আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোগের নাম থ্যালাসেমিয়া , খুবই মারাত্নক একটি রোগ । খুবই ব্যায়বহুল এই রোগ সম্পর্কে আসুন জেনে নিই বিস্তারিত

স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্ন হিসেবে রেখে দিতে চাই না , বাস্তবতার আলোয় স্বপ্নগুলো আরো রঙ্গিন করতে চাই । দম্পতি ও ভালবাসার বিয়ে। তাদের স্বপ্ন আর ভালবাসার সংসার পূর্ণ করতে একদিন ফারহানার কোল জুড়ে আসে ছোট্ট নিঝুম। গল্পটা এখানে শেষ করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু হঠাত্ই বদলে যায় এই সুখের দৃশ্যপট।

নিঝুমের বয়স যখন এক কি দেড় তখন থেকেই তাকে কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাতে থাকে। সাথে খাওয়ায় অরুচি। বাবা মায়ের উদ্ব্বিগ্ন মন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নিঝুমের রক্তে ধরা পড়ে একটি জটিল রোগ থ্যালাসেমিয়া। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ।

এই রোগ শরীরে রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে যা রক্তের মধ্যে ত্রুটিযুক্ত হিমোগ্লো-বিনের জন্য হয়ে থাকে। হিমোগ্লোবিন মানুষের রক্তের খুব দরকারি একটি উপাদান। এটি রক্তের একটি বিশেষ রঞ্জক পদার্থ যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহণ করে। স্বাভাবিক মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিন সাধারণত দুটি আলফা ও দুটি বিটা চেইন বহন করে। এই দুটি চেইনের যেকোনো একটি পরিমাণে কম থাকলে সৃষ্টি হয় থ্যালাসেমিয়া রোগের।

দু’রকমের থ্যালাসেমিয়া: থ্যালাসেমিয়া দু’টি প্রধান ধরনের হতে পারে, আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। যাদের হিমোগ্লোবিনে আলফা অথবা বিটা চেইন পরিমাণে কম থাকে, তাদের বলা হয় আলফা অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া। আলফা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিত্সা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। পরিসংখ্যাণ যা বলে: প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটির বেশি লোক বিভিন্ন ধরনের বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। ফলে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যাণ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশে তিন শতাংশ লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক, চার শতাংশ অন্যান্য ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন রোগের বাহক। অর্থাত্ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ লোক এ রোগে আক্রান্ত।

দক্ষিণ এশিয়ার অপর একটি দেশ মালদ্ব্বীপে এই রোগের হার সর্বোচ্চ। প্রায় ১৮ শতাংশ। থ্যালাসেমিয়ায় কি হয়: রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুকাল তিন মাস। লোহিত কণিকা অস্থিমজ্জায় অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং তিন মাস শেষ হলেই প্লীহা-এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। থ্যালাসে-মিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুকাল অনেক কমে যায়।

তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আয়রণ জমা হয়ে হৃদপিন্ড, প্যানক্রিয়াস, যকৃত, অন্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত যে লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা যায়: ১/অবসাদ অনুভব ২/দূর্বলতা ৩/শ্বাসকষ্ট ৪/মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ৫/অস্বস্তি ৬/ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস) ৭/মুখের হাড়ের বিকৃতি, নাকের হাড় দেবে যাওয়া (মঙ্গোলয়েড ফেস) ৮/শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া ৯/পেট ফুলে যাওয়া ১০/গাঢ় রঙের প্রস্রাব চিকিৎসা : থ্যালাসেমিয়ার চিকিত্সা বলতে রক্ত পরিসঞ্চালন। আর মাঝে মাঝে অতিরিক্ত পরিসঞ্চালন জনিত আয়রণ উদ্ধৃতি ঠেকাতে আয়রণ চিলেশন থেরাপী, সাধারণত: ডেসফেরিঅক্সামিন দেওয়া হয়।

ওষুধের চিকিত্সা বলতে এটুকুই। প্লীহা বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে সেটা ছোট করে দেওয়া হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হারটা কমে আসে কিছুটা। মূলত বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন হলো এর স্থায়ী চিকিত্সা। এটা খুবই ব্যায় বহুল।

আমাদের পাশের দেশে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আমাদের দেশে এই চিকিত্সা এখনো শুরু হয়নি। তবে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এটা বাংলাদেশেও করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজী বিভাগ ও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বোনম্যারো চিকিত্সা শুরু করার জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি চলছে। এটা আশার কথা।

নিয়মিত যা করণীয়: ১। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো। ২। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রাম বা ডেসিলিটার রাখার চেষ্টা করতে হবে। ৩।

হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা নেওয়া। ৪। শিশুরোগীর ক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস অন্তর উচ্চতা, ওজন, লিভার ফাংশন পরীক্ষা করা। ৫। আট থেকে ১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর রক্তে লৌহের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।

৬। রক্তে লৌহের মাত্রা এক হাজার ন্যানো গ্রাম বা মিলি লিটারের ওপরে হলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া। ৭। বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করা। ৮।

শিশুর প্রতিবছর বুদ্ধি ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা। প্রতিরোধে চাই সচেতনতা: এ রোগ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি বাড়াতে প্রচার মাধ্যমের ব্যাপক অংশ গ্রহণ প্রয়োজন। টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও, ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ, টুইটারে ব্যাপক আলোচনা দরকার। গর্ভাবস্থায় রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করতে হবে।

বিভাগীয় শহরগুলোতে অন্তত জেনেটিক পরামর্শকেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। এ রোগটি একেবারে নির্মূল করতে জেনেটিক কাউন্সেলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে এই বিশাল সংখ্যার রোগীর যদি আর বৃদ্ধি না চাই, তাহলে এখনই আইন করে আন্ত-থ্যালাসেমিক পরিবারে বিয়ে বন্ধ করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের বাহকদের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করতে হবে বা বিয়ে করলেও তারা সন্তান নিতে পারবে না। আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিত্সার চেয়ে প্রতিরোধই সহজ।

তাই একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ দরকার । থ্যালসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা ঃ বিয়ে করুন রক্ত পরীক্ষা করে , তরুণ-তরুণী ও বন্ধুরা, বিয়ে করুন রক্ত পরীক্ষা করে। দয়া করে বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষা করুন, দেখুন আপনি থ্যাসেমিয়ার ক্যারিয়ার কিনা। পরীক্ষার নাম-হিমোগ্লুবিন ইলেক্ট্রোপ্রোসিস, বারডেমে, পিজিতে, সেনাহাসপাতালে ও আইসিডিডিআরবিতে এ পরীক্ষা হয়। ৪০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা খরচ পড়বে।

বিবাহিত জীবনে ভয়ানক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বিয়ের পূর্বেই প্রেমিকা-প্রেমিকারা ঢুকে পড়ুন একটি হাসপাতালে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ০৭ জন লোক থ্যালাসেমিয়ার ক্যারিয়ার। রক্ত পরীক্ষ করে বিয়ে করার জন্য অপরকেও উৎসাহিত করুন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এ রোগটি ভয়াবহ পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি করবে। মনে রাখবেন, একটি পরিবারে একটি থ্যালাসেমিয়া রোগির জন্ম হওয়া মানে সারাজীবনের জন্য ওই পরিবারের সুখ-শান্তি শেষ হয়ে যাওয়া।

এতে পরিবারটি শুধু আর্থিক সংকটেই নিপতিত হয় না-প্রিয়জন হারানোর ভয়েও সবসময় আতঙ্কিত থাকে। এবং শেষমেশ একদিন তাদের হারিয়ে সারাজীবন চোখের জলে ভাসে। পরিশেষে: সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় নয় লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। বাংলাদেশে এর সংখ্যা হচ্ছে আনুমানিক ১০ হাজার। বিশ্বের কয়েকটি দেশ, যেখানে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশী ছিল, সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচির মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রায় শূন্য বা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে তারা।

উদাহরণস্বরূপ সাইপ্রাসের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৭০ সালে সেখানে প্রতি ১৫৮ জন শিশুর মধ্যে একটি শিশু জন্ম নিত থ্যালাসেমিয়া নিয়ে, আজ সেখানে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। গ্রিস, ইতালিসহ অনেক দেশই থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছে। এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরও। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চাই ব্যক্তিগত সচেতনতা ।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.