লাকসামের সাবেক এমপি ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌরসভা বিএনপির সভাপতি ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির পারভেজ নিখোঁজ হন গত ২৭ নভেম্বর। দীর্ঘ প্রায় দুই মাসেও তাদের খোঁজ মেলেনি। তাদের স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দফতরে ধরনা দিয়েও নিখোঁজদের সন্ধান পাননি। কেউ বলতে পারেননি এই দুই নেতা কেমন আছেন, কী অবস্থায়, কোথায় আছেন।
গত রবিবার ভোরে সাতক্ষীরার তালা এলাকার একটি চিংড়ি ঘের থেকে ছাত্রদল নেতা আজহারুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
গতকাল ভোরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আজহারুল মারা যান। পুলিশ জানায়, সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকালে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আজহারুল। আজহারুলের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় ছয়টি মামলা আছে। বিএনপি দাবি করছে এ পর্যন্ত ১৮৭ নেতা-কর্মীকে গুম হয়েছেন। এদের অনেককেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে নিয়ে যায়।
তাদের খোঁজ মেলেনি। তবে বিএনপি নিখোঁজ ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরবরাহ করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামী দাবি করেছে, ক্রসফায়ারে একদিকে তাদের নেতা-কর্মীরা যেমন নিহত হচ্ছেন, অপরদিকে নিখোঁজও রয়েছেন বহু। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে বন্দুকযুদ্ধ ও গুম আতঙ্ক। এ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই।
বাসাবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থান বেছে নিয়েছেন কেউ কেউ।
জানা গেছে, দেশব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা ও নাশকতা দমনে সরকার হার্ডলাইন নিয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার সময় অনেক রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হয়। নারকীয় হামলা হয় সংখ্যালঘুদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সরকারি অনেক অফিস-আদালতকেও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়।
যানবাহনে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয় নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে। রেলের ক্ষতি করা হয় ভয়াবহ। বিগত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সরকারকে হার্ডলাইন নিতে হয়েছে বলে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) হিসাব মতে, ছয় মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় চার খাতে প্রায় ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প খাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও পর্যটন খাতে দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও যৌথবাহিনীর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। পরবর্তীতে এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ৩১৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬৩ হাজারের বেশি লোককে। একই সঙ্গে চলছে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। প্রতিদিনই গ্রেফতার হচ্ছেন মামলার আসামিরা।
নাশকতাকারী হিসেবে চিহ্নিত তিন হাজারের বেশি ব্যক্তির নামের তালিকা নিয়ে যৌথবাহিনী এ অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে।
অভিযান চলবে : পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে তফসিল ঘোষণার (২৫ নভেম্বর) দিন থেকেই দেশব্যাপী সহিংস তৎপরতা শুরু করেন বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। হামলা করা হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ভোটের পরে যশোর, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দু বসতিতে ১৮টি হামলা চালানো হয়।
এর পর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে দেশব্যাপী অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্র জানায়, নাশকতাকারী ও অপরাধী গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান এই যৌথ অভিযান আরও জোরালো করা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে অভিযানের পরিধিও। আগামী মার্চ পর্যন্ত যৌথবাহিনী এই অভিযান অব্যাহত রাখবে।
বন্দুকযুদ্ধ : যৌথবাহিনীর অভিযান চলাকালে এ পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছেন।
এদের মধ্যে নয়জন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আর চারজনের লাশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় বলে জানা গেছে। জামায়াত-শিবির দাবি করেছে গত শনিবার রাতে সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহে যৌথবাহিনীর সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত তিনজনই তাদের কর্মী।
নিখোঁজের তালিকায় নতুন নাম : ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এসব ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌরসভা বিএনপির সভাপতি ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির। জানা গেছে, রাজনৈতিক সহিংস ঘটনার জের ধরে গত ২৭ নভেম্বর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজসহ ১২ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। পরে ১০ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করা হলেও ওই দুই নেতার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখনো কেউ বলতে পারেনি। তাদের খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশ, র্যাব, বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থা। এ ছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের সামনে থেকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯নং ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নং ওয়ার্ড ছাত্রদল সহসভাপতি আনিসুর রহমান খান, ৭৮নং ওয়ার্ড সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব, ৮০ নং ওয়ার্ড শ্রমিকদল সাধারণ সম্পাদক মিঠুকে।
এরা গত ১ জানুয়ারি জেলাখানায় গিয়েছিলেন কারাগারে আটক তাদের এক সহকর্মীকে দেখতে। এখনও পর্যন্ত এই পাঁচজনের খোঁজ মেলেনি। বিএনপির দাবি, সাজেদুল ইসলাম সুমন, আবদুল হালিম, সেলিম রেজা, সুজন, ফরহাদ, লিটন, রানা, আলআমিন, আশিক, শাহিন, তানভীরসহ আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন এদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।