আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ আবেগহীন আবেগ

আমার লেখা জুড়ে আমার ভালবাসা ছাড়া আর কিছু নেই।

বাম হাতে একটা রুটির প্যাকেট, ডান হাতে সেই ছোট জিনিসটা। পিছনে পিছনে কুকুরটা এখনও আসছে। থেমে গেলে রাশেদ, কুকুরটাও থেমে যায়। আর হাঁটতে শুরু করলে কুকুরটাও।

কি বিপদ? রুটি থেকে একটু ছিঁড়ে , কুকুরের দিকে দিয়ে বলল, নে খা। যা যা। পিছনে আসবি না।
কুকুরটা রুটি শুকে নিয়ে ,আবার হাঁটা শুরু করল রাশেদের পিছনে। রাশেদ পিছন ফিরে বলল, কি আজব! মানুষে আমারে তো কেউ পছন্দ করে না।

তোর কেন আমাকে এতো পছন্দ। যা তো? কি চাস তুই?


কুকুরে মানুষের কথা বুঝে না। বুঝলেও সেই বুঝ, মানুষকে বুঝাবার সাধ্য নেই। কিন্তু রাশেদ একটু পর পর এই কুকুরটার সাথে কথা বলছে। তাড়াতে চাচ্ছে।

যাচ্ছে না। এই কুকুরটা রাশেদের পরিচিত না। তবে সেই কখন থেকে , পিছন পিছন হাঁটছে। রাশেদ পিছন ফিরে আবার বলল, কিরে? তোর কি বউ বাচ্চা নাই? রাতের বেলা তাদের একটু সময় দিবি। তা না করে আমার পিছনে ঘুরতেছিস।




কুকুরটা চুপ করে রাশেদের কথা শুনে। ঘেউ ঘেউ করে না। রাশেদ পকেট থেকে একটা পয়সা বের করে, নে, বাচ্চারে একটা চকলেট কিনে দিস। তোরা কি চকলেট খাস? খাস না বোধহয়। বাদ দে তাইলে।

এইটা দিয়া আমি বিড়ি খাব। তুই কি বিড়ি খাস? তোর ঠোঁট তো কালা। দেইখা মনে হয় খাস। যাহ, ধূমপায়ী আমার পছন্দ না। তুই আর পিছনে আসবি না।




রাশেদ রুটির দিকে তাকাল একবার। আর একবার হাতের ছোট জিনিসটার দিকে। দুটোই বউটার জন্য। দিনা নাম বউটার। সকাল থেকে খায় নায় কিছু।

এইটুকুতেই হবে তবু। খুশি হবে অনেক। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে রাশেদ বলল, জানিস এগুলো কার জন্য? তোর ভাবির জন্য। তুই আমি একই রকম। মাঝে মাঝে তোরে যেমন লোকে, কুত্তা ডাকে।

আমারও মাঝে মাঝে নিজেরে কুত্তা মনে হয়। তাই তোরে ভাই বানাইলাম। তো শোন, তোর ভাবির নাম দিনা। বিয়ে হল, প্রায় ৬ বছর হইছে। তোর তো বউ আছে।

তোদের বিয়ের বয়স কত? যাহ তোরটা জেনে লাভ নেই। আমারটা শুন। বউটারে অনেক ভালবাসি আমি। এতো ভালবাসি তোরে বুঝাতে পারব না। বউটা অনেক সুন্দর রে আমার।

দেখলে খালি তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। বউ আমার মেট্রিক পাস। আমিও কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হইছিলাম। পরে আর পড়ি নায়। যাই হোক, তোরে যা বলতেছিলাম।

এই দেখ, রুটি, বউটার জন্য। আর এইটাও বউয়ের জন্য। খুব খুশি হবে ও। কয়দিন ধরে খায় না কিছু। আমার বউটা আমারে এতো পছন্দ করে, জানিস? আমার এটা একদম ভাল লাগে না।

আমি চাই বউটা আমার আমারে একটু ঘৃণা করুক। সবার মত।


চোখ ভিজে আসছে রাশেদের।
- যা তো তুই। তোরে ভাল লাগতাছে না।




রাশেদ আবার হাঁটা শুরু করল। পিছনে পিছনে কুকুরটা। রাশেদ চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না। এই আঁধারে ঐ কুকুরটাকেও না। চোখের পানি পড়ছে, আর রাশেদের মুখ জ্বালা করছে।

মনে হচ্ছে মুখ, গাল, পুড়ে যাচ্ছে। অন্য কারও এই সমস্যা হয় না। রাশেদের কেন হয়? চোখ দিয়ে পানি পড়বে, চোখ জ্বলবে। মুখ কেন?


রাশেদ আবার কুকুরটার দিকে গিয়ে বলল, শোন, তোরে কেন যেন, আমার ছেলেটার কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে। তোর কি ছেলে আছে? সন্তান বড় ভালবাসার জিনিস রে।

আমার ছেলের নাম নাশিদ। দেখ তো কি অবস্থা। বউ এই নাম রাখল, আমার সাথে মিল কইরা। এতো খুশি হইছিলাম, ছেলেটা হওয়ার পর। সারাদিন কোলে নিয়া বইসা থাকি।

আমার বুকের উপর নিলেই প্রসাব কইরা দিত। ২ দিন তো মুখের ভিতর। ছিঃ ছিঃ। তাও খারাপ লাগে না। হাগু করলে আমিই পরিষ্কার করতাম।

বউয়ের কিছু করা লাগে না। ছেলেটারে নিয়া বাজারে যাইতাম, যখন একটু একটু হাঁটতে শিখছে। গুলগুলি কিনে দিতাম। গুলগুলি চিনিস? মিষ্টি লাগে,খাইতে। গোল গোল করে,তাই গুলগুলি বলে।

ছোট ছোট দাঁত দিয়ে, কুট কুট করে চাবাইয়া খাইত। সামনের দাঁত দিয়ে। দেখতে যে কি সুন্দর লাগত। হাহা। জানিস, আমার ছেলেটার দাঁত উঠার পর, আমি মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলতাম, আব্বু কামড় দাও তো হাতে।

আমার নাশিদ আব্বু কামড় দিত হাতে। কামড় খেতে এতো ভাল লাগে জানতাম না। পোলার যখন ৪ বছর বয়স, তখন আমার শরীরে এগুলা উঠল। দেখ কত বড় বড় ফোঁড়ার মত। কি বিচ্ছিরি।

কি ব্যথা। কি খারাপ লাগে। পুরা শরীরে ক্ষত। কত ডাক্তার দেখাই, কাজ হয় না। কেউ মিশতে চায় না।

তবুও বউটা আর ছেলেটা দূরে যায় নায়। ছেলেটা তাও আমার বুকের উপর এসে বসে থাকে। খুব কষ্ট লাগে, ব্যথা হয়,তবে যখন নাশিদ এসে বসত বুকের উপর, বসে আমার এই নোংরা শরীর জড়িয়ে ধরত, খুব ভাল লাগত। মনে হত কত সুখ, সব কষ্ট শেষ আমার। আবার আমিই ওরে সরিয়ে দিতাম।

আমার থেকে যদি আবার ওর অসুখ হল। আমি কাজ করতে পারি না। উপার্জন করি না। ছেলেটারে আর গুলগুলিও খাওয়াতে পারি না। প্রায় দিন নাশিদ এসে,বুকের উপর শুয়ে বলত, আব্বু গুলগুলি খাব।

কিনে দিতে পারতাম না। বউটা কই জানি কাজ করত, কোনমতে ২ বেলা খাইতে পারি ভর্তা মরিচ দিয়া। এখন, গুলগুলি কিনব কি দিয়ে? ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হত। গাল বেয়ে পানি পড়ত, আর জ্বলত গাল। এই যে পচা শরীর, এখানে পানিও লাগাতে পারি না।

খুব জ্বলে। নাশিদের বড় কষ্ট হয়, বউটারও। আমিই খালি রাক্ষসের মত ভর্তা, মরিচ যা আছে, তা দিয়া খাইতাম, গুপ গাপ। কয়দিন আর বাঁচব। খেয়ে নেই আগে।

বউটা খেতে পারে না। নাশিদও বলে ঝাল লাগে। কয়দিনেই ছেলে আমার শুকিয়ে শেষ। অযত্নে মুখের দিকে তাকাতে পারি না। সারাদিন ক্ষুধায় কান্দে।

আমি কাজ করতে পারি না। বউটাও মাঝে মাঝে পায় কাজ। তাতে চলে না। ছেলের কান্না আমার সহ্য হয় না। অসুস্থ ছেলেরে দেখতেও মন চায় না।

একদিন বউ কাজ খুঁজতে বাহিরে গেছে, ছেলেরে নিয়ে আমিও বের হলাম। লোকে আমার দিকে কিভাবে যেন তাকায়। আমি ছেলেটারে নিয়ে রাস্তার পাশে শুয়ে পড়লাম। নাশিদ কান্না করে করে বলে, ২ ডা টাকা দেন। আমার আব্বায় খুব অসুস্থ।

কয়দিন কিছু খাই না। বিকেলের দিকে, দেখি ভালই টাকা হইছে। টাকা দিয়ে খাবার কিনে ঘরে আসলাম। ছেলেটারে ভিক্ষুক বানিয়ে, ভালই উপার্জন হল। ভাবলাম, এখন থেকে এই কাজ করব।

কিন্তু রাতে দিনার কাছে সব বলে দিল নাশিদ। দিনা আমার দিকে, খুব রাগী চোখে তাকায়। অনেক কিছু বলে। আর যেন নাশিদকে দিয়ে এগুলা না করাই তাও মানা করে দেয়। খুব রাগ হয় সেদিন নাশিদের উপর।

রাতে কিছু বলি না। সকালে উঠে অনেক জোরে একটা থাপ্পড় মারি, গালে। নাশিদ কাঁদে। আমার আদরের ছেলেটা কাঁদে। আমার মায়া হয় না।

আমি হাত ধরে বলি, চল ভিক্ষা করবি। নাশিদ যেতে চায় না। এতোটুকু ছেলে এতো জেদ। আমার মেজাজ খারাপ। দিলাম এক বারি মাথায়, হাতের কাছের পেপার ওয়েটার দিয়ে।

মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। আমি তাকিয়ে দেখছি। ছেলে আমার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কাঁদতে পারছে না। শুধু তাকিয়ে আছে।

আমি তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে কোলে, কাঁদতে লাগলাম। আমি কি করলাম এটা? চিৎকার করে কাঁদছি। মাথায় চেপে ধরে রক্ত থামাতে চাচ্ছি। থামে না। ডাক্তারের কাছে নিয়া গেলাম।

ডাক্তার আমারে দেইখা কেমন জানি করে। শেষে ভর্তি করল হাসপাতালে। এর পর থেকে ছেলেটা কেমন জানি হয়ে গেছে। আমার বউ তারে, বাপের বাড়ি রেখে আসল। আমি বলি, দিনা তুমিও চলে যাও।

সে যায় না। আমি এতো খারাপ তাও আমার সাথে থাকে। আমার ভাল লাগে না এতো ভালবাসা।

হাউ মাউ করে কাঁদছে রাশেদ। আর বলছে, খুব ইচ্ছা করে ছেলেটারে দেখতে।

ছেলেটা আমার কাছে আসে না। খুব ইচ্ছা করে একটু বুকের উপর উঠে বসুক। একটু জড়ায়ে ধরুক। তাও করে না। কষ্ট লাগে খুব।

খুব কষ্ট। এই কষ্ট কাউকে বুঝানো যায় না।


হাঁটতে হাঁটতে আবার থেমে গেল রাশেদ। বউটার কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছে। বউটার শরীরেও এই অসুখ হইছে।

বড় যন্ত্রণা। কোন ওষুধ নাই। বিছানায় পরে কাঁদে। রাশেদের পাশে তবু থাকে। সে কোথাও যাবে না।

এই কষ্টের মাঝেও কোথা থেকে ভালবাসা পায় জানেনা। কিছু সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায় না। ভালবাসার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। কখন মনের কোণে কি খেলা করে বুঝতে পারাটা কঠিন। ভালবাসার প্রকাশ কখন কিভাবে হয়, খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য।

রাশেদ আর একবার তাকাল। বাম হাতে, রুটির প্যাকেট। ডান হাতে ছোট্ট জিনিসটা। একটা বিষের বোতল। অনেক কষ্টে জিনিস দুটো যোগাড় করেছে।

বউটার জন্য। কয়েকদিন ধরে খায় না। তাই রুটিটা পেলে খুশি হবে খুব। রুটির উপর একটুখানি বিষ ঢেলে দিবে। ক্ষুধা মিটে যাবার পর, আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে।

অনেক শান্তি পাবে। বউটার কষ্ট যে আর সহ্য হয় না রাশেদের। বড় ভালবাসে বউটাকে। কুকুরটা এই বিষের বোতলটা হাতে নেবার পর থেকে, পিছনে পিছনে আসছে। হয়ত কিছু মানা করছে, কিছু বুঝাতে চাচ্ছে।

সব ভাষার সবটুকু সবাই বুঝে না। সব ভালবাসার ভাষাও সবাই জানে না। বুঝতে পারে না। রুটিটা খেয়ে যখন, দিনা চরম ঘৃণার চোখে রাশেদের দিকে তাকাবে, চরম ঘৃণায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, এটাই রাশেদের কাছে অনেক বড় ভালবাসা। রাশেদের চোখের সামনে বউটা কষ্ট পেয়ে যাক, রাশেদ চায় না।

ধীর পায়ে হাঁটছে রাশেদ। আর একবার ভেবে নিল রাশেদ, একটু দ্বিধায় পড়েছে। বিষের বোতলটা কুকুরটার দিকে ফেলে দিয়ে, কষ্ট ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকবে। নাকি রুটির উপর বিষ দিয়ে, বউটাকে শান্তি দিয়ে, নিজের ভালবাসা দেখাবে। একটু স্বার্থপর হবে।

নাকি বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরবে দিনাকে। কুকুরটার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চাচ্ছে। কিন্তু সব ভাষা সবাই বুঝে না। সব ভালবাসাও না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।