আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশু যৌন নির্যাতনের প্রতিকার : নিজে সতর্ক হই, শিশুটিকে সতর্ক করি - পর্ব এক

যৌন নির্যাতন আমাদের দেশে এমন একটি ট্যাবু যা নিয়ে আমরা কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইনা, প্রসঙ্গটা সবসময় এড়িয়ে যেতে চাই। আর তা যদি শিশু যৌন নির্যাতন হয় তাহলে তো আর কথায় নেয়... খুব কম পরিবারই রয়েছে যারা নিজ শিশুর যৌন নির্যাতনের কথা জানতে পেরেও নির্যাতকের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহন করে থাকে। কারন বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুটি নির্যাতিত হয় তার আশেপাশের আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী চেনা পরিচিত মানুষ দ্বারা। আর এক্ষেত্রে সামাজিকতার বা লোকলজ্জার ভয়েও অনেক সময় অনেক অভিভাবক নির্যাতকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না।

বিভিন্ন পরিসংখানে উঠে এসেছে যে প্রতি ৪ জন মেয়ে বাচ্চার মধ্যে একজন এবং প্রতি ৬ জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন তাদের ১৮ বছর বয়সের পূর্বে কোন না কোনভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

একে তো যে শিশুটি এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায় সে নিজেকে দোষ দিতে থাকে, নিজেকে দোষী ভাবতে থাকে, ভাবে বড়দের জানালে তারা বিশ্বাস করবেনা। এই বাঁধা অতক্রম করে কোন শিশু যদিও বা মুখ খুলে অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকেরা সামাজিক সমস্যা এড়াতে পুরা বিষয়টাই এড়িয়ে যায়। এভাবে কিন্তু আমরাই আমাদের শিশুদেরই একটি ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত।
সত্যি কথা বলতে কি যে সকল শিশুরা ছোট বেলায় কোন না কোন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় তারা পরবর্তীকালে নানা রকম সমস্যায় আক্রান্ত হয় ব্যক্তিগত,পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে । দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার প্রবনতা এবং প্রচেষ্টা, রোমান্টিক সম্পর্কে সমস্যা, পরবর্তীকালে বৈবাহিক জীবনে সমস্যা সহ নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকে।


ছোটো শিশুরা যারা ভবিষ্যৎ দিনের নাগরিক তারা যদি জীবনের শুরুতেই এমন নোংরা একটা বিষয়ের মধ্যে দিয়ে যায়,একদম ছোটো থেকেই মানুষকে অবিশ্বাস করতে শিখে... তারা কিভাবে একটি সুন্দর জীবন, সুন্দর ভবিষ্যৎ আর সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখবে??
সচেতনতায় পারে যে কোন সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় দিতে। সুতরাং আমাদের সচেতন হতে হবে তার সাথে সাথে বাচ্চারা একটু বুঝার বয়স হলেই তাদের কিছু জিনিষ বুঝাতে হবে। কিছুটা সচেতন হলে হয়তবা আমরা আমাদের আদরের শিশুটিকে সহজেই নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে তার নির্মল,সুন্দর, হাসিখুশিতে ভরপুর একটি শৈশব নিশ্চিত করতে পারব।
১) শিশুদের নিজের শরীরের স্পর্শকাতর অংশগুলো বা প্রাইভেট পার্টসগুলো সঠিক নামে চিনতে শিখাতে হবে :
শিশ্ন বা পুং জননেন্দ্রিয়, স্ত্রী যোনি বা ভ্যাজাইনা, স্ত্রীযোনিদ্বার বা ভালভা, স্তন বা ব্রেস্ট, অণ্ডকোষ বা টেস্টিকোল এই শব্দগুলো আমাদের প্রত্যেককেই কমবেশি অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। আমরা বড়রায় যেখানে এই শব্দগুলো এড়াতে চায় সেখানে কোন ছোট বাচ্চার মুখ থেকে এমন শব্দ শুনতে পাওয়া ভীষণ অস্বস্তিকর বা বিব্রতকর ও বটে।

আমরা সাধারনত শিশুদের ছোট মনে করে তাদের শরীরের এই অংশগুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করিনা।
কিন্তু একটা শিশু যখন নিজের শরীরের অংশগুলো সঠিক ইংলিশ বা বাংলা (অথবা চলিত বাংলা) নামে চিনে থাকবে এবং উচ্চারণ করতে থাকবে এটি কিন্তু তার আশে পাশের সম্ভাব্য যৌন নির্যাতনকারীকেও একই সাথে অস্বস্তিতে ফেলে দিবে। সেই যৌন নির্যাতনকারী অন্ততপক্ষে বুঝতে পারবে যে এই শিশুটি যখন তার নিজ শরীর সম্পর্কে এত কিছু জানে তখন তার পক্ষে বাবা-মাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়াও খুব সহজ।
এতে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ সম্ভব।
তাছাড়া কোন বাবা-মা যদি ছোট থেকে তার সন্তানকে শরীরের গোপন অংশগুলির নাম সঠিক ভাবে শিখিয়ে থাকি এবং কোন একদিন হঠাৎ খেয়াল করে যে তার ছেলেটি/মেয়েটি তার শিশ্ন বা পেনিস বা যৌনাঙ্গ কে সঠিক নামে না বলে ডিং ডং/ সোনা/ বা এই ধরনের কোন অদ্ভুত নামে ডাকছে সেটা কিন্তু এক ধরনের নির্দেশনা যে অন্য কোথাও থেকে শিশুটি এই নামগুলো শিখেছে তার অর্থ অন্য কেউ শিশুটির গোপন অঙ্গের প্রতি আগ্রহী।

এই ক্ষেত্রেও বাবা –মা খুব সহজেই শিশুটির কাছ থেকে সেই আগ্রহী ব্যাক্তিটির নাম জানতে পারবে।
এভাবে কিন্তু সহজেই শিশুটিকে আমরা যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারি।
সুতরাং আর দেরী কেন? আজ থেকেই শুরু করি-
পেনিস, পেনিস, পেনিস...... ভ্যাজাইনা, ভ্যাজাইনা, ভ্যাজাইনা... উচ্চারণ করতে খুব কি খারাপ লাগছে? উঁহু খারাপ লাগা উচিত নয়, আপনার আদরের শিশুটিকে তার প্রাপ্য সুন্দর, সহজ আর নির্মল শৈশব উপহার দেবার কথা ভাবুন দেখবেন এটি খুব কঠিন লাগবেনা।
২) আপনার বাচ্চাটি অন্য কারো থেকে আদর নিবে কিনা অথবা আদর করবে কিনা তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন, কখনও জোর নয় :
”বাবু আমাকে একটা চুমু খাও, লক্ষ্মী সোনা একটা চুমু খাও”
”যাও আঙ্কেল/ আন্টি কে একটু আদর করে আস”
”যাও ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরে বল যে তুমি সরি”
একটু খেয়াল করে দেখুন আমরা প্রায় প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের এমন নির্দেশ দিয়ে থাকি, অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি বাচ্চাটি চাচ্ছেনা তবুও আমরা জোর করি, কথা না শুনতে চাইলে কখনও কখনও রাগ করি অথবা বিরক্ত হয়।
আমরা বাবা মায়েরা হয়ত ভাবি এই আচরনগুলো দিয়ে আমরা আমাদের বাচ্চাটিকে ভদ্র নম্র অন্য মানুষের প্রতি সহনশীল করে গড়ে তুলছি।

কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি যে আমরা যখন কোন শিশু কে চুমু খেতে বা জড়িয়ে ধরতে জোর করতে থাকি সেটা তাকে অন্য কোন মেসেজও দিতে পারে। পুরো বিষয়টিকে সে এভাবেও নিতে পারে যে- ”তার চাওয়া না চাওয়ার ব্যাক্তিগত কোন মূল্য নাই এবং অন্য মানুষ চাইলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তার শরীর স্পর্শ করতে পারে এবং এটি দোষের কিছু নয়। ”
আমদের সবার মনে রাখা উচিত যে বাচ্চাদের কিন্তু যে কোন বিষয় নিয়ে নিজস্ব মতামত থাকে। কোন শিশু যদি বারবার এমন ইচ্ছের বিরুদ্ধে আদর করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তাহলে সত্যিকারের যৌন নির্যাতনকারী কেউ যখন অসৎ উদ্দেশে তার শরীরে হাত দিবে তখন কিন্তু তার খারাপ লাগলেও সে চুপ করে থাকবে। সে তখন ভাবতে পারে প্রতিবাদ করা বা অভিভাবক কে জানালে সে বকা খেতে পারে।


তাই কখনোই কোন শিশুকে অন্য কাউকে আদর করতে জোর করা উচিত না। জোর করে আদর না করে বা আদর না নিয়ে আমরা সবাই এভাবেও বলে দেখতে পারি-
”আমি কি একটি চুমু পেতে পারি?”
”তুমি যদি মনে কর তাহলে আঙ্কেল/ আন্টি কে একটু আদর করে দিতে পার”
”তুমি কি দাদীকে একটু জড়িয়ে ধরে বাই বলবে? ”
যদি শিশুটি নিজ আগ্রহী হয়, খুবই ভাল। আর যদি নাও হয় তাও এটা এমন কোন বড় ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে আমরা অভিভাবকেরা অন্যদের হাসিমুখে বলতে পারি আজ যখন ও চাচ্ছেনা, অন্য কোনদিন । যে বুঝার সে শিশুটির ইচ্ছে টাকে সম্মান করবে আর যে বুঝার না তাকে অনেক বুঝালেও বুঝবেনা।


আর অভিভাবকদের এই আচরণ থেকে শিশুটিও বুঝতে পারবে তার হ্যাঁ বা না এর গুরুত্ত তার বাবা- মা দিয়ে থাকে।
আর তাছাড়া একটা বাচ্চাকে সবসময় শরীর ছুয়ে ই বা আদর করতে হবে কেন? তার বদলে বাচ্চাদের সাথে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে মুষ্টি তে হালকা ঘুষি বা হাই ফাইভ করা অথবা দূর থেকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়েও বাচ্চাদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা যায়। তবে সম্পর্ক গভীর হলে বাচ্চা যদি নিজ থেকে এসে আদর চায় সেটা অন্য ব্যাপার।
আমি জানি আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে বাচ্চার এমন আচরণ হয়ত আশেপাশের মানুষ নেতিবাচক হিসেবে দেখবে সেক্ষেত্রে আমরা তাদের বলতে পারি কেন এই পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে সত্যিই শিশুটিকে ভালবাসবে তার জন্য চিন্তা করবে এবং যে সত্যি শিশুটির ভাল চায়, সে কখনই বিষয়টিকে অন্যভাবে নিবেনা।

বরং উদ্যোগটির প্রশংসা করবে।
আর তার পরেও যারা নেতিবাচক কথা বলতে থাকবে তাদের অগ্রাহ্য করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখতে হবে কিছু মানুষের উল্টা পাল্টা কথার চাইতেও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ একটি শিশুর সুন্দর এবং নির্মল শৈশব নিশ্চিত করা।
৩) সবসময় ভাল হয়ে চলবে এমন উপদেশ না দিয়ে অবস্থা ভেদে যেন উপদেশ গুলো পরিবর্তিত হয়:
আমরা প্রত্যেকেই চাই আমাদের শিশুটি নম্র, ভদ্র হোক, সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে চলুক, ভাল একটা বাচ্চা হিসেবে বড় হোক। কিন্তু আমরা যদি সবসময় কোন শিশুকে বলতে থাকি”ভাল হয়ে চলবে, বাধ্য হয়ে চলবে” এটা কিন্তু তাকে এমন মেসেজ ও দিতে পারে যে অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে চলাটাকেই বা বড়দের সব কথা শোনাকে সবার চাইতে বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

যৌন নির্যাতককারী কিন্তু এমন শিশুই খুঁজে বেড়ায় যে বিনয়ী, এবং পাল্টা প্রতিবাদ করবেনা বা কিছু জিজ্ঞেস করবেনা বরং চুপচাপ সব কিছু মেনে নিবে।
তাই বরং আমরা আমাদের বাচ্চাটিকে সবসময় ভাল হবার উপদেশ না দিয়ে অবস্থাভেদে উপদেশ দেয়, যেমন যখন স্কুলে রেখে আসব তখন বলতে পারি- ”ক্লাসে মনযোগী হও বা ঠিকমত শিখার চেষ্টা কর” বিকালে খেলতে যাবার সময় বলতে পারি- ”বন্ধুদের সাথে মিলে মিশে মজা করে খেলবে” আবার যখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা কোন উৎসবে যাবে বাচ্চাটি তখন বাবা মা বলতে পারেন-”সময়টা মজা করে কাটাও, সাবধানে থেক” ।
এমন সময় ভেদে অবস্থা ভেদে আমাদের শিশুদের প্রতি আচরণ এবং মেসেজ বদল হলে শিশুটি এটি বুঝবে যে সে যদি বাবা মাকে এমন কিছু বলে যেটা ভাল না তবুও যে কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বা অন্য রকম পরিবেশেও তার আচরনের প্রতি তার বাবা-মায়ের বিশ্বাস রয়েছে।
(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত...)
সচলায়তনে প্রকাশিত আমার প্রথম লেখাটি ছিল চাইল্ড সেক্স অ্যাবিউজ বা শিশু যৌন নির্যাতন নিয়ে।
সেই লেখাটিতে আমি নিজের জীবনের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের অভিজ্ঞতাসহ এর প্রতিকারের উপর হালকা আলোকপাত করেছিলাম।

সেদিন ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাচ্চাদের নিয়ে লেখা একটি ব্লগে একজন মনঃচিকিৎসবিদের শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের উপর চমৎকার এবং গ্রহণযোগ্য কিছু পরামর্শ পড়েছিলাম। সেটি এখানে দুই খণ্ডে বিস্তারিতভাবে লিখার চেষ্টা করলাম।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.