বিগত পাঁচ বছরে যেসব কেলেঙ্কারির জন্য সরকার বিতর্কিত হয়েছিল, চলতি মেয়াদেই সেগুলোর বিচার হবে। আইনের আওতায় আনা হবে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির খলনায়কদের। প্রভাবশালীরাও এক্ষেত্রে নিস্তার পাবেন না। শীঘ্রই তাদের আটক করা হতে পারে। অন্যদিকে, হলমার্ক-ডেসটিনিসহ সব আর্থিক অনিয়মের দায়ে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমনকি হলফনামায় বিশাল সম্পদ দেখানো মন্ত্রী-এমপিদের ডাক পড়বে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
বিগত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরের সাফল্যগুলো তিন-চারটি কেলেঙ্কারির কাছে ম্লান হয়ে যায়। বিদ্যুৎ খাতে নজর কাড়া সাফল্য রয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার নির্মাণ ও সড়ক চার লেন করার কাজ দৃশ্যমান করা, হাতিরঝিল প্রকল্প, শিক্ষা, কৃষি খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন রয়েছে সরকারের। বিপরীতে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাও রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের এ কেলেঙ্কারিতে কিছু রাঘববোয়াল জড়িত। ডেসটিনি মূলত ব্যক্তি খাতের কেলেঙ্কারি। সরকারের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই।
কিন্তু ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকারকেই দায় নিতে হয়। আর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির লোকজনও জড়িত ছিলেন। এসব ঘটনায় চলতি মেয়াদে সব পক্ষকেই বিচারের মুখোমুখি কররতে চায় সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। সরকারের দায়িত্বশীল একটি মহলের মতে, হাতে গোনা কয়েকজনের ব্যক্তিগত দুর্নীতির দায়ভার কোনোভাবেই সরকার নিতে পারে না। এ কারণে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমনকি সর্বশেষ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপিদের ব্যক্তিগত হলফনামা নিয়েও খোদ প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী, মন্ত্রী হয়ে কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়াতে পারেন না। এরপরও যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ডাক পড়বে দুদকে।
সূত্র জানায়, বিগত সরকারে ছিলেন এমন পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন এমপির সম্পদের হিসাব তদন্ত শুরু করেছে দুদক।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এদের ব্যক্তিগত হলফনামায় দেওয়া সম্পদের হিসাবের সঙ্গে চলতি সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। পাহাড়সম সম্পদের হিসাব দেখে সরকারের শীর্ষ পর্যায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। মূলত দুর্নীতির বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ায় দুদক তদন্ত শুরু করে। সব কেলেঙ্কারির বিচারে সরকারি উদ্যোগকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'নতুন সরকারের সামনে কয়েক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
এগুলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্তৃত। সামাজিক চ্যালেঞ্জের প্রথমেই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের কিছু কর্মী-সমর্থক সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। ' তিনি বলেন, 'কঠোরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
জন-আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যও দুর্নীতি দমন জরুরি। আমরা দেখেছি, অনেকের সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার চিত্র সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ ধরনের আরও অনেক চিত্র হয়তো সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত যায়নি, ধারণা করা যায়। এসব ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করে যাদের আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় জন-আস্থা তো কমবেই, অন্যরাও এভাবে দুর্নীতি করতে উৎসাহ পাবে।
দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন, আইনের আওতায় আনতেই হবে। ' খ্যাতিমান এ অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার এবং জন-আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে গত মেয়াদে অসম্পূর্ণ মেগা প্রকল্পগুলো এবার শেষ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাম আসবে সর্বাগ্রে। আর এটা নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মাণ সম্ভব। খলীকুজ্জমান আহমদ আরও বলেন, 'সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু কাজও নতুন সরকারকে প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে।
এর একটি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। তাদের জন্য মানবতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি জরুরি। তাদের সুশিক্ষা, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রতি আরও নজর দিতে হবে। কারণ তারাই দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ। '
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, 'আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গত সরকারের অনেক ভালো কাজ ম্লান হয়েছে দুর্নীতির কারণে।
এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। তারা অনেক দুর্বলতা দেখিয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির আগে মন্ত্রণালয় সিকিউরিটিজ এঙ্চেঞ্জ কমিশনকে কোনো রকম তদারকি করেনি। এ কেলেঙ্কারির জন্য মূল দায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়। ' ইব্রাহিম খালেদ নতুন সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'সরকারি ব্যাংকগুলোতে দলীয় লোকজন পরিচালক হিসেবে মনোনীত করা হলেও যেন সৎ লোকজন নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি দেখবে দুদক। তবে এ ঘটনা ঘটার আগে প্রধানমন্ত্রীকে সজাগ থাকতে হবে। মন্ত্রী-এমপিরা অবৈধভাবে টাকা আয় করছেন কিনা, তা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খবর রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রীকেই। পাশাপাশি গ্রামে-গ্রামে ছাত্রলীগ-যুবলীগের লুটতরাজ থামাতে হবে। আওয়ামী লীগকে খারাপ লোকজনের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।
'
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি : গত মেয়াদে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে কেলেঙ্কারির বৃহৎ এই অধ্যায় রচিত হয়। দুর্নীতি রোধ সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার হলেও এ কেলেঙ্কারির ঘটনা দুর্নীতি প্রশমনের ওয়াদা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটিয়ে এই খাত থেকে প্রভাবশালী সুপরিচিত সিন্ডিকেট অন্তত ৪২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন অন্তত ৩২ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। সর্বস্ব হারিয়ে আত্দহননের পথ বেছে নেন একাধিক বিনিয়োগকারী।
সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে পর্যন্ত শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এমনকি সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলেও হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়া খলনায়কদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। উল্টো দোর্দণ্ড দাপটের সঙ্গে তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। শেয়ারবাজারে সংঘটিত ভয়াবহ কারসাজি তদন্তে কৃষিব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে সরকার ও বিরোধী দলসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারসাজিতে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদন নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সরকারের ভালো কাজ ম্লানে এ কেলেঙ্কারি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। কারণ মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হয় এই কেলেঙ্কারির ঘটনা। ২০১০ সালের ডিসেম্বর ও ২০১১ সালের জানুয়ারির শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির এ ঘটনায় যে মামলা দায়ের করে এসইসি, তাতে অভিযুক্ত পাঁচ বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে বিচারকাজও শুরু করা যায়নি। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে গত বছর ২১ আগস্ট আরও দুটি মামলা করা হয়। তারও বিচার শুরু হয়নি।
হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেঙ্কারি : ২০১২ সালে আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ছিল সোনালী ব্যাংক থেকে অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্দসাৎ। হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হোটেল রূপসী বাংলা শাখা থেকে এই অর্থ বের করে নিয়ে যান। অর্থ আত্দসাতের ঘটনায় পুরো ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ডেসটিনির অবৈধ ব্যাংকিং, দুর্নীতি ও প্রতারণার তথ্য ফাঁসের ঘটনাটিও যথেষ্ট উদ্বেগের জন্ম দেয়। ডেসটিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান না হলেও এর ৬০ লাখ গ্রাহকের সঞ্চয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তার।
ডেসটিনিসহ বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় আমানতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিগত সরকারের কলঙ্কজনক আরেক অধ্যায়ের জন্ম দেয় হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি। সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তিদের যোগসাজশে ব্যাংকটির প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্দসাৎ করে হলমার্ক গ্রুপসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের ৩১ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে চাঞ্চল্যকর এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজনের নাম উঠে আসে।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল।
সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর ফাইল দুদকে : এবারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি মহাজোট সরকারের ৩৪ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া হলফনামায় উঠে আসা সম্পদের বিবরণ, বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, দলাদলি-কোন্দলে জড়িত থাকার অভিযোগ এদের অনেককে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া হয়নি। মনোনয়নপত্র দাখিলের সঙ্গে জমা দেওয়া সরকারদলীয় সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের এবারের প্রার্থিতার হলফনামায় আয় বৃদ্ধির অবিশ্বাস্য চিত্র পাওয়া গেছে। বর্তমান ও সাবেক ছয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ নয়জনের বিপুল পরিমাণ সম্পদের অনুসন্ধানে নামছে দুদক।
এর মধ্যে ছয়জন সরকারি দলের সদস্য। সূত্র আরও জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কিছু ব্যক্তির অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদক কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য দুদককে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য থেকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সাতক্ষীরার সংসদ সদস্য আবদুল জব্বার, রাজশাহীর এনামুল হক ও কঙ্বাজারের আবদুল রহমান বদির বিরুদ্ধে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।