মন কি যে চায়...... সংস্কৃত একটি জাতির দর্পন স্বরুপ। কোন দেশের সংস্কৃতি বিশ্লেষনের মাধ্যমে দেশটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। আর সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য উপাদান সঙ্গীত। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, আর এসব সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের সঙ্গীত রয়েছে। সংস্কৃতির উপর এসব সঙ্গীতের প্রভাব অত্যন্ত বিস্তর।
অন্যান্য জাতির মত বাংলাদেশেও রয়েছে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সংস্কৃত। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীত প্রচলিত রয়েছে। মূলত উনিশ ও বিশ শতকের সঙ্গীত-সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল আঠার শতকে। বাংলাদেশের সঙ্গীত বাণীপ্রধান; এখানে যন্ত্রসঙ্গীতের ভূমিকা প্রাধান্য সামান্য। গ্রাম বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গ্রামাঞ্চলের এই লোক সঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র, হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক সঙ্গীতকাররা অবশ্য বিদেশী বাদ্যযন্ত্র যেমন - কীবোর্ড, ড্রামস, গীটার, ইত্যাদিরও ব্যবহার করে থাকেন। কেউ কেউ আবার লোকজ ও আধুনিকতার মিশ্রনে ফিউশন ধারারও প্রচলন করেছেন।
সংস্কৃতি
কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। ইংরেজি ঈঁষঃঁৎব এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়।
১ শব্দটি বাংলা ভাষায় গৃহীত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত বিভ্রান্তি ও তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে, আর কোন শব্দ নিয়ে এত মনে হয় হয়নি। শিক্ষাবঞ্চিত নিরক্ষর জনগন এমনকি বহু শিক্ষিত লোককেও বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং উচ্চতর পেশাগত মর্যাদায় অধিষ্টিত অনেক লোকও সংস্কৃতি বলতে মূলত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে বুঝে থাকেন। অর্থাৎ নাচ-গান-নাটক-চলচ্চিত্র-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদিকেই সংস্কৃতি বলে মনে করেন। কিন্তু এগুলো সংস্কৃতির অংশ, সংস্কৃতির পুরোটা নয়।
সংস্কৃতিকে সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে বেধে রাখা বা সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে - মানুষ আসার আগে পৃথিবী যে অবস্থায় ছিল আর মানুষ আসার পর পৃথিবীর যে অবস্থা দাড়ালো এই দুইয়ের তফাত হলো সংস্কৃতির তফাত। পৃথিবীর জীবন প্রতিবেশে মানুষের সৃষ্ট যা কিছু সে সবই সংস্কৃতি বাকিটা প্রকৃতি।
ক্লাইড ব্লাকহোন এবং উইলিয়াম কেলি সংস্কৃতির সংজ্ঞয় বলেন, “ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হওয়া জীবনযাপনের নানা ছক, যা কখনো প্রকাশ্য, কখনো গোপন, কখনো যুক্তিসঙ্গত, কখনো অযৌক্তিক, কখনো যুক্তি নিরপেক্ষ এবং যা যে কোন সময়ে একটি জনগোষ্ঠীর আচরণকে পরিচালনা করে।
সুতরাং বলা যায়, সংস্কৃতির হল একটি জাতির প্রতিটি অনুষঙ্গ যেমন - পোশাক-আশাক, পেশা, খাদ্যাভ্যাস, ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার সবই সংস্কৃতির অঙ্গ।
সঙ্গীত
সংস্কৃতির বিষয়গুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগ নিত্যদিনকার জীবনযাপনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আর দ্বিতীয়ভাগ জীবন উপভোগের সাথে সম্পর্কিত। ৪ দ্বিতীয় ভাগের একটি গুরত্বপূর্ণ উপাদান সঙ্গীত। সঙ্গীত হল এক ধরণের শ্রবণযোগ্য কলা যা সুসংবদ্ধ শব্দ ও নৈশব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে সক্ষম।
স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে সঙ্গীতের সৃষ্টি। এই ধ্বনি হতে পারে কন্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রন। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সুর ধ্বনির বাহন। সুর ছাড়াও অন্য যে অনুষঙ্গ সঙ্গীতের নিয়ামক তা হল তাল। কার্যত ধ্বনি, সুর ও তালের সমন্বয়ে সঙ্গীত সৃজীত হয়।
৫ পৃতিভীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীত প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীণকাল থেকেই সঙ্গীত মানুষের হৃদয়ের খোরাক মিটিয়ে আসছে। তাই সংস্কৃতিতে সংগীতের ভূমিকা বা প্রভাব অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সঙ্গীত
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশবাংলাদেশের গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোষাক, উৎসব ইত্যাদির মিথষ্ক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এই সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে ধার করা কিংবা প্রভাবান্বিত।
তবু বাংলাদেশের স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আলাদা করার প্রয়াস পাওয়া যায়। সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের মত বাংলাদেশের সঙ্গীতেরও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গীত বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আবহমান কাল থেকে প্রচলিত সঙ্গীতের ধারকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতের ধারা থেকে এই সঙ্গীত সম্পূর্ণ অভিন্ন না হলেও কিছু স্বকীয় উপাদানের কারনে বাংলাদেশের সঙ্গীতকে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গীতমূলত রাগমিশ্রিত নয়, বরং অনেক বেশি সরল, কথা ও সুরের অপূর্ব সহজ একরৈখিক মেলবন্ধনের প্রয়াস।
৬ আবহমানকাল থেকে প্রচলিত গণমানুষের সঙ্গীত যেমন খুব সরল সাধারণ, তেমনি আধুনিক বিভিন্ন বিদেশী সঙ্গীতের ধারাও এই দেশে সমানভাবে প্রচলন হতে শুরু করেছে। তবু গণমানুষের সঙ্গীত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঢঙে বিভিন্ন পরিবেশনে বারবার সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেছে, অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক সঙ্গীতের জোয়ার ছাপিয়েও। তাই বংলাদেশের সঙ্গীত বলতে যে সঙ্গীতের যে ধারাকে বোঝানো হয়, তা প্রকৃত অর্তেই দেশীসঙ্গীত। আধুনিক কালের বাংলা গানের চরণগুলো মূলত স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও অভোগ - এই চার কলিতে বিভক্ত। ৭ নিচে বাংলাদেশের সঙ্গীতের শ্রেনীবিভাগ দেয়া হল ৬
গণমানুষের সঙ্গীত
বাউল
জারি
সারি
ভাটিয়ালী
ভাওয়াইয়া
মুর্শীদি
আধুনিক ধারা
রবীন্দ্র সঙ্গীত
নজরুল সঙ্গীত
আধুনিক সঙ্গীত
রাগ সঙ্গীত
অত্যাধুনিক ধারা
ব্যান্ড সঙ্গীত
ক্স মেটাল
ক্স ফিউশন
ক্স রক
বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাস
বাংলা ভাষার মত সঙ্গীতের প্রাচীন নিদর্শন হল চর্যাপদ, যার গানগুলো খ্রিষ্টীয় নবম বা দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিথ।
৮ আধুনিক কালের বাংলা চার প্রকারের কলি’র পরিবর্তে তখনকার সঙ্গীত ছিল উদগ্রাহ, মেলাপালক, ধ্রুব ও অভোগ - এই চার প্রকারের ধাতু সমৃদ্ধ। তন্মধ্যে উদগ্রাহ ও দ্রুব সব গানেই থাকতো, বাকি দুটো বাধ্যতামূলক ছিল না। সাধারণভাবে তখনকার সঙ্গীতকে বলা হত প্রবন্ধগীত। চর্যাগীতগুলো পটমঞ্চরী, মাল্লারী, গুর্জরী, কামোদ, বরাড়ী, ভৈরবী, গবড়া, দেশাখ, রামক্রী, শবরী, অরু, ইন্দ্রতাল, দেবক্রী, ধানশ্রী, মালসী, মালসী-গবড়া ও বঙ্গালরাগে পাওয়া যেত। আর বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো একতার পটহ বা ঢোল।
চর্যাসঙ্গীত গুলো মূলত বৌদ্ধ সাধনপদ্ধতিমূলক গান। চর্যাসঙ্গীতের পর বাংলা সঙ্গীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাথগীতি, যা প্রায় চর্যাপদের সমসাময়িক। নাথগীতির গায়নপদ্ধতির সাথে চর্যাগীতির গায়নপদ্ধতির পার্থক্য। এতে রাগের ব্যবহার থাকলেও গাওয়া হতো ছড়ার আকারে কিংবা পাঁচালির সুরে। এরপর দ্বাদশ শতকে রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় মাত্রাবৃত্ত অপভ্রংশে রচিত গীতগোবিন্দম বেশ সমাদৃত হয়।
তবে সেখনেও চর্যাগীতির প্রভাব লক্ষণীয়। ৭
বাউল সঙ্গীত
বাংলার গ্রামীণ-লোকজ জীবন ও সংস্কৃতির সাথে যারা কম বেশি পরিচিত, ‘বাউল’ শব্দটি শুনলেই তাদের মানসচোখে ভেসে ওঠে সাদা অথবা গেরুয়া কাপড়ে একতারা হাতে গান গেয়ে চলা কোন ব্যক্তির ছবি। বাউল বললেই মনে হয় নির্লিপ্ত আত্মমগ্ন কোন সাধকের কথা যে কিনা বসে আছে কোন এক পরমাত্মার সাথে মিলনের অপেক্ষায়। যে জানে না ‘মিলন হবে কতদিনে’ তার মনের মানুষের সনে: যার সমগ্রজীবনের একমাত্র প্রার্থনা ‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে’। এই বাউলদের রূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধানা বেয়ে
মনের মানুষের সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।
”৯
“বাউলরা হলো সাধনাভিত্তিক এক সম্প্রদায়। বাউলরা অজ্ঞাত মর্মের অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করিতে গিয়া, হৃদ-বিহারী অচিন পাখিকে ধরিতে চেষ্টা করিয়া অন্তরতম মনের মানুষকে মর্ম দিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিয়া, দরদী সাঁই-এর প্রেমময় পরশ লাভ করিতে ইচ্ছ করিয়া যে পথ অবলম্বন করিয়ছে, তাহা বঙ্গীয় চিন্তা জগতের সম্পূর্ণই স্বাধীন পথ। এ পথ বাঙালির নিজস্ব পথ; এপথে চলিতে চলিতে বাংলা মায়ের ভিজা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। ”১০ বাউলদের মধ্যে দুটো শ্রণী দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে গৃহত্যাগী বাউল এবং অন্যটি হচ্ছে গৃহী বা সংসারী বাউল।
গৃহত্যাগী বাউলেরা গুরুর নিকট ভেক বা খিলাফত-এর দীক্ষা নেয়। এদেরকে ভেকধারী বাউলও বলা হয়। তবে বাউলদের মধ্যে এদেরকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’। আর গৃহী বা সংসারী বাউলেরা সাধারণ মানুষের মতই স্ত্রী-পুত্র পরিজনসহ সাধারণ জীবন যাপন করে। এরা নানাবিধ পেশায় নিয়োজিত থাকে।
গৃহী বাউলরা ভেকধারী বাউলের কাছ থেকে দীক্ষা নেয়। এদের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। বাউলমত গুরুমুখী মতবাদ। বাউলদের ‘ঘর’ বা গুরুধারা একেকজন বাউলগুরুর নামানুসারে নির্দিষ্ট হয়। যেমন: লালনশাহ্ী, পাঞ্জু শাহী, পাঁচু শাহী, দেলবর শাহ্ী ইত্যাদি।
বাউল ধর্মে কোন লিখিত শাসন নেই। এটা হলো গুরুমুখী বিশ্বাস ও ধর্মাচার। যেখানে গুরুর মৌখিক নির্দেশ এবং গানই একমাত্র অবলম্বন। উল্লেখ্য যে বাউল মত ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নের একটি বড় ভিত্তি হিসাবে বাউল দর্শনের শ্রেষ্ঠ রূপকার বাউল সঙ্গীতকে মূল্যায়ন করা হয়। এ প্রেক্ষিতে বাউল গানকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়:১১ দৈন্যপদ এবং করণ পদ।
দৈন্য পদ যেমন:
“আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধ’রে
ননী চুরি আর করবো না”। ২১
দৈন্যপদ সাধারণ গীতিকথা। এখানে কোন গূঢ়তত্ত্ব নেই। বাউল গানের মূল দর্শন বা তত্ত্ব লুকায়িত আছে করণ পদে। করণ পদের উদাহরণ:
“আপন ঘরের খবর নে-মা
অনাশে দেখতে পাবি
কোনখানে সাঁইর বারামখানা।
২১
তাই বাউলদর্শন বিশ্লেষনের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে করণ পদের বিশ্লেষণ।
বাউল মত : উদ্ভব, প্রকৃতি ও বাস্তবতা
বাউল ধর্মমতের প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। উদ্ভবকাল নিয়ে কিছুটা সংশয়ের পরও নিঃসংকোচেই বলা যায় যে, প্রায় অর্ধ-সহ¯্রাব্দ সময় জুড়ে বাউলরা বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে অস্তিত্বশীল। ষোড়শ শতকের বাংলা সাহিত্যে বহুস্থানে সচেতন ভাবে ‘বাউল’ শব্দের ব্যবহার হতে দেখা যায়। ১২ কিন্তু একটি সম্প্রদায় হিসাবে সমাজ কাঠামোয় বাউলদের বিকাশ ঠিক কবে থেকে তা নিয়ে অস্পষ্টতা যেমন আছে গবেষকদের মধ্যে মতভেদও রয়েছে।
তবে বর্তমান সমাজকাঠামোয় বাউলদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বহুদিন থেতেই স্বীকৃত। প্রসিদ্ধ একজন গবেষকের ভাষায়, “বাংলার বাউল, বাউল সাধক, বাউল তত্ত্ব ও ধর্মমত, বাউণ গান, বাউল দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে নানা আলোচনা-গবেষণা এ শতাব্দীর শুরু থেকে হয়ে আসছে। .......বাউল চর্চার এ গুরুত্ব থেকে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসে বাউলদের সামাজিক অস্তিত্ব ও গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য অবিসংবাদিত রূপে স্বীকৃতি পায়। ”১৩ অনেকে মনে করেন যে বাউল মত একটি পূর্ণধর্ম। আবার অনেকে মনে করেন যে, বাউল মত একটি লৌকিক মতবাদ এবং ধর্মের বিশিষ্ট এক রূপ- পূর্ণাঙ্গ কোন ধর্মমত নয়।
ঊপেন্দ্র্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন যে, “আনুমানিক ১৬২৫ খৃষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৬৭৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার বাউল ধর্ম এক পূর্ণরূপ লইয়া আবির্ভূত হয়। "১৪ আবুল আহসান চৌধুরীও বাউল ধর্মের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এর বিকাশ সম্পর্কে অন্য একটি কাছাকাছি অনুমানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন। তিনি মনে করেন, “বিভিন্ন পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে এসে চৈতন্যদেবের (১৪৮৪-১৫৩৩) মৃত্যুর পর বাউলধর্ম তার নিজস্ব রূপ পরিগ্রহ করে। ”১৫ অন্যদিকে প্রকৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে বাউল মতকে ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করে ওয়াকিল আহমেদ বলেন, “বাউল ধর্মমতে ও দর্শনে হিন্দুতান্ত্রিক, নাথযোগী, সুফী, বৈষ্ণব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব রয়েছে।
এতদাসত্ত্বেও বাউল মূলত লৌকিক ধর্মমত। ”৯ ঊপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও প্রায় একই মত প্রকাশ করে বলেন,“এই ধর্ম (বাউল ধর্ম) নিতান্ত লোকের ধর্ম-গণধর্ম এবং ইহার পশ্চাতে যে একটি বিশিষ্ট রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিকা ছিল, তাহারও যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছি। ”৯ তবে বাউলমতের প্রকৃতি নিয়ে এই মূল্যায়নগুলোর কোনটিই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত হয় নি।
স্পষ্টত বাউলমতের উদ্ভব ও বিকাশ সামাজিক বাস্তবতায়। বিগত প্রায় অর্ধসহ¯্রাব্দের নানাবিধ ধর্মমতের - বৌদ্ধধর্ম, হিন্দু তান্ত্রিকতা, নাথযোগ, সুফিবাদ ইত্যদির এক সমন্বিত প্রকাশ বাউল মত।
বাউল মতের এই উদ্ভব ও বিকাশ বিবেচনায় সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেউ কেউ বাউল মতকে ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। কেননা সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং এখানে ধর্মকে প্রত্যাদেশের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয় না।
এই সকল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাউল মতবাদকে একটি স্বতন্ত্র মতবাদ বলে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। কেননা বাউলদের যেমন নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস রয়েছে একইভাবে স্বতন্ত্র আচার-রীতি ও অভিজ্ঞতাও রয়েছে এবং সর্বোপরি একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বহুদিন থেকে স্বীকৃত। তবে এই সকল বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব দিয়ে বাউলমতের প্রকৃতি নির্ধারণ যৌক্তিক নয়।
এর জন্য বাউলমতের বিশ্বাস ও আচারকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। সমাজবিজ্ঞানে ধর্মের একটি সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস ও আচারের এমন প্রক্রিয়া যা পবিত্রতার সাথে যুক্ত। ধর্মের ধারণার সাথে এখানে অতীন্দ্রিয় শক্তির যোগাযোগ কল্পনা করা হয়।
কিন্তু বাউল ধর্মে ঐশ্বরিক বিশ্বাসের অস্তিত্ব থাকলেও সেখানে পবিত্রতা-অপবিত্রতা বেং মৌলিক বিশ্বাস ও আচারের কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও আচারের পরিবর্তে বাউল ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস এবং আচার নিয়ে।
যে কারণে বাউল গানে আছে,
“আমার নাহি মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
ওরে তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিনা। ”২১
বাউল মতবাদ বিকশিত হয়েছে দেহকেন্দ্রিক সাধন-দর্শনকে কেন্দ্র করে। বাউলদের এই দেহভিত্তিক সাধন দর্শন বৈষ্ণব সহজিয়া মতেরই এক গীতিরূপ বিশেষ। বৈষ্ণব সহজিয়াদের “বৃহৎ দেহ নির্ণয় ”-এর মধ্যে এই সাদৃশ্য দেখা যায়।
“নরদেহে নৈলে কোন তত্ত্ব নাহি জানে
সাধনার মূল এই নরদেহে গনে।
”১৭
বৈষ্ণব সহজিয়াদের মত বাউলদেরও দেহের বাইরে কোন সাধনা নেই। বলা যায় যে ‘যাহা নাই ভান্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মান্ডে’। দেহভান্ড তাদের কাছে একমাত্র বর্তমান। এর বাইরে সকল কিছুই তাদের কাছে কল্পনা এবং মূল্যহীন। ১৪ লালনের গানে দেখা যায়,
“বেদে কি তার মর্ম জানে?
যে রূপ সাঁইর লীলা আছে এই দেহ ভুবনে।
”২১
‘বাউলেরা রাগপন্থী’ - কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনই বাউল পদ্ধতি। ১৮ যদিও লালনের একটি গানে আছে-“আগে কপাট মারো কামের ঘরে। ” কিন্তু তার এবং বাউল গানের অধিকাংশই সূক্ষ্মভাবে যৌনতাকে সাধনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন লালনের গান থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়:
“সবাই কি তার মর্ম জানতে পায়
জানে ভজন সাধন করে
যে সাধকে অটল হয়।
অমৃত মেঘেরি বরিষণ,
চাতক ভেবে জানরে আমার মন,
ও তার একবিন্দু পরাশিলে শমন জ্বালা ঘুচে যায়।
যোগেশ্বরীর সঙ্গে যোগযোগ করে
মহাযোগাযোগ সেই জানতে পারে,
ওসে তিন দিনের তিন মর্ম্ম জেনে একদিনেতে সেধে লয়। ”২১
বাউলদের অটল সাধনা হচ্ছে যৌন মিলনে বীর্য নিরুদ্ধ করা। মুহাম্মদ সিরাজউদ্দিন উল্লেখ করেন যে, “যোগেশ্বরী হচ্ছে সাধিকা অর্থাৎ অটল যৌন সাধনার চধংংরাব ঈড়ঁহঃবৎঢ়ধৎঃ."১১ আবু জাফর তার গবেষণা অভিজ্ঞতায় মন্তব্য করেন-বাউলরা নিজেরা যে এক রাকাত নামাজ পড়ে বলে উল্লেখ করে সে এক রাকাতের মর্মার্থ হলো, নারীদেহকে জায়নামাজ জ্ঞানে সম্ভোগ’ এবং এই প্রেক্ষিতেই লালন বলেছেন, ‘আছে আদি মক্কাদেহ এই মানবদেহে’১৯। যদিও ওয়াকিল আহমেদ তার আলোচনায় বাউল তথা লালনের কয়েকটি গানের এক-দুই চরণ উল্লেখ করে বাউলদের নিষ্কাম প্রেমের সাধনার কথা বলেছেন। কিন্তু আবুল আহসান চৌধুরী, আহমেদ শরীফ, মুহাম্মদ সিরজউদ্দিন, সুধীর চক্রবর্তী প্রমুখের আলোচনা থেকে ওয়াকিল আহমেদের সিদ্ধান্তকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।
অবশ্য ওয়াকিল আহমেদ নিজেও তাঁর গ্রন্থে স্বীকার করেন যে, বাউলরা আধ্যাত্ম প্রেমাস্বাদনের জন্য দেহজ প্রেমকে গ্রহণ করে যৌনচারিতা স্বাধীনতা নিয়ে আসে। ৯
এই বাস্তবতায় বাউল মত একটি নিতান্তই লোকদর্শন, আদিম জনসাধারণের অনুরূপ এক জীবন দর্শন। তবে বাউল মতবাদ নিয়ে এই মূল্যায়নকে পূর্ণাঙ্গ বিবেচনা না করে এর প্রকৃতি ও বাস্তবতার সামগ্রিক সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়নের জন্য আমাদের এর উদ্ভব ও বিকাশের সামাজিক বাস্তবতা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রচলিত জীবন ও ধর্ম দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে বাউল মতবাদের উদ্ভব এবং বিকাশ। তবে এই যে জীবনবিমুখতা তা কিন্তু সমাজেরই সৃষ্টি।
অরবিন্দ পোদ্দার এ সম্পর্কে বলেছেন, “সমাজের দাবী তারা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ......এই প্রত্যাখ্যানের পশ্চাতে গভীর দুঃখবোধ সামাজিক ভেদ বিচারের নির্মম উৎপীড়ন বর্তমান ছিল, তা বলাই বাহুল্য। যারা উত্তর সাধন রূপে এই ভাবাদার্শ গ্রহন করেছেন এবং সামাজিক কর্ম-সম্পর্কের বাইরে আপনার ঠাঁই খুজে নিয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে না হলেও যারা প্রথম প্রবক্তা তার প্রত্যক্ষ কারন ছাড়া এ পথের পথিক হয়েছেন, এটা ভাবা কঠিন। ”২০
এই বাস্তবতায় বাউলদের বিকাশের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে।
প্রাচীন ভারতবর্ষের হিন্দু জাতিভেদ বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ হয় তার একটি অংশ পরবর্তী সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মে রূপ নেয়। এবং এই সহজিয়া বৌদ্ধগন ক্রমান্বয়ে সহজিয়া বৈষ্ণবে পরিণত হন।
একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে যারা প্রথম প্রবক্তা, তারা ছিলেন সমাজকাঠামোর অবহেলিত নিচের দিকের মানুষ। সামাজিক শোষনের বিপরীতে প্রতিবাদ স্বরূপই বাউল মতের প্রবর্তন।
সুতরাং বলা যায়, জাতি-বর্ণ প্রথার যে সংকীর্ণতা এবং তৎসংলগ্ন যে আর্থ-সামাজিক শোষন সেখান থেকেই বাউল দর্শনের মূল চেতনা এসেছে, যাকে প্রচলিত সমাজরীতি ও দর্শন থেকে এক বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচনা ব্যাখ্যা করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী জ. ক. গবৎঃড়হ এর ধারনার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে দেখা যায়, তৎকালীন সমাজ কাঠামোর মূল ভিত্তি ছিল ধর্ম। আর এই ধর্মভিত্তিক সমাজকাঠামোয় নীচের দিকের মানুষের জন্য প্রচলিত সমাজ কাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক উপায় খুবই সংকীর্ণ ছিল। ফলে তাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক লক্ষ্য তথা সামাজিক সাফল্য ও মর্যাদা লাভের তেমন কোন সুযোগ ছিল না। এই দুয়ের অসামঞ্জস্যের বাস্তবতায় জবঃৎবধঃরংস ধারণার প্রেক্ষিতে নি¤œ বর্ণের মানুষেরা প্রচলিত ধর্ম এবং জীবনবোধকে ও জীবনাচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাউলরা এই প্রত্যাখ্যানের ধারাবাহিকতায় নতুন মূল্যবোধ প্রসারে সচেষ্ট হন।
তাদের এই নব্য মূল্যবোধে প্রচলিত ঈশ্বরের ধারনাকে মানুষের স্বীয় সৃষ্টি বিবেচনা করে সর্বোচ্চ প্রধান্য দেয়া হয় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও সমতাকে। তাইতো তারা বলেন:
“আল্লাহ হরি ভজন পূজন
সকলি মানুষের সৃজন। ”৯
গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এর “কহড়ি ঞযুংবষভ” এর মতো বাউল দর্শন ও ধর্মের শুরুটাও নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে।
“আপনার খবর আপনার হয় না।
একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।
”২১
যে ‘পরমাত্মা’ বা ‘মনের মানুষ’ বাউলদের আরাধ্য তার পূর্ণ প্রাপ্তির প্রস্তুতি হিসাবেই তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করতে চান। একারনেই বাউল গেিন বলা হয়: “না জেনে ঘরের খবর তাকাও কেন আসমানে। ’
তবে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা যতটা না আত্মিক তার চেয়ে বেশি দৈহিক। লালন শাহের গানে পাওয়া যায়:
“উপাসনা নাইগো তার
দেহের সাধন সর্ব-সার
তীব্র-ব্রত যার জন্যে
এ দেহে তার সকল মিলে। ”২১
তবে বাউলদের এই মতবাদ মারাত্মক সামাজিক প্রতিক্রয়ার জন্ম দেয়।
মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছিলেন:
“ঠেটা গুরু ঝুটা পীর
বালা হাতে নেড়ার ফকির
এরা আসলে শয়তান, কাফের বেইমান
তা কি তোমরা জান না। ”১৫
আবার কবি জেনাব আলি বলেছিলেন: “লাঠি মার মাথে দাগাবাদ ফকিরের”। এ অংশগুলো থেকে বোঝা যায় যে, সমাজকাঠামোয় বাউল সমাপ্রদায়কে কখনোই সহজ ভাবে মেনে নেয়া হয় নে।
ভাটিয়ালী গান
ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালি গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
বাউলদের মতে ভাটিয়ালি গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালি গানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীন জীবন, গ্রামীন নারীর প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন। যেমন :
“আষাঢ় মাসে ভাষা পানি
পূবালি বাতসে,
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি
আমার নি কেউ আসে। ”
কিংবা
“নাই বাইয়া যাও ভাটিয়ালী নাইয়া
ভাটিয়ালী নদী দিয়া
আমার বন্ধুর খবর কইয়ো
আমি যাইতেছি মরিয়া।
”৫
প্রেক্ষাপট
নদীমাতৃক দেশ এই বাংলাদেশ। নদীর সাথে এ দেশের মানুষের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। তাই ভাটিয়ালী গানও এ দেশের প্রাণের গভীর চেতনা থেকে উৎসারিত একটি বিশিষ্ট সম্পদ। নদীর মাঝি বা নদী পাড়ের জনজীবনে এই গানের প্রচলন অত্যধিক। ভাটিয়ালী অর্থাৎ নদীর ¯স্রোতের টানে ভাটিয়ে যাওয়ার সুর এই গানে বিদ্যমান।
নদীর ¯্রােতের সাথে আছে জীবনের চলার এক অপূর্ব সাদৃশ্য - স্রোতে সমুদ্রের দিকে চলেছে, উজানগামী সে কখনই নয়। জীবনও পরিণতির পথে এমনি প্রবাহমান যে, যে মুহূর্ত সে অতিক্রম করে সেটি আর ফিরে আসে না। বাংলার ভাটিয়ালী গানের কবি তাই বলেন,
“তরী ভাট্যায় পথ আর উজান না
মন মাঝি তোর বৈঠা নে’রে
আমি আর বাইতে পারলাম না। ”৫
এ গান কবে কে রচনা করেছিলেন তা আর হাজার মাথা কুটেও জানবার উপায় নেই। কিন্তু এ গানে বাংলার মানুষের, নদীমাতৃক দেশের মানুেষর প্রাণের বাণীই ধরা পড়েছে।
বাংলাদেশের লোক কবির কন্ঠে আমরা তাই শুনি,
“কূলে কূরে ঘুরিয়া বেড়াই আমি
পাইনা ঘাটের ঠিকানা
ডুব দিলাম না। ”৫
বর্তমান ভাবনা
কিন্তু আধুনিক ভাটিয়ালী লোকসংগীতে এই মরমিয়া চেতনা এমনভাবে ধরা পড়তে দেখা যায় না। আধুনিক ভাটিয়ালি গান অনেকটা বস্তুমুখী চেতনায় সমৃদ্ধ - জীবনের সব সমস্যার ঊর্ধ্বে খাওয়া-পরার সমস্যা তাই প্রাধান্য লাভ করেছে। এখন নদীর মাঝি উজানে কোন বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে ভাটির দেশে যাবার সময় চিন্তা করে তার ক্রীত পণ্য নিয়ে ভাটির বন্দরে বিক্রি করে সে কত লাভ করবে। এমনকি নদীর মাঝি অথবা নৌকায় নৌকায় বসবাসরত সওদাগরের মনেও আজ এমনি লাভ-লোকসানের হিসাব প্রাধান্য লাভ করেছে।
এই হিসাব ভাটিয়ালী গানেও প্রতিবিম্বত ও নতুন সুরে ঝংকৃত। ২৩
সংগীত ব্যাক্তিত্ব
বাংলাদেশের ভাটিয়ালী গানের শিল্পী, রচয়িতা, সংগ্রাহক ও গীতিকারদের মধ্যে অন্যতম হলেন - মিরাজ আলী, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, জং বাহাদুর, শাহ আবদুল করিম, উমেদ আলী প্রমুখ।
ভাওয়াইয়া গান
ভাওয়াইয়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। মূলত রংপুর এলাকার প্রত্যন্ত জনপদে এ গানের সৃষ্টি ও চর্চা রয়েছে। এ সকল গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।
যেমন গরুর গাড়ি চালক বা গাড়িয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে -
“ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি,
আরেক নজর দেখিবার নাও মুই বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল। ”৫
আবার রংপুরের ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানা নিয়ে -
“নিয়া ভাই একনা কতা কবার চাও,
অংপুর মুই যাবার চাও,
চিড়িয়াখানা দেখিয়া আনু হয়। ”৫
উৎপত্তি
ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর। ২৪ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরে।
উঁচু-নিঁচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঁজ পড়া গীতরীতিই ‘ভাওয়াইয়া’ গানে লক্ষনীয়। প্রেম-বিয়োগে উদ্বেলিত গলার স্বর জড়িয়ে যেরকম হয়, সেরকম একটা সুরের ভাঁজ উঁচু স্বর হতে ক্রমশ নিচের দিকে নেমে আসে। সুরে ভাঁজ পড়া ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। মাটির গান হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে ভাওয়াইয়া গানের।
পিঠা পুলির উৎসবেও এ গানের প্রভাব পড়েছে। তেমনি একটা হলো -
“মনটাই মোর পিঠা খাবার চাই”২৫
জারি গান
জারি গান বাংলাদেশের এক প্রকারের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতরীতি। ফারসি জারি শব্দের অর্থ শোক। মুহাররম মাসে কারবালার বিযোগান্তক কাহিনীর স্মরনে মূলত এই গানের উদ্ভব। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা শুরু হয়।
২৬
ইসলামের ইতিহাস ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় পরিবেশনা রীতি হচ্ছে জারিগান। কারবালার যুদ্ধে শহীদ ইমাম হাসান, ইমাম হোসেন ও অন্যান্য চরিত্রের অন্তর্গত বেদনা নিয়ে এক ধরনেে আহাজারিমূলক সুরে সাধারণত নৃত্য সহযোগে জারিগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এক সময় সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন আঙ্গিকে জারিগানের প্রচলন ছিল। বর্তমানে এ ধরনের নাট্য পরিবেশনার প্রচলন পূর্বের ধারাবাহিকতার চেয়ে কিছুটা কমে গেলেও তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ‘জারিগান’ কথাটির ব্যাখ্যা - জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন।
এ শব্দটির উৎস-মূল ফারসি ভাষা। ৬ তবে বাংলায় এসে শব্দটি ব্যপকতা লাভ করেছে। বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় তা সাধারণভাবে জারিগান বলে পরিচিত। এছাড়া যেকোন ধর্মীয়, অতিলৌকিক বা সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত গানকেও কখনও কখনও জারিগান নামে ডাকা হয়।
উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলায় জারিগান পরিবেশনার উদ্ভবসূত্র আবিষ্কার করা হয় আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের বৈঠক-রীতির ‘জঙ্গনামা’ পরিবেশনায়।
গবেষকদের ধারণা, ‘জঙ্গনামা’ বৈঠকী-রীতির পরিবেশনা থেকে বিবর্তনের পথ ধরে অবশেষে ‘জারিগান’(শোকসঙ্গীত) নামে বাংলাদেশের স্থানীয় জনসমাজে প্রভূত খ্যাতি লাভ করে। ২৬
অনুষ্ঠানের সময়
জারিগানের অনুষ্ঠানের প্রধান সময় হচ্ছে মহররম মাস। এই মাসে সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে জারিগানের আসর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সাধারণত মহররমের ৫ তারিখ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় নিয়মিতভাবে জারিগানের আসর হয়। ৫ জারিগান পরিবেশনার জন্য দিন-রাতের কোন বিধি নিষেধ নেই।
তাই রাত ও দিন উভয় সময়েই জারিগানের আসর চলে। মহররম ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের মেলা, উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কর্তমানে জারিগানের অনুষ্ঠান হয়।
জারিগানের কুশীলব
জারিগানের দলে যে সকল কুশীলব অভিনয় করেন তাদের একটা নাম আছে। এর শিল্পী-কুশীলবদের মধ্যে প্রধানত নৃত্যকারদেরকে কোথাও খেলোয়াড়, আবার কোথাও জারিয়াল এবং প্রধান গায়ককে প্রায় সব অঞ্চলে বয়াতী বলা হয়। এছাড়া জারিগানের নাচের দলের পরিচালককে বলা হয় রেফারি।
৫ জরিগানের আসরে বৈচিত্র্য আনতে যখন নাচের গতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তখন এই রেফারিই বাঁশি ফুকে নাচের গতি পরিবর্তনে অগ্রনী ভুমিক পালন করেন।
পরিবেশনারীতি
সাধারণত সমতল ভূমিতে বৃত্তকার মঞ্চে সাদা ধূতি বা পাজামার সাথে সাদা গেঞ্জি পরে একজন গায়েন, সহযোগী গায়েন ও একদল নৃত্যকার-দোহার নৃত্যগীতের মাধ্যমে জারিগান পরিবেশন করেন। এই ধরণের নৃত্যগীতে অধিকাংশ সময় মূলগায়েন ও তার সহযোগী গায়েনের অবস্থান থাকে বৃত্তাকারে নৃত্যরত কুশীলবদের বাইরে। তবে সহযোগী গায়েনকে কখনও কখনও বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করতে দেখা যায়। জারিগান পরিবেশনকালে দোহার-নৃত্যকারগণ হাতে লাল রুমাল বা গামছা ব্যবহার করেন।
শুধুমাত্র হাততালি, অঙ্গভঙ্গি ও রুমাল সঞ্চালনের মাধ্যমে জারিগান পরিবেশিত হয়। এর পরিবেশনাতে প্রায় সকল সময় অসাধারণ নৃত্য কৌশল প্রযুক্ত হয়ে থাকে। আসলে জারিতে গানের প্রতি চরনের সঙ্গে নৃত্যের তাল প্রত্যক্ষ করা যায়। কিশোর ও যুবক নৃত্যকারগণ কখনও পরস্পর সংঘবদ্ধ, কোমরে হাত দিয়ে বৃত্ত, রেখা ও সর্পিল গতিভঙ্গ সৃজন করে। এ শ্রেণীর জারিগান শূন্যে লম্ফদানের কৌশলদীপ্ত পৌরুষের পরিচয়বাহী।
গবেষকগণ জারিগানের এ নৃত্যের সঙ্গে মণিপুরী লম্ফনৃত্য বা চৈনিক ব্যালের তুলনা করেছেন। জারিগানে সকল নৃত্যকারী সচরাচর পায়ে নূপুর পরে থাকেন।
সারি গান
সারি গান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতগুলোর অন্যতম। সারি গান মূলত মাঝিদের গান হলেও বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের মুখে এই গান শোনা যায়। এ গানকে গ্রাম্য ভাষায় নাওবাইচের গানও বলা হয়।
নৌকাবাইচের সময় বৈঠাধারী সারিবদ্ধভাবে বসা মাঝিরা একে অপরকে উৎসাহ জোগানোর জন্য এ গান গেয়ে থাকেন। উৎসবের যাত্রাপথে অথবা ফিরতিপথে কিংবা বাইচের মহড়ায় চলে এ গানের চর্চা।
নৌকা বাইচের সময় প্রতিটি নৌকায় একজন করে সাইবদার অথবা পরিচালক থাকেন। ৫ মূলত তিনিই গানের একেকটি পদ গেয়ে যান, নৌকার বৈঠাধারী মাঝিরা সেই সুর টেনে নেন দলবদ্ধভাবে। মূল গায়কের কাছে থাকে করতাল বা একতারা সাথে সংগত করেন একজন ঢুলী।
এদের সাথে বৈঠাধারী সহগায়কেরা গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গেয়ে যান।
বৈশিষ্ট্য
সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশে কর্মের সাথে কিছু কিছু উৎসবের রেওয়াজ সম্পৃক্ত বা প্রচলিত হয়ে আসছে। যেমন : শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন নৌকা বাইচের তালে বাইচালী গান অনুষ্ঠিত হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষাকালের শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে নির্ধারিত তারিখে নির্দিষ্ট স্থানে নৌকা বাইচের আড়ঙ্গ-এ বাইচালি সারি গান শুনতে পাওয়া যায়। সারি গানকে এ অঞ্চলের হাইর গানও বলা হয়।
এ গান সমবেত কন্ঠে গাওয়া হয় বলে এটি দলীয় গান। সারি গানের বৈশিষ্ট্য হলো - এর বিষয়বস্তু সবই হিন্দুস্তানি, কিন্তু এর গায়ক গোষ্ঠীর সকলেই মুসলমান।
চল বন্ধুয়ার দেশে যাইরে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
ময়ূরপঙ্খী নৌকা আমার চলছে বাতাস বইয়ারে ভাই
চলছে বাতাস বাইয়া
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
কলসী কাঁখে কুলবধুয়া চলছে ঘোমটা দিয়ারে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
হেইয়াহো ডাক শুনিয়া বধূ দেখে চাইয়া
কাঙ্খের কলসি ফেইলা দিয়ে ঘোমটা দেয় খুলিয়ারে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
নতুন বর চলছে আজি নৌকাতে চড়িয়া
পুলাপুরি দৌড়াতে চিনি কাইবার লাইগারে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
সাইডুলিতে বাইতে মাঝি সারিগান ধরে
সুরিয়া নদীতে চইলা গেলে মদনপুরের পাছেরে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই।
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো। ”
রবীন্দ্রসংগীত
রবীন্দ্র সংগীত হল বিশিষ্ট বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও সুরারোপিত গান।
বাংলা সংগীতের জগতে এই গানগুলি এক বিশেষ স্থানে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।