁর বিখ্যাত Golden Ass গ্রন্থে কিউপিড-সাইকীর প্রেম কাহিনী নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর উপাখ্যান তৈরী করেছেন । যাদের গল্পটা জানা নেই তাদের জন্যে গল্পটা উইকিপিডিয়া থেকে তুলে দিচ্ছি ।
এক রাজার তিন কন্যা ছিল । রাজকুমারী সাইকি ছিলেন তিন বোনের মধ্যে সবচে’ ছোট । বড় দুই বোনের যথাসময়ে বিয়ে হয়ে যায় ।
কিন্তু কনিষ্ঠা সাইকি রূপে-মাধুর্যে এতোই অপূর্বা ছিলেন যে সাধারন মানুষ তাকে মানবী না ভেবে দেবী ভাবতে শুরু করে । যুবকের দল ক্রমশঃ প্রেম নিবেদনের বদলে প্রণয়ের দেবী হিসেবে তাঁর পূজা করা শুরু করে দেয় । চারিদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, প্রণয়দেবী ভেনাস সাইকির ছদ্মবেশে মর্ত্যলোকে আগমন করেছেন । যার ফলে অল্পদিনেই ভেনাসের মন্দির জনশূন্য হয়ে যায় । সবার নজর তখন সাইকির দিকে ।
দেবী ভেনাস এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন । তিনি তার পুত্র কিউপিডকে নির্দেশ দেন যেন কিউপিড সাইকীর ওপর কামশর নিক্ষেপ করেন । যে কামশরের কারনে সাইকী পৃথিবী সবচে’ কুৎসিত এবং দরিদ্র ব্যক্তিটির প্রেমে পাগল হয়ে যাবে । সাইকির ভবিষ্যৎ যাবে কাঁদতে কাঁদতে ।
কিন্তু উপরের দিকে থুতু ফেলার ফল শুভ হয় না ।
সেই থুতু নিজের গায়ের উপরই এসে পড়ে । কিউপিড সাইকীর রূপচ্ছটা দেখে এতোটাই উন্মাদপ্রায় হয়ে যান যে নিজের ওপরই কামশর প্রয়োগ করে বসেন । একইসঙ্গে, মায়ের শত্রুর উপর অসহনীয় প্রেমের কারণে কিউপিড খুব বিব্রতও হয়ে পড়লেন । উপায় না দেখে কিউপিড দেবতা অ্যাপোলোর শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলেন ।
অ্যাপোলো দৈববাণীর মাধ্যমে সাইকির পিতাকে নির্দেশ দিলেন, সাইকিকে বধূবেশে নির্জন পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় রেখে আসতে হবে ।
সেখানে সাইকি অপেক্ষা করবে করবে এমন এক বরের জন্য যার ভয়ে মানুষতো তুচ্ছ, দেবতারা পর্যন্ত ভীত, বিচলিত । সাইকির বর ঈশ্বর নির্দিষ্ট করে রেখেছেন । দৈববাণী উপেক্ষা করার সাহস হলনা সাইকি বাবার । তিনি সাইকিকে পাহাড়ের চূড়ায় রেখে এলেন ।
কিউপিডের নির্দেশে বায়ুদেবতা জেফাইরাস সাইকাকে অচেতন করে কিউপিডের নবনির্মিত প্রাসাদে নিয়ে এলো ।
কিউপিড সাইকিকে তুলে নিয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তরে কুসুমরচিত বাসর শয্যায় শুইয়ে দিলেন । অল্পক্ষণ পর চেতনা ফিরে এলো সাইকির । সাইকি অনুভব করলো, প্রবল পুরুষের বন্ধনে সে আবদ্ধ । কিন্তু দৈববাণীর ভয়ংকর বন্ধনের মতো নয় । অত্যন্ত তীব্র কিন্তু বড় মধুর বন্ধন ।
আবেশে চোখ বন্ধ করলো সাইকি ।
(ফ্রান্সোই গেরার্ডের আঁকা Psyche and Amor, অন্য নামে Psyche Receiving Cupid's First Kiss (1798), এখানে প্রজাপতিটি রূপক অর্থে সাইকির কুমারিত্বের শেষ পবিত্রতার চিহ্ন । )
অদৃশ্য পুরুষটি তাকে কানে কানে বলল, “হে প্রিয়তমা ! তুমি আমার নাম জানতে চেয়ো না । আমাকে দেখার চেষ্টা করোনা । তাহলেই সুখে কাটবে আমাদের জীবন ।
আমি এই ভাবেই অন্ধকারে আসবো তোমার কাছে । হতবিহ্বল সাইকী সায় দিলো তাতে । এভাবেই চলতে থাকলো প্রতি রাতে তার অদৃশ্য স্বামীর সমাগম ।
কিছুদিন পরের কথা । সাইকির সুখে ঈর্ষান্বিত তার অন্য দুই বোনের প্ররোচনায় সাইকির মনে ‘কিউপিড’ সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম নেয় ।
দৈববানীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে বোনেরা তাঁকে বলে, “যাকে দেবতারা পর্যন্ত ভয় পায় সে কদাকার হিংস্র দানব না হয়েই যায় না । আর এই জন্যই তুমি যদি তাকে ঘৃণা করো তাই সে ভয়ে তোমার কাছে নিজের মুখ লুকিয়ে রাখে । ”
(সাইকি ও তার বোনদের গোপন মন্ত্রনা)
তারা সাইকিকে গোপনে একটি ছুরি ও একটি প্রদীপ দিয়ে বলে, “এই ছুরিটি লুকিয়ে নিজের কাছে রেখে দাও । সাথে এই নেভানো প্রদীপটিও । তোমার স্বামী যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন প্রদীপ জ্বালিয়ে তার মুখটা দেখে নেবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটি বসিয়ে দেবে কদাকারের বুকে।
আর সেটাই হবে ঐ দানবের হঠকারীতার যোগ্য শাস্তি । ”
পরবর্তী রাত্রিতে সাইকি অপেক্ষা করে থাকে । যখন কিউপিড সঙ্গমশেষে তার শয্যায় ঘুমিয়ে পড়ে তখনই সাইকি দ্রুত প্রদীপ জ্বালায় । প্রদীপের আধো আলোয় সে কিউপিডের অসম্ভব সুন্দর মুখ প্রত্যক্ষ করে । তার স্বামী যে কামদেবতা কিউপিড স্বয়ং ! তীব্র আনন্দে স্বামীকে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছা করলো তার ।
কিন্তু চুম্বন করার জন্য নীচু হতেই হাতের জলন্ত প্রদীপ থেকে কয়েক ফোঁটা তেল গড়িয়ে পড়লো নগ্ন কিউপিডের পায়ে । সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে পড়লেন কিউপিড । সাইকিকে ঐ অবস্থায় দেখে সব কিছু বুঝতে পারলেন তিনি ।
রাগে অন্ধ হয়ে কিউপিড চিৎকার করে বললেন,
"হায় মর্ত্যনারী, প্যান্ডোরার বংশধর তুমি । তাই আমার নিষেধ সত্ত্বেও সাধারণ ঔৎসুক্য দমন করতে পারলেনা ।
আমাদের প্রেমের যে এখানেই সমাধি হয়ে গেলো । "
আর্তনাদ করে সাইকি কিউপিডের পায়ের উপর পড়লো । কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে । সাইকিকে শেষ বিদায় জানিয়ে ধনুঃশর নিয়ে কিউপিড আকাশে উড়ে চলে গেলেন । সঙ্গে সঙ্গে সুবর্ণ প্রাসাদ অদৃশ্য হয়ে গেলো ।
বুকভরা নিঃসীম রিক্ততা নিয়ে সাইকি একা দাঁড়িয়ে রইলো । তার কাছে স্মৃতি ছাড়া আর কোন আশ্বাস থাকলোনা । সাইকি প্রতিজ্ঞা করলো কিউপিডকে সে খুঁজে বের করবেই । ...
গল্পটা আমি আর বলবো না । উৎসুক পাঠক নিজেরা পড়ে নেবেন ।
মূল লেখায় ফিরে আসি । এই পুরো গল্পে শুধু একটিমাত্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন ঈশ্বর বা দেবতাকে দেখা যাবে না ? ঈশ্বরের চোখ নিয়ে লেখার আগে ঈশ্বরকে দেখবার মত চোখ থাকতে হবে । তাই সেই চোখের অনুসন্ধানটা আগে করা উচিত । সুতরাং প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবার একটা চেষ্টা করি ।
এই প্রশ্নের ব্যাখ্যায় আমার একান্তই নিজস্ব একটা ‘থট’ আছে । দর্শনবাদী থট না । বিজ্ঞানবাদী থট । সেটা সম্পর্কে বলার আগে আমাকে প্রথমে আর একটি দর্শনবাদী গল্প বলতে হবে । আজকে খুব সম্ভব আমাকে গল্প বলার নেশায় পেয়েছে ।
যাই হোক, বড়গল্প তো বলবোই না, ছোটগল্পও বলবো না । এর নাম দেয়া যেতে পারেঃ ‘অনুগল্প’ । অনুগল্প শুরু করি । অনুগল্পের নাম দেয়া যাক, “ঈশ্বরের সাথে প্রথম দেখা” ।
ঈশ্বরের সাথে প্রথম দেখা
তীব্র শীতের রাত ।
গাঢ় অন্ধকার । নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আর কয়েকজন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে মিশরের পথে রওনা করেছিলেন এক মুসাফির । মরুভূমির মধ্যে এক পর্যায়ে এসে বুঝতে পারলেন তিনি আসলে পথ ওলট-পালট করে ফেলেছেন । চারপাশের গাছপালা সবই তুষারে ঢাকা, এমনকি পাথর পর্যন্ত বরফসিক্ত হয়ে আছে ! কাজেই আগুনও জ্বালানো যাচ্ছে না । ভয়াবহ অবস্থা ।
এরই মধ্যে দূরে এক চিলতে আলো দেখা গেল । মুসাফির সবাইকে রেখে একা একা আলোর দিকে এগিয়ে গেলেন । নিশ্চয়ই আলোর কাছে কেউ না কেউ থাকবে । প্রবল শৈত্যে টিকে থাকার জন্য অন্তত একটু আগুন দরকার ।
একটু কাছাকাছি যেতেই তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন ।
অবিশ্বাস্য দৃশ্য ! সবুজ অরন্যানীর পাতায় পাতায় আগুনের স্রোত । আগুনের কোন স্ফুলিঙ্গ মাটিতেও পড়ছে না । আর আগুনে গাছের কোন পাতা পুড়েও যাচ্ছে না । বরং মনে হচ্ছে এরা অগ্নিস্নান করছে । স্নানের পরে বৃক্ষের গায়ে ফুটে উঠছে আলাদা এক সৌন্দর্য ! ব্যাখ্যাতীত রূপ !
মুসাফির কিছু ডালপালা হাতে জড়ো করে সেখান থেকে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করলেন ।
কিন্তু আগুন ডালকে না পুড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল । তিনি ভয় পেয়ে পিছনে সরে গেলেন । এমন সময় অদৃশ্য এক আওয়াজ তিনি শুনতে পেলেন, ‘ইয়া মূসা !...’
অনুগল্প শেষ । কাহিনী আর সামনে এগোচ্ছি না । কারন তাহলে অনুগল্প হয়ে যাবে ‘ছোটগল্প’ ।
যিনি ‘ইয়া মূসা’ বলে ডাক দিয়েছিলেন তিনি স্বয়ং ঈশ্বর ! এই ঘটনা আমার নিজের তৈরী করা না । কুরআনে সূরা আত ত্বোয়া-হা’তে এই ঘটনার চমৎকার বিবরন আছে । বাইবেলেও এর উল্লেখ আছে তবে, বর্ণনাভঙ্গী বেশ সফিস্টিকেটেড । উদাহরন দেইঃ
LORD : I will also do this thing that you have spoken; for you have found grace in My sight, and I know you by name.
Moses : Please, show me Your glory !
LORD : I will make all My goodness pass before you, and I will proclaim the name of the LORD before you. I will be gracious to whom I will be gracious, and I will have compassion on whom I will have compassion. But you cannot see My face; for no man shall see Me, and live. Here is a place by Me, and you shall stand on the rock. So it shall be, while My glory passes by, that I will put you in the cleft of the rock, and will cover you with My hand while I pass by. Then I will take away My hand, and you shall see My back; but My face shall not be seen.
(Exodus 33:17-23)
এখানে সবচে’ বেশি কৌতুহল জাগায় এই লাইনটিঃ But you cannot see My face; for no man shall see Me, and live. অর্থ্যাৎ কোন জীবিত প্রানী ঈশ্বরের মুখ দেখতে পারবে না ।
বাইবেলের তিমোথিতেও এই ধরনের বর্ণনা এসেছেঃ
“He who is the blessed and only Sovereign, the King of kings and Lord of lords, who alone possesses immortality and dwells in unapproachable light, whom no man has seen or can see. To Him be honor and eternal dominion! Amen.” (1 Timothy 6:15-16)
এখানে সবচে’ লক্ষ্যনীয়ঃ dwells in unapproachable light কথাটা ।
ঈশ্বর এমন আলোর মধ্যেই বাস করেন যে আলো জীবের চোখে ধরা সম্ভব না । জীব বলতে প্রথমে মানুষের কথাই ধরা যাক । মানুষ কোন ধরনের আলো চোখে দেখতে পারে না ?
ম্যাক্স প্লাংক বা আইনস্টাইনের মত মানুষদের কারনে আমরা এখন জানি, আলো আসলে ‘ফোটনের ঝাঁক’ ছাড়া আর কিছুই না । ফোটন আবার কখনো তরঙ্গ, কখনো কণা (কোয়ান্টা) ! আমাদের চেনাজানা তরঙ্গগুলোর একটা তালিকা করিঃ
তরঙ্গের কত ক্ষুদ্র জায়গাটুকু যে আমাদের চোখে দৃশ্যমান তা উপরের চিত্রটি থেকেই বোঝা যাচ্ছে । ধরে নিলাম, আমরা ট্রিকস্ করে ইনফ্রা-রেড অঞ্চলের কিছু তরঙ্গও দেখতে পারছি (এখানে কেউ কেউ তীব্র আপত্তি জানাতে পারেন, তাদের জন্যঃ কিভাবে ইনফ্রা-রেড আলো দেখবেন লিংক দিয়ে দিলাম) ।
তারপরেও তরঙ্গের বিশাল একটা জায়গাই কিন্তু বাইবেলের ভাষায় Unapproachable !
এবার মানুষ ছাড়া অন্যান্যদের কথা ভাবা যাক ! আপনার কি মনে হয়, সব জীবের চোখে পৃথিবী একই রকম ? একটা পিঁপড়ার কথাই ধরি । সে মানুষের নখের সমানও না । সে কিভাবে পৃথিবীকে দেখে ? আমাদের মতই ? তাদের চোখ কিরকম ? নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুনঃ
মানুষ তার ৫৭৬ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরার সমান ক্ষমতার চোখ দিয়ে পৃথিবী যেভাবে দেখতে পায়, তা চিত্র ‘ক’-তে দেখা যাচ্ছে । মানুষের দৃষ্টির ক্ষেত্র বেশ বড়, প্রায় ১২০ ডিগ্রীর মত প্রশস্ত । যদিও আমাদের হাই রেজুলেশনের দর্শনক্ষমতা শুধুমাত্র দৃষ্টিক্ষেত্রের মাঝখানের অঞ্চলটুকু জুড়ে ! এটাকেই আমরা দুচোখ দ্রুত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাদের মাপ-মতো করে নেই ।
বললে অবাক হবেন, পিঁপড়ার আনুভূমিক দর্শনের ক্ষেত্রের বিস্তৃতি প্রায় ৩৬০ ডিগ্রী ! কিন্তু রিজোলিউশন এতোই কম যে পিঁপড়ার চোখ দিয়ে যদি আমরা ‘ক’-চিত্রটিকে দেখতে চাই তাহলে তা দাঁড়াবে অনেকটা ‘খ’-চিত্রের মতন । বেশীরভাগ পিঁপড়ার যৌগিক চোখে সেন্সরের সংখ্যা যথেষ্টই কম থাকে । খালি রিজোলিউশনের দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় বেচারারা কখনো নক্ষত্র দেখতে পায় না !!
আরো পরিষ্কার কিছু উদাহরন দেই । সন্ধ্যাফুলকে একজন মানুষ দেখবেন গ-চিত্রের মতন, কিন্তু বেশীর ভাগ পতঙ্গ এটিকে দেখবে ঘ-চিত্রের মতনঃ
অথবা Wood anemone এর কথা ধরলেঃ
আসলে কোন রঙটি ফুলগুলির আসল রং ? আমরা যা দেখছি নাকি বেশীরভাগ পতঙ্গরা যা দেখছে ? এক্ষেত্রে পাঠকদের একটু কনফিউজ করবার লোভ সামলাতে পারছি না । বেশীরভাগ পতঙ্গেরই রং দেখবার ক্ষমতা মানুষের দৃশ্যমান বর্ণালীর চেয়ে বেশী ! তাদের দৃশ্যমান বর্ণালী আল্ট্রাভায়োলেট (মৌমাছি) থেকে ইনফ্রা-রেডের (কিছু প্রজাপতি) ভেতর ঘোরাফেরা করে ! পতঙ্গদের ভেতর যাদের পাখা আছে তাদের দর্শনক্ষমতা বেশী ।
এদের চোখ প্রতি সেকেন্ডে ৩০০’র মত ফ্রেম তৈরী করতে পারে ! এদের যৌগিক চোখের ভেরিয়েশনও চমকপ্রদ । অ্যাপজিশন, সুপারপজিশন, মাল্টিফেসেটেড, রঙধনুর মত চিত্রাভ কর্নিয়া আরো কত কি ! ছোট্ট মস্তিষ্কে যুক্ত হওয়ার মতো অসংখ্য দারুন উন্নত ইমেজ প্রসেসর আছে এদের অপটিক লোবে,... ।
মাছির ওমাটিডিয়ামের কথা ধরা যাক । দর্শনানুভূতি সৃষ্টির একক প্রায় ৩০,০০০ ওমাটিডিয়া নিয়ে এদের চোখ । যাদের প্রত্যেকটির থাকে একটি করে লেন্স আর আলোকপ্রবন কোষের একটি গুচ্ছ ! বাংলায় ‘মাছি-মারা’ নামের বাগধারায় ‘অতি তুচ্ছ কাজ করা’ বোঝালেও এই কাজ যে কত শক্ত তা কেবল যে মাছি মেরেছেন সেই জানেন ।
মাছিদের বড় অস্ত্র এদের ৩০,০০০ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চোখ যা এদের মাথাকে হেলমেটের মত করে ঢেকে রাখে । ভাল কথা, তেলাপোকারও কিন্তু ওমাটিডিয়াম জাতীয় চোখ । মানুষের সাথে এদের চোখের পার্থক্য কেবল এতোটুকু ওরা কম আলোতে ভালো দেখে আর আমরা স্পষ্ট আলোতে । যদিও প্রজাপতির কথা ভিন্ন । এরা মানুষের মত রং চিনে রাখতে পারে তো পারেই, কম আলোতেও ঠিক-ঠিক ঐ রং চিনে নেয় ।
এদের এইসব শক্তিশালী চোখকে তুচ্ছ করা কি ঠিক হবে ? এমনও তো হতে পারে এদের চোখে দেখা রংটাই ঠিক, আমাদেরটা ভুল ! আসুন একটা পরীক্ষা করি ! নিচের ছবিটা ভাল করে দেখুনঃ
বলুন তো ‘A’ অংকিত বর্গটা বেশী গাঢ় নাকি ‘B’ অংকিত বর্গ ? আমি নিশ্চিত আপনি মনে মনে A-এর কথাই ভাবছেন । ভাবাটাই স্বাভাবিক । বোঝাই যাচ্ছে দাবার বোর্ডের মতন সজ্জিত ঘরগুলোতে A ধূসর বর্ণের ঘর এবং B শাদা বর্ণের । কিন্তু আমি যদি বলি আপনি ভুল ??? যদি বলি, দুটি ঘরের রং একই !
জ্বি । আমি মিথ্যা বলছি না ।
দুটি ঘরকে আলাদা আলাদা রঙে দেখতে পাওয়ার কারন আমাদের মস্তিষ্ক । আমাদের রেটিনার ওপর যে দৃশ্য হতে আলো আসছে- সেই দৃশ্যটি প্রসেস করার জন্য মস্তিষ্কের অক্সিপিটাল লোব আমাদের অজান্তেই কাজ শুরু করে দেয় । অনেকটা আমাদের হার্টবিটের মত । আমাদের হাতে এর নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা নেই ।
বোর্ডের ওপর রাখা সবুজ রঙের সিলিন্ডারটির ছায়ার কারনে আমাদের মস্তিষ্ক আসল রঙ চিনতে কনফিউজ হয়ে যাচ্ছে; সে ছায়াটি সম্পর্কে তুলনামূলক আগে থেকে সচেতন হয়ে থাকছে ।
যার ফলে আমরা একই রং দুই রকম দেখছি । হাতেনাতে প্রমান পাওয়ার জন্য আমাদের কাজ হচ্ছে A ও B বর্গ দুটিকে সংযুক্ত করে দেয়াঃ
কি ? এখন মনে হচ্ছে এক ?? অনেকে ভাববেন এখানে আমি কোন ট্রিকস করেছি । হয়তো পিক্সেল বদলে দিয়েছি । একেবারেই না । প্রমান দিচ্ছি ।
উপরের ছবিতে যে সংযোজিত জায়গাটুকু নতুন টানা হয়েছে তার উপর বুড়ো আঙুল রাখুন । যেই মুহূর্তে আপনি বুড়ো আঙুল রাখলেন সাথে সাথে আবার রং দুটি আলাদা হয়ে গেল । A হয়ে উঠল গাঢ় আর B হালকা ।
আমাদের মস্তিষ্ক আসলে তার কল্পনাশক্তির কারনে একদিক থেকে যেমন প্রচন্ড শক্তিশালী, ঠিক একই কারনে প্রচন্ড দূর্বলও । বলা হয়ে থাকে সাধারনতঃ আমাদের মস্তিষ্কের মাত্র ৩-৪% এর বেশী আমরা কখনোই ব্যবহার করতে পারি না ।
আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম । তিনি নাকি তার ব্রেইনের ৯.৮ % পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন । এর কারন হচ্ছে আমাদের ব্রেইনের ল্যাটারাল সোকাস আইনস্টাইনের চাইতে ভিন্ন । আমাদের ৯৮% মানুষের ল্যাটারল সোকাস হয় এরকমঃ
আইনস্টাইনের ল্যাটারাল সোকাস ছিল কন্ধ-কাটা টাইপ । একারনেই তিনি স্মৃতিকোষ জাতীয় হিপোক্যাম্পাস বা ব্রেইনের চিন্তার এরিয়া প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশী ব্যবহার করতে পেরেছেন ।
আমাদের ব্রেইন আইনস্টাইনের তুলনায় কতটা অন্যরকমভাবে কাজ করে তা একটা পরীক্ষা করেই আমরা বুঝতে পারবো ।
আসুন আইনস্টাইন যে পরীক্ষাটি সফলভাবে করেছিলেন তা আমরা করতে চেষ্টা করি !
ধাপ-১ : জিহ্বা দিয়ে আপনি আপনার প্রত্যেকটি দাঁত স্পর্শ করবার চেষ্টা করুন । নিশ্চিতভাবে বলা যাবে আপনি সবগুলো দাঁত স্পর্শ করতে পারছেন না । যেকোন একটির ক্ষেত্রে গিয়ে আটকে যাচ্ছেন ।
ধাপ-২ : এই ধ্রুব সত্যিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে আপনি ইতোমধ্যেই একবার জিহ্বা দিয়ে দাঁত স্পর্শ করবার চেষ্টা করেছেন ।
তাই না ?
ধাপ-৩ : এবং আপনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন জিহ্বা দিয়ে আসলে সব দাঁত স্পর্শ করা যায় ।
ধাপ-৪ : আপনি এখন হাসছেন । হাহাহা । কারন আপনি বুঝে ফেলেছেন যে অজান্তেই আপনি বোকামি করে ফেলেছেন ।
দুঃখিত ।
সস্তা ধরনের একটা রসিকতা করে ফেলেছি । এখন নিচের ছবিটি ভালভাবে লক্ষ্য করুনঃ
আপনি কি ছবিটিতে কোন ‘ডট’ খুঁজে পাচ্ছেন ? বেশীরভাগ মানুষই নিচের ছবিটি দেখে ডট-জাতীয় কিছু পায় না । আপনি যদি ‘ডট’ জাতীয় কোন সাইন খুঁজে পেয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে,... ...আপনার কম্পিউটার বা ল্যাপটপের স্ক্রীনটি নোংরা... হাহাহা । দুঃখিত এটিও সস্তা রসিকতা হয়ে গেল । আসলে দামী কোন রসিকতার আইডিয়া মাথায় আসছে না ।
ও আচ্ছা । হ্যাঁ । একটা মনে পড়েছে । শুরু করি । দেখি আপনি কত তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারেন ! বলুনতো, কোন জিনিসটা লাল এবং প্যাঁ-পোঁ-প্যাঁ-পোঁ শব্দ করে চলে ??
কি ? মনে মনে ভেবে নিয়েছেন ? কিন্তু, পারলেন না তো এটা হচ্ছে একটা অ্যাম্বুলেন্স ।
এবার আপনি চিন্তায় পড়ে গেলেন । অ্যাম্বুলেন্স লাল কি করে হয় ? আরে ভাই, লাল বলেছি আপনাকে বিভ্রান্ত করবার জন্য ! হাহাহা । আচ্ছা আর বিভ্রান্ত করবো না । এবার বলুন, কোন জিনিসটা লাল এবং প্যাঁ-পোঁ-প্যাঁ-পোঁ শব্দ করে চলে ?? কি ? ভাবা শেষ ? এবারও তো পারলেন না !! এটা হচ্ছে একটা টমেটো । এবার ‘প্যাঁ-পোঁ-প্যাঁ-পোঁ’ বলেছি আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য ! হাহাহাহাহা ।
আচ্ছা ! আচ্ছা ! এইবার ফাজলামি না । এবার সত্যি সত্যি বলেন, কোন জিনিসটা লাল এবং প্যাঁ-পোঁ-প্যাঁ-পোঁ শব্দ করে চলে ?? কি ? ভেবেছেন । উঁহু । এবারও ভুল ভেবেছেন এটি হল একটা গরু । এবার লাল আর ‘প্যাঁ-পোঁ-প্যাঁ-পোঁ’ দুটোই বলেছি আপনাকে বিভ্রান্ত করবার জন্য ।
আচ্ছা ঠিক আছে । অনেক ফাজলামি হয়েছে । এবার বলুনঃ
কোন জিনিসটা লাল এবং প্যাঁ-পোঁ-প্যাঁ-পোঁ শব্দ করে চলে ??
হাহাহা । কি মাথা নাড়ছেন ? আরে ভাই ! এটা হচ্ছে একটা ফায়ার-ব্রিগেডের গাড়ি । আপনি কি এবারেও ভাবছিলেন আমি ফাজলামি করছি ?
(চলবে)
ছবি সংগ্রহঃ উইকিপিডিয়া
চক্ষে আমার তৃষ্ণা: প্রথম পর্ব
চক্ষে আমার তৃষ্ণা: দ্বিতীয় পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।