আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাঞ্জেরী, মানুষ হতে আর কত দেরী?

এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই সময়টা, সেই ভয়াবহ সময়টা। সবে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। অক্টোবরের ১ তারিখ। সনটা ২০০১। ১৯৩ আসন নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে জয় লাভ করেছে।

অন্যদিকে মাত্র ৬২ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ তখন লুকিয়ে আছে। দেশে একটা থমথমে পরিবেশ। একদিকে বিএনপি উল্লাস করছে, আর অন্য দিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসছে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বর্বরোচিত হামলার।

বিস্মিত হতে হয়েছিল এটা দেখে যে পরবর্তী এক সপ্তাহ কোন বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট বা সুশীল এ বিষয়ে মুখ খোলেন নি। আক্রমণের তীব্রতা বাড়তে থাকে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ভিটা-জমি জলের দামে বিক্রি করে পাড়ি জমাতে শুরু করে প্রতিবেশী দেশে। যারা পারছিল না, তাদের হতে হচ্ছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত। লুণ্ঠন আর ধর্ষণের জনপদে পরিণত হয়েছিল সোনার বাংলা। আজও আমার শরীরে কাঁটা দেয় ঐ হিন্দু বাবার আকুতি,
সময়টা ২০১৪। আবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

এবার বিএনপি নির্বাচনে আসেই নি। কিন্তু নির্বাচন শেষ হবার সাথে সাথে শুরু হলো একই ধরনের হামলা। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা খবর দিতে লাগলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কোথাও কয়েক দিনের কোলের বাচ্চাকে নিয়ে মা পালাচ্ছে, কোথাও হত-দরিদ্র মহিলার কোনক্রমে টিকিয়ে রাখা বাড়িটাকে গুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা, আবার কোথাও হামলার তীব্রতায় টিকে থাকতে না পেরে এবং আরও ভয়াবহতার কথা ভেবে সর্বস্ব ফেলে রেখে হিন্দু পরিবারগুলো পালিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দিকে। সময় পেরিয়েছে কিন্তু বাস্তবতা এতটুকু বদলায় নি।


একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক এবার। ভারতের প্রবীণ নেতা জ্যোতি বসুর আত্মজীবনী ‘যতদূর মনে পড়ে’তে তিনি লিখেছিলেন,
হ্যাঁ, তখনও-এখনও। এই দাঙ্গা এবং হামলার পেছনে কাজ করে রাজনৈতিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা। ১৯৪৬-৪৭ সনের ঐ সময়টা পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব সহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। আর সেই দাঙ্গার সুযোগ নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর কখনও প্রতিশোধ, আবার কখনও স্বার্থ উদ্ধারের খেলায় মেতে উঠেছিল।

সাংবাদিক হারুন হাবিবের লেখা একটা প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে ১৯৪১ সনে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল ২৮ শতাংশ। যদিও লেখক সূত্র উল্লেখ করেন নি কিন্তু পরে খোঁজ করে আমি দেখেছি তথ্যটা Census of India 1941 থেকে নেয়া। দাঙ্গা পরবর্তী দেশ বিভাগের পর এই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় ২২ শতাংশে। যদিও আরও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় এই সংখ্যাটা তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল। তবে তর্কের খাতিরে যদি আমরা ২২ শতাংশ ধরে নেই, তবুও দেখা যায় ১৯৪৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত আসতে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমে নেমে এসেছে ৯.৫ শতাংশে।

বাংলাদেশ ‘ব্যুরো অব স্ট্যাটেসটিকস’এর মতে ২০১১ সনে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.৫-এ। অথচ ঠিক এই সময়ে ভারত এবং ইসরাইলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। আরও গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান ধর্মের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাবার ঘটনা মূলত ঘটেছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেই শুধু।
স্বাভাবিক ভাবেই এ তথ্যগুলো যে কোন সচেতন মানুষকেই বিচলিত করবে। নিজের ভিটা-মাটি ছেড়ে অন্য দেশে দেশান্তরিত হবার ইচ্ছে একজন মানুষের মনে কখন আসতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

যখন কোন বাবাকে বলতে হয় “আমার মেয়েটা ছোট। তোমরা একজন একজন করে যেও” তখন দেশের টান বা ভিটার টান খুবই নগণ্য হয়ে যায়। বেঁচে থাকার তাগিদে ঐ মানুষগুলো তখন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী কমে যাবার ঘটনাটা যদি এক দিকের চিত্র দেখায় তাহলে অন্য দিকে রয়েছে ভয়াবহ আরও কিছু দৃশ্য। ২০০৪ সনে রাজশাহীতে বাংলা ভাই-এর উত্থান বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে জঙ্গিবাদের সূচনা করেছিল।

১ এপ্রিল ওসমান বাবু নামে ২৭ বছরের এক যুবককে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর একে একে ৩২ জন মানুষকে এক বছরের মধ্যে হত্যা করে বাংলা ভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমান। ত্রাস সৃষ্টির জন্য হত্যার পর লাশ গুলো উল্টা করে গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। ঠিক ওরকম সময়ে দৈনিক জনকণ্ঠের ফটো সাংবাদিক সেলিম জাহাঙ্গীর ঐ ভয়াবহ জনপদের এক বিরল সাহসী মানুষ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন যিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে একটা জিডি করেছিলেন। যদিও প্রথমে বলা হয়েছিল বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তাদের সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে জেএমবি ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়।

দিনটা ছিল ১৭ আগস্ট, ২০০৫। একই বছর ১৪ নভেম্বর তারা ঝালকাঠির সহকারী জেলা জজ সোহেল আহমেদ ও জগন্নাথ পাঁড়েকে হত্যা করে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের উপর এরকম আক্রমণ রীতিমত বাংলাদেশের অস্তিত্বের উপর আক্রমণ ছিল।
পরবর্তীতে বাংলা ভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমানকে বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি দেয়া হলেও তাদের আদর্শকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয় নি। আর সে কারণেই আমরা এখনও দেখি হুমায়ূন আজাদের মত মানুষকে চাপাতি দিয়ে কুপানো হয়, ব্লগারদের উপর আক্রমণ হয়, ব্লগার রাজীবকে সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে নির্লিপ্ত ভাবে সেটাকে ‘দ্বীনের দায়িত্ব পালন’ বলে উল্লেখ করে হত্যাকারী।

একই কারণে আমরা আজ দেখতে পাই বাংলার বুকে হেফাজতে ইসলামের উত্থান যারা দাবী করে দেশ থেকে তারা সমস্ত নাস্তিক নিধন করবে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে কতটা উদার হয়েছে সেটা বিচার করতে গেলে আমাদের পদে পদে হতাশ হতে হবে। উদারতার কোন লক্ষণ তো ছিলই না, বরং আমরা ক্রমেই একটা ধর্ম নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে ধর্ম হচ্ছে রাজনীতির বর্ম। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ভোটের রাজনীতি দশকের পর দশক নিত্য-নূতন রূপ নিয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে ধর্মকে রাজনৈতিক ভাবে অপব্যবহার করা যাবে না, সেখানে ধর্মই রাজনীতির সবচেয়ে বড় পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।

অনেকেই হয়তো জানেন না, আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে,
ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন,
বিলোপ করা হইবে।


এছাড়াও আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে,
অথচ আমরা দেখতে পাই হেফাজতে ইসলাম যখন ‘নাস্তিক’ মারার হুমকি দেয় তখন তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয় না; কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। বরং রাজনীতিবিদরা তাদের থেকে দোয়া নিতে যায়। হেলিকপ্টারে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের তাদের আনা-নেয়া করা হয়। হিন্দু ধর্মের মানুষদের দিনের পর দিন নির্যাতিত হতে দেখেও আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চুপ থাকে।

যেন এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। এভাবেই চলতে থাকবে। আপনি-আমিও তাই চুপ আছি।
কিন্তু আর কত দিন? আপনি যদি নিজেকে ‘মুসলিম’ ভেবে নিরাপদ থাকবেন ভাবছেন, তাহলে বলবো ভুল করছেন। ১৯৭১ সনে প্রথমে হিন্দু জনগোষ্ঠী দিয়ে হত্যা-ধর্ষণ শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়েছিল সবার উপর।

মনে রাখা জরুরী, সাম্প্রদায়িকতার বিষ যার মাঝে আছে, সে হিন্দু চেনে না, মুসলিমও নয়। সে বন্ধু চেনে না, শত্রুও নয়। তার কাছে তার চিন্তাই পৃথিবীর শেষ কথা। সেটা প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজনে মাকেও বলি দিতে পারে তারা। ‘পারে’-ই বা কেন বলছি? দেশ তো মা-ই।

তারা মাকে বলি দিচ্ছে। প্রতি নিয়ত।
তাই একটা সুন্দর এবং সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার শপথ আমাদের আজই নিতে হবে, এই মুহূর্তে। আসুন, হিন্দু বা মুসলিম না হয়ে মানুষ হই।

মানুষকে হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে বিচার না করে, মানুষ হিসেবে বিচার করি। আসুন, বাংলাদেশকে একটি সুখি এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি যেখানে সব ধর্মের সব মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং শান্তিতে বাস করবে। রাজনীতিবিদরা যদি সেই বাংলাদেশ গড়তে এগিয়ে না আসে, তাহলে চলুন আপনি-আমি মিলেই সেই বাংলাদেশ গড়ি। আপনার-আমার সমন্বিত শক্তি কিন্তু কম নয়, একে তুচ্ছ ভাবার কারণ নেই। আমাদের দেশপ্রেমই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাবে।

জয় বাংলা।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.