চ্যালেঞ্জ আছে, শঙ্কাও কম নয়
ফকির ইলিয়াস
===========================================
আলোচনা-সমালোচনা যতোই হোক না কেন, বিদেশের সব রাষ্ট্রই যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়টি নিজেদের মাঝে সমাধান করতে বলে। একই ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশের বেলায়ও। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। এটাই নিয়ম। কারণ বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করবে এ দেশের মানুষ।
বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। এমপিরা শপথ নিয়েছেন। শপথ নিলেন মন্ত্রীরাও। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হু মু এরশাদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়েছেন। এটাই চাইছিলেন এরশাদ।
গেলো পাঁচ বছর যাবৎ তার এই খায়েশ ছিল। তা শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়েছে। এরশাদ জয়ী হয়েছেন আপাতত। একই সঙ্গে পরাজয় হয়েছে দেশে পরিশুদ্ধ গণতন্ত্র চর্চার। ‘রাজাকারের চেয়ে স্বৈরাচার ভালো।
’ এই যুক্তি অনেকবার দেখিয়েছেন বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবী। খালেদা জিয়া, রাজাকার নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে মন্ত্রিত্বের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সেটা করেননি। বিএনপি বলেছে, এটা একতরফা নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ বলছে, তারা সংবিধান রক্ষা করছে।
সংবিধান বাংলাদেশে অনেকভাবেই সংশোধিত হয়েছে। পনেরোতম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিপুপ্ত করে মহাজোট। এটা ছিল মহাজোটের একটি একচেটিয়া শক্তি পরীক্ষা। কারণ বিএনপির ২৮ জন এমপি নিয়ে ভোটাভুটির কোনো সুযোগ বিএনপির ছিল না। এর আগে যে প্রশ্নটি আসে, তাহলো বিএনপি ২০০৮-এর নির্বাচনে এমন পরাজয় বরণ কেন করেছিল? এর প্রধান কারণ ছিল, দলটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবক্ষয়।
মীর শওকত আলী কিংবা আজকের এলডিপির অলি আহমেদও সেদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন বিএনপির জঙ্গিবাদ প্রিয়তা নিয়ে। তারা দল ছেড়েছিলেন সে কারণেই।
বলা দরকার, বিএনপি যদি মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক না হতো, তাহলে আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অন্যরকম হতো। এই কথাটি এসেছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেও। বিদেশী সংবাদ মাধ্যমই প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি-জামাতের গাঁটছড়া নিয়ে।
অবশ্য একটা আশার কথা শুনিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় জোটপ্রধান খালেদা জিয়া জামাতে ইসলামীর সঙ্গে তার দলের স্থায়ী আঁতাত নেই বলে জানিয়েছেন। জামাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি সময় এলে বিবেচনা করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসকে খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসায় এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে সরকারের দাবি মোতাবেক জামাতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে খালেদা জিয়া উত্তরে এ কথা বলেন।
নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে ‘সহিংসতা’ এবং ‘জঙ্গি’ জামাতকে ছেড়ে সংলাপে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘যতোদিন বিএনপির কাঁধে জামাত থাকবে ততোদিন কোনো গঠনমূলক আলোচনা সম্ভব নয়। ’ বিবিসি বাংলাকে দেয়া অপর এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানের উত্তরে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী’ নির্দেশনা দিতে পারেন না। তিনিও জামাতের সঙ্গে ছিলেন। তিনি জামাতের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির কথাও ভেবেছিলেন।
আমরা তার নির্দেশনা অনুযায়ী দল চালাবো না। আমাদের দল স্বাধীনভাবে চলে। সুতরাং আমরা আমাদের দলকে নিজেদের পন্থাতেই চালাবো। ’ অবশ্য এটা অনেকেরই জানা, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু এবং সাম্প্রতিক সহিংসতার পর বিএনপির কিছু নীতিনির্ধারক জামাতকে নিজেদের মিত্র ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তারা জানান, জামাতকে জোট থেকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে কিছু অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।
কিন্তু তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
এদিকে শোনা যাচ্ছে, আগামী ২৬ মার্চ ২০১৪, স্বাধীনতা দিবসে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির জামাতের সঙ্গত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। আর যদি তারা এটা সম্ভব করতে পারেন, তবে বাংলাদেশে একটি নতুন ধারার রাজনীতির দ্বার উন্মোচন হবে। যা হবে বিজয়ের পর একটি রাজনীতির মাইলফলক।
আমরা জানি, এক সময় আওয়ামী লীগও জামাতকে প্যারালাল সঙ্গে নিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জামাতের সঙ্গ ত্যাগ করতে পেরেছে। তাহলে আজ বিএনপি পারবে না কেন? মহাজোট সরকারকে হটাতে বিএনপি সব চেষ্টাই করেছে। কিন্তু সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। এই না পারার প্রধান কারণটি হলো, দেশে এখন সজাগ মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
এরা আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করতে পারে। কিন্তু তারা সহিংসতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ চায় না। তারা সাম্প্রদায়িক হামলা দেখতে চায় না। আর চায় না বলেই ভবনকেন্দ্রিক বিএনপির নেতাদের ডাকা আন্দোলন ফানুসের মতো উড়ে গেছে বারবার। এখন কথা হচ্ছে, এই দশম জাতীয় সংসদের সরকার কতোদিন বহাল থাকবে? সেটাও নির্ভর করবে বিএনপির আচরণের ওপর।
বিস্ময়ের কথাটি হলো, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হলেও তারা মন্ত্রিত্বও নিয়েছে। জাতীয় পার্টি এই যে দ্বৈতনীতি গ্রহণ করলো, তাতে আওয়ামী লীগের মদত- লীগের জন্য ক্রমশ কাল জয়ে দাঁড়াতে পারে। সমঝোতার সরকার কিংবা জাতীয় সরকার কখনই বড় একটি রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এতে বরং ভাগ-বাটোয়ারার হিসেবই বাড়ে। ফড়িয়া শ্রেণী লাভবান হয়।
খুবই দুঃখের কথা, বাংলাদেশ সবদিক থেকেই এখন ক্ষতির মুখোমুখি। কিছু রাজনীতিবিদ লুটপাট করছে। আর কিছু রাজনীতিবিদ জ্বালাও-পোড়াও করছে। নির্বাচনের পর যে লুটপাট হয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তা মানবতার সকল নীতিকে প“লিত করেছে। এটা রুখতে সরকারের ব্যর্থতাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
এই ধ্বংসযজ্ঞ আর কতো চলবে? খবর বেরিয়েছে, লাগাতার অবরোধ ও লাগাতার হরতাল কর্মসূচি থেকে সরে আসছে বিএনপি। নতুন ধারায় সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার কথা ভাবলেও আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপি ও জোটের শরিকদের মধ্যে মতভিন্নতাও দেখা দিয়েছে। জোটের অন্যতম শরিক জামাতে ইসলামী চায় আন্দোলনে ঘুরে দাঁড়াতে ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে অবরোধের পাশাপাশি টানা কয়েক দিনের হরতাল ডাকতে। এমনকি ২০ জানুয়ারির মধ্যে এ কর্মসূচি পালনের কথাও বলছে তারা।
বিএনপির একটি অংশ জামাতের এ অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও অন্য অংশের তাতে সায় নেই।
তারা বলছে, কঠোর কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততা হ্রাস পাওয়ায় আপাতত তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তারা জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর মতো কর্মসূচির পক্ষে। তবে এ অংশের নেতারা নতুন সরকার শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানোর আগেই কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও পক্ষে। বিএনপির বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শক্তি যেমন সমালোচনা করছে, তেমনি বিরোধী জোটের অবরোধকে ঘিরে নাশকতারও সমালোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রভাবশালী একাধিক দেশ সংঘাতের বিপক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছে।
একই সঙ্গে এ ধরনের কর্মসূচি থেকে সরে আসারও আহ্বান জানিয়েছে তারা। বিশেষ করে আমেরিকা নাশকতার জন্য জামাতের সঙ্গ ত্যাগের কথাও বলেছে বিএনপিকে।
বিএনপি মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবে না। তা ঠেকাতে পারেনি জামাত-বিএনপি জোট। এই ধারাবাহিকতায় যদি একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়, সেখানেও বিএনপিকে অনেক কিছুই ছাড় দিতে হতে পারে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নতুন মন্ত্রিপরিষদে বিতর্কিত অনেকেই স্থান পাননি। দেশের মানুষ, মিডিয়া ও বিবেকবানদের সমালোচনা শেখ হাসিনা যে অনুধাবন করেছেনÑ সেটা তারই প্রতিফলন। কিন্তু এখনো ছয়টি মন্ত্রণালয় রয়ে গেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। মন্ত্রিপরিষদ, সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা ও জনপ্রশাসন এই চারটি মন্ত্রণালয় সবসময়ই পদাধিকার বলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে। এখন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও রয়ে গেছে শেখ হাসিনার হাতে।
তাছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়েও পূর্ণ মন্ত্রী নেই। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো আগামীতে ঐ দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত নেতারা যেন খালি থাকা মন্ত্রীর পদগুলো বাগিয়ে না নেয়। এই প্রজন্ম দেখলো রাজাকারমুক্ত একটি নির্বাচন। ষোলো কোটি মানুষের দেশে এটি একটি আনন্দ সংবাদ তো বটেই। সরকার চলুক এর সঙ্গে প্রস্তুতি নেয়া হোক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের।
সেই সঙ্গে বন্ধ হোক সন্ত্রাসের তা-ব । এই সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। সেই সঙ্গে আছে শঙ্কাও। শঙ্কার প্রধান কারণ, গেলো মহাজোট সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতা। আমরা দেখেছি, প্রায় চল্লিশজন প্রাক্তন মন্ত্রী বর্তমান ক্যাবিনেট থেকে বাদ পড়েছেন।
কেন বাদ পড়েছেন? দেশে এখন অবাধ, মুক্ত মিডিয়ার বিচরণ রয়েছ। এর ফলেই অনেক মন্ত্রী, এমপির দুর্নীতির চিত্র এখন মানুষের মুখে মুখে। এটা প্রধানমন্ত্রীরও অজানা নয়। এসব দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। বিচারের আওতায় আনা দরকার।
তা না করতে পারলে রাজনৈতিক শঙ্কা শুধুই বাড়বে। সরকারের প্রতিপক্ষ সুযোগ পাবে। মনে রাখা দরকার, যে পরিস্থিতিতে এই সরকার গঠিত হয়েছে, তা অনেক রক্তস্রোতের সাক্ষী। অনেক মানুষ বলির শিকার হয়েছেন এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে গিয়ে। যে নিরপরাধ মানুষদের বাসে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, যে পুলিশ সদস্যদের আক্রমণ করে মারা হয়েছে- তাদেরও তো এই বাংলাদেশে বাঁচার অধিকার ছিল।
এই সরকার তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে- এটাই সময়ের দাবি।
---------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০১৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।