একজন বাঙ্গালী বলছি!
বহু বছর আগে, অর্থাৎ স্বাধিনতার আগে স্কুলজীবনে দেশ সম্বন্ধে যখন সামান্যই বুঝতে চেষ্টা করছি, তখন থেকেই শাহ্ববাগের মোড় আমার মনে গভীর ভাবে দাগ কেটে গিয়েছিলো। তখন ছিলো ভাষা আন্দোলনের গন জাগরণ। শাহবাগের মোড়(তৎকালীন পি,জ’র মোড়) থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত প্রতিদিন থাকতো উত্তাল। সহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষেনের পর স্থানটি ইতিহাসে জায়গা করে নিল। স্বাধিনতার পর মোড়টি আবার নতুন করে মাত্রা পেল।
ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধিনতা যুদ্ধ, এই দুইমিলে তা পেয়েগেলো পর্বতসম দৃঢ়তা। যতদিন এই দেশ থাকবে, পৃথিবী থাকবে ততদিন শাহবাগ মোড় কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে সবার মাঝে, এবং তাই জানান দিবে আমাদের অনাগত সন্তানদের।
কিন্তু, বর্তমান গনজাগরন মঞ্চ; এই শাহবাগ মোড়কে বাঙ্গালীর হৃদয়ে আবারো নতুন করে স্থান করে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মহান নেতা ডাঃ ইমরান এইচ সরকার স্থানটিকে চিরদিনের জন্যে বাঙ্গালীদের হৃদয়ে এক “বিপ্লবমঞ্চ” বানিয়ে ভক্তিমার্গ করে দিয়েছেন। বিশ্বের তাবৎ বাঙ্গালী এখন এখানে এসে তাঁদের ইতিহাস ঐতিয্যকে স্বরণ করবেন অনন্তকাল।
জাতীয় ক্রান্তিকালে এখানে এসে নতুন করে শপথ নিবেন বারবার। স্থানটিকে নিয়ে আমার ছিল ভীষণ দুর্বলতা। আর সেকথা মনে রেখেই কয়েকবছর আগে, আমার লেখা ‘নিন্দিত নান্দনী’ উপন্যাসটিতে শাহ্বাবাগের মোড়ের একটা সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছিলাম। যা এখন এসে সময়ের সাথে আবার নতুন করে হাত মেলাচ্ছে।
বইটার প্রথম প্রকাশিত সংখ্যার ৪৫ পৃষ্ঠায় এবং দ্বিতীয় প্রকাশ (২০১৪ একুশে বইমেলা) সংখ্যার ৮৪ পৃষ্ঠায় তারই কিছুটা উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করলামঃ-
“সি এন জি ওটোরিক্সা থেকে শাহ্ববাগের মোড়ে নামলো তারা।
এদিকটায় এলেই এই ঐতিহাসিক মোড়ে কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায় হানিফ। তাঁর জীবনের এক করুন স্মৃতি এখানে লুকিয়ে আছে। হানিফের শহিদুল চাচা খুব ভালো ছাত্র ছিরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা এখানেই তাঁকে গুলিকরে হত্যা করে।
এই স্মৃতিটুকু ধরে রাখার মতো বংশে একমাত্র হানিফ ছারা আর কেউ হয়তো জীবিত নেই। এখানে যখনই আসার সুযোগ হয়, প্রথমেই তিনি ঘৃণাভরে পাকিদের উদ্দেশ্যে একটা নতুন গালী বয়ান করেন। আজ বয়ান করলেনঃ“ বিষ্টাখেকো নরকের কিট, তোদের বিচারের ভার আমি আল্লাহ্ পাকের হাতেই ছেরেদিলাম”। যতদিন এ পৃথিবীতে হানিফ বেঁচে থাকবেন ততদিন এ নাপাকিদের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করে যাবেন তিনি। আর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে টোকাইদের কাছ থেকে কেনা একগুচ্ছ ফুল পথের পাশে রেখে দেন।
সবসময় যেমনি করেন; মোড়ের দিকে মুখকরে তার চাচা ও শহীদদের আত্মার শান্তির জন্যে আজো দোয়া করলেন; আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, শানুকে নিয়ে রমনা পার্কের দিকে হাঁটা ধরলেন তঁরা।
হানিফ তাঁর স্মৃতি হাতড়িয়ে শানুকে বলতে লাগলেনঃ ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ছাত্রাবাস একযোগে আক্রমন শুরু করে। সে সময় হানিফের ছোট চাচা অনার্স পড়তেন। থাকতেন মোহসিন হলে। গভীর রাতে হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হলে, তাঁর চাচা সহ কয়েকজন ছাত্র এদিক দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন কোথাও।
কিন্তু এখানে ওৎ পেতেথাকা পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে বেশ কয়েকজন ছাত্রের সাথে শহিদুল চাচাও শহীদ হন। আহত হয়েও বেঁচে যাওয়া তাঁদের গ্রামের এক ছাত্র বাড়িতে এসে এই মর্মান্তিক খবরটি জানিয়ে যায়। হানিফ তখন ক্লাশ সিক্সএর ছাত্র। ……..” ।
আনেক আগে লেখা উপন্যাসের এই হানিফ এখন বেঁচে আছেন কিনা জানিনা।
বেঁচে থাকলেও এখন তিনি হয়তো পৌঢ়। তিনি’কি এখন শাহ্ববাগে যান ? তাও জানিনা! কিন্তু শাহ্ববাগ মোড়ে গনজাগরণ মঞ্চে অংশ নেয়া প্রতিটি ব্যক্তির চেহারায় পাথর সদৃশ দৃঢ়তা দেখে আমার গল্পের সেই হানিফের কথাই শুধু মনেহয়। যিনি তাঁর চাচার হত্যাকারীদের বিচারের ভার একদিন শুধু আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারন তিনি তখন শঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে ; এদেশে কোনো দিনই যুদ্ধাপরাধী বিচার হয়তো আর হবেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।