এ বছরের শুরুর দিকে স্বল্প ব্যয়ে সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের কেস-স্টাডি নিয়ে সিরিজ লিখতে গিয়ে দিনা বালাবানোভা এবং তাঁর সহকর্মীরা উপসংহার টেনেছেন, “বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে প্রভূত উন্নতি করেছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশেই সর্বাধিক গড় প্রত্যাশিত আয়ু, সর্বনিম্ন ফার্টিলিটি-রেট এবং সর্বনিম্ন শিশু-মৃত্যুহার, যদিও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম।
চীন, ভারত, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশ্লেষণ প্রকাশ করার পর আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ। আমাদের উদ্দেশ্য- বিশ্বস্বাস্থ্যের একটি বড় রহস্যের তদন্ত। এ শুধু অস্বাভাবিক সাফল্যের গল্প নয় নয়, এ গল্পে রয়েছে দুর্বলতা এবং প্রতিকূলতার কথাও।
দেশটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (Universal Health Care)-র দিকে অগ্রসর হতে গেলে এগুলো অতিক্রম করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি কী? প্রথমত, ইতিহাস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার বিভীষিকা ও গণহত্যা মানুষকে এক জাতীয় নবজাগরণের উন্মেষ ঘটাতে বাধ্য করেছিল। একটি সামাজিক রূপান্তরের সূচনা ঘটেছিল। অধিকাংশ দেশেই স্বাস্থ্যসংস্কার ঘটেছিল কোন না কোন আদর্শিক পরিকল্পনার কাঠামো অনুসারে।
কিন্তু এর পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার বহুমুখী উদ্যোগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলেছিল। এর অংশীদার হিসেবে NGO এবং বেসরকারী বিকশিত হবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। এই বহুমুখী উদ্যোগের ফলে সব গুলিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এই ল্যানসেট সিরিজ দেখাচ্ছে যে, এই বহুমুখীতার ফল ইতিবাচক। সরকারের সদিচ্ছা এবং সেবাদানের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রতি নমনীয়তা স্বাস্থ্যখাতে দ্রূত উন্নতির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
দ্বিতীয়ত, গবেষণা। একটি প্রতিষ্ঠান- ICDDR,B পরিবার-পরিকল্পনা, টিকাদান এবং ডায়রিয়ার চিকিৎসায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে, উদ্ভাবনের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশে। টিকাদান-কর্মসূচী, এলাকাভিত্তিক সাস্থ্যসংক্রান্ত জরিপ, মাতৃস্বাস্থ্য এবং যক্ষ্মার চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের কার্যকারিতার মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। এসব গবেষণা থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য নির্ভরযোগ্য জ্ঞান অর্জিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, সাম্য। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহজাত দক্ষতার কারণে সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগ এবং অংশগ্রহণের ফলে দেশের গবেষণালব্ধ ফল ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ দারিদ্র্য-বিমোচন ও নারীর উন্নয়নে অগ্রদূতের ভূমিকা রেখেছে। ক্ষুদ্রঋণ এবং শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে নারীর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণ নিশ্চিত করা হয়েছে। সামষ্টিকভাবে এই উদ্যোগগুলোর ফলেই স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
একইসাথে নারী-পুরুষ-বৈষম্যও হ্রাস পেয়েছে।
সবশেষে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের উন্নয়নে শুধু সৃজনশীলতা আর জনগণের ক্রমাগত প্রচেষ্টাই নয় বরং বৈদেশিক সাহায্যও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান। এখনো মান-নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান নিম্নমানের, দুর্নীতি বহুলাংশে ব্যাপৃত এবং নির্দিষ্ট কিছু স্থানে অপ্রতুলতা রয়েই গেছে।
বাংলাদেশ অন্যান্য দেশকে কী শিক্ষা দিতে পারে? জনগণের সমবায়ভিত্তিক অংশগ্রহণ, নারী-পুরুষের সাম্য, এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যের জন্য প্রচেষ্টা অন্যান্য স্থানেও বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে যক্ষ্মার চিকিৎসা। কম্যুনিটি হেলথ ওয়র্কারদের মাধ্যমে বাংলাদেশ যক্ষ্মার চিকিৎসার নিশ্চয়তা এবং ৯০% এর বেশি আরোগ্যের হার অর্জন করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ইতোমধ্যেই এইচ,আই,ভি এবং যক্ষ্মার চিকিৎসায় এই মডেল অনুকরণ করেছে।
বাংলাদেশের সাফল্যের অনেকটাই “সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” পূরণ করাকে কেন্দ্র করে।
যাহোক, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুদের অপুষ্টি, এবং প্রাথমিক চিকিৎসার প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে সাফল্যের ভাগ তুলনামূলকভাবে কম। একটি ক্ষুদ্র দেশে বিপুল জনসংখ্যা, চরম দারিদ্র্য, অসমতা ইত্যাদি নিয়ে ভবিষ্যৎ-উড্বেগ অত্যন্ত গভীর। শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে ওবেসিটি বা মুটিয়ে যাবার প্রবণতা মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করেছে। অনিয়ন্ত্রিত, নিম্নমানসম্পন্ন এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারদের ঢালাও উৎপাদনও বর্তমানে দুশ্চিন্তার কারণ।
এই সিরিজের শেষ নিবন্ধে স্বাস্থ্যখাতে উদ্ভাবনার দ্বিতীয় জোয়ার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা স্থান পাবে।
এর উদ্দেশ্য হবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জানুয়ারি, ২০১৪ তে জাতীয় নির্বাচন। জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রূত নগরায়ণ, দারিদ্র্য, অসাম্য এবং নিম্ন জীবনযাত্রার মান ও আয় – ইত্যাদি প্রধান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের মানুষ অতীতে সৃজনশীলতা, অপ্রতিরোধ্যতা এবং শক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের এই ধারা ভবিষ্যতেও ধরে রাখতে হবে।
[ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, কুদরত-এ-খুদা –সবারই স্বপ্ন ছিল মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে মাতৃভাষার ব্যবহারে এখনো অনেকেই লজ্জা পান বা বিদ্রূপ করেন। আমার এক সিনিয়র ভাই বাংলায় ডেভিডসনের মেডিসিন বইটি অনুবাদ করেছিলেন বলে ছাত্রদের অনেকেই তাঁকে ঠাট্টা করত। যেন বেচারা কোন মহাপাপ করে ফেলেছে! এই চর্চা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ল্যানসেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আমি অনুবাদের চেষ্টা করেছি। ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
মূল প্রবন্ধের লিঙ্ক এখানে http://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736%2813%2962294-1/fulltext?elsca1=ETOC-LANCET&elsca2=email&elsca3=E24A35F#]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।