রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিক্ষাব্যবস্থার চরম বিপর্যয় ঘটছে। গত কয়েক মাসে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধে থমকে গেছে সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম। বারবার শিডিউল পরিবর্তন করে এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি, জেডিসি, পিএসসি ও ইবতেদায়ী পরীক্ষা শেষ হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বার্ষিক পরীক্ষার সূচি ছিল এক প্রকার লণ্ডভণ্ড। কোনো রকম কাটাছেঁড়া করে জোড়াতালি দিয়ে ওই পরীক্ষাগুলো শেষ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এর ফলে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
একের পর এক পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মারাত্দক বিঘ্ন ঘটে। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া না হওয়ার দোলাচলে তাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদিও এর মধ্যে অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র নিলর্জ্জভাবে ফাঁস হওয়াতে হয়তো ফল বিপর্যয় ঘটেনি। কিন্তু এর মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ বছর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কোর্স শেষ করতে হয়েছে।
ফলে হরতাল-অবরোধের কারণে নিয়মিত ক্লাস না হওয়াতে শিক্ষকরা তড়িঘড়ি করে কোর্স শেষ করতে বাধ্য হয়েছে। হাতে অল্প সময় পাওয়াতে শিক্ষকদের পক্ষে সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা প্রস্তুতি হিসেবে তারা বাছাইকৃত কিছু বিষয় পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই এবারের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে মৌলিকত্বের অভাব লক্ষণীয়। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রগুলোতে ওই সিলেকশন পাঠদানের আওতায় ফেলার আপ্রাণ চেষ্টার ছোঁয়া স্পষ্ট।
এভাবে হয়তো পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়া যায়। কিন্তু প্রতিটি শ্রেণীর সিলেবাস সম্পন্ন করা ছাড়া, সত্যিকার মেধা যাচাইয়ের উপযুক্ত প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন ছাড়া পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে তা শিক্ষার্থীর সামগ্রিক শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে তা এখন হয়তো অাঁচ করা যাচ্ছে না। ফলে ভবিষ্যতে একটি দক্ষ প্রজন্মের বদলে আমরা সনদধারী শিক্ষিত প্রজন্ম পাব; তখনই হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারব দুই দলের রাজনীতি রাজনীতি খেলায় পড়ে এই জাতির কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।
উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা এই দুর্বলতা কিছুটা হলেও হয়তো গৃহে বাড়তি প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ার মাধ্যমে দূর করতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানরা অথবা অজপাড়াগাঁয়ের শিক্ষার্থীরা যাদের পক্ষে প্রায় প্রতিদিন দুই বেলা খাবার জোগাড় করাই অসম্ভব; তাদের ওই অসম্পূর্ণ পাঠদান নিয়েই পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে হচ্ছে।
এ ধরনের খণ্ডিত শিক্ষাগ্রহণ যে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে অন্তরায় হবে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিন উৎসবমুখর পরিবেশে বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে এমনটিই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সংকটে নানা আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকেও শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া গেছে তাতেই স্বস্তিবোধ করেছি। কিন্তু শুধু নতুন বই তুলে দিলেই হবে না, আগামী দিনগুলোতে যেন ওই নতুন বই হাতে নিয়ে তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ের পাঠ্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে সরকার ও বিরোধী দলকে সে দিকটিও ভাবতে হবে। দুঃখের বিষয়, দশম সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের নামে দুর্বৃত্তরা কয়েকশ বিদ্যালয় পুড়িয়ে দিয়েছে।
নির্বাচন না শিক্ষা কোনটিকে তারা প্রতিপক্ষ ভেবেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
হরতাল-অবরোধে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজগুলোর মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা ছাড়াও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় বারবার পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করেও শেষ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের ফাঁদে পড়ে পরীক্ষা নিতে পারেনি। এর মধ্যে অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য হয়েই অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করেছে।
ঢাকা, জগন্নাথসহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে সমর্থ হলেও এখনো শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হয়নি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় হরতাল-অবরোধের মধ্যেই ভর্তিচ্ছুকদের বিভাগ বণ্টন করাতে বিপাকে পড়তে হয় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের। অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যথাসময়ে সাক্ষাৎকারে উপস্থিত না হতে পারাতে কোনো বিষয় না পেয়েই ঘরে ফিরতে হয়েছে। আবার অনেকের পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগও হয়নি। ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফলে মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েও সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকায় অভিভাবকের অনুমতি মেলেনি।
ফলে একদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসছে; অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবী শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিক্ষাবর্ষে যথাসময়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব না হওয়ায় সেশনজট মাথায় নিয়েই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু করতে হবে। এমনিতে ছাত্র-সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায় সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অস্থির হয়ে পড়াতে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়তে হয়। তার সঙ্গে এবার হরতাল-অবরোধ জট যুক্ত হওয়াতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সেশনজটের জন্য খ্যাতিলাভকারী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনজটমুক্ত করার ঘোষণা দিলেও রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং টানা হরতাল-অবরোধের কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের সন্তানরা। যাদের পক্ষে বাবার পকেটের টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে ডিগ্রি আনা সম্ভব হয় না। এ দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদের সন্তান এ দেশে পড়ালেখা করে না।
সাধারণ মানুষের করের টাকায় তাদের পিতারা যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে তারা তা ব্যয় করে বিদেশি ডিগ্রি অর্জনে। কিন্তু সাধারণ ঘরের সন্তানদের সেই সামর্থ্য নেই। তাই তাদের এ দেশে শিক্ষাগ্রহণ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে নিয়মিত হরতাল-অবরোধের কারণে সেই শিক্ষা কার্যক্রমের যে দুরবস্থায় পড়েছে তাতে কত দিনে আবারও বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাস-পরীক্ষায় উৎসবমুখর হয়ে উঠবে সেটা বলা সত্যিই কঠিন।
পরিশেষে, নষ্ট রাজনীতির খেলায় এ দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের শিক্ষাজীবন আজ ধ্বংসের পথে।
ভেঙে পড়ছে জাতির মেরুদণ্ড। তাই সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের কাছে অনুরোধ থাকবে_ দয়া করে আপনারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসুন। সংঘাত-সংঘর্ষের পথ পরিহার করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করুন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন জিম্মি করে যে ধ্বংসাত্দক রাজনীতি খেলা চলছে, তা কখনো এ দেশের গণতন্ত্র, উন্ন্নয়ন, অগ্রগতির পথে সহায়ক হবে না সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লেখক : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল :salah.sakender@gmail.comy
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।