পৃথিবীর বুকের ফুলফল লতাগুল্মে যার চোখ নেই, সেই শুধু আকাশের চন্দ্র এবং নক্ষত্রের গল্প করে।
৩০ই জানুয়ারি ২০১৪
বহুল আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় হল আজ। এই ঘটনার পুরো ইতিবৃত্তান্ত নিন্মে উল্লেখিত।
**যেভাবে ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান**
চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার ঘাটে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে অস্ত্র আটকের ঘটনা ছিল অনেকটা আকস্মিক। পুলিশের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ে অস্ত্র পাচারকারীরা এবং আটক হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র।
অস্ত্র খালাসের সময় ঘটনাস্থলে প্রথম উপস্থিত সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ও সার্জেন্ট হেলালউদ্দীন ভূঁইয়াসহ পুলিশের একাধিক সদস্য এবং একাধিক ঘাটশ্রমিকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় এ তথ্য জানিয়েছেন তাঁরা। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার সময় তাঁরা বিস্তারিত জানান ১ এপ্রিলের রাতে অস্ত্র আটকের ঘটনা।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রামের বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির হাবিলদার গোলাম রসুলের টেলিফোন পেয়ে সর্বপ্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ও কয়লার ডিপো ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সার্জেন্ট হেলাল উদ্দীন ভূঁইয়া। এই টেলিফোন পাওয়ার আধঘণ্টা আগে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ঘটনাস্থলের পাশের খেয়াঘাট থেকে নৌকা নিয়ে পার হয়ে ওপারের কয়লা ডিপো হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ঘটনার মাত্র চার দিন আগে হেলালকে বন্দর ফাঁড়ি থেকে কয়লার ডিপোতে এবং আলাউদ্দীনকে কয়লার ডিপো থেকে বন্দর ফাঁড়িতে বদলি করা হয়।
এ কারণে তাঁদের বাসা পাল্টানো সম্ভব হয়নি। সিইউএফএল এবং কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ির অবস্থান কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ পারের বিপরীতে। পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা চাকরিতে একই ব্যাচের হওয়ায় তাঁদের মধ্যে আগে থেকেই বাড়তি সখ্য ছিল।
ঘটনাস্থলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্দর ফাঁড়ির দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগেই সাদা পোশাকে সিইউএফএল ঘাটের পাশের খেয়াঘাট দিয়ে একটি নৌকায় নদী পার হন সার্জেন্ট আলাউদ্দীন। তখন ঘাটে কোনো ট্রলার ছিল না।
তবে অস্ত্র আটক মামলার আসামি দীন মোহাম্মদ, আবুল কাশেম মধু, আরজু পাগলাসহ অন্যরা ঘাটে ছিলেন। সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকে ঘাটে দেখে দীন মোহাম্মদ নদী পারাপারের জন্য একটি নৌকা ঠিক করে দেন।
এই নৌকায় ওপারে পৌঁছে ঘাটের পাশে সার্জেন্ট হেলালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরপরই বন্দর ফাঁড়ি থেকে হাবিলদার গোলাম রসুল মুঠোফোনে সার্জেন্ট আলাউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোলাম রসুল জানান, সিইউএফএল ঘাটে অস্ত্র নামছে বলে এক ব্যক্তি টেলিফোনে জানিয়েছে। পরপর দুবার ফোন পেয়ে হেলালকে সঙ্গে নিয়ে আলাউদ্দীন একই নৌকায় কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিয়ে ছুটে যান সিইউএফএল ঘাটে।
সার্জেন্ট হেলাল আগে এখানে দায়িত্ব পালনের কারণে ঘাটের অনেকেই তাঁর পরিচিত ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই হেলালকে সঙ্গে আনার এটাও অন্যতম কারণ ছিল বলে আলাউদ্দীন জানান।
দুই সার্জেন্ট এ পারে আসার পর দেখেন, দুটি ট্রলার ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় আছে। বড়টি ঘাটের পাশে এবং অন্যটি সেটার গায়ে লাগানো।
এরপর দুই সার্জেন্ট ট্রলার দুটিতে কী হচ্ছে, তা দেখতে যান।
তাঁরা দেখেন, কিছু শ্রমিক বড় ট্রলার থেকে কাঠের বাক্সগুলো ক্রেনের সাহায্যে ঘাটে রাখা ট্রাকে তুলে দিচ্ছেন।
সার্জেন্ট হেলাল কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর পূর্বপরিচিত শ্রমিকসর্দার আরজু পাগলাকে দেখতে পেয়ে এসব মালামাল কার, তা জানতে চান। আরজু পাগলা জানান, মালের মালিক ঘাটে আছে। এরপর দুই সার্জেন্ট ঘাটে গিয়ে মালিককে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে হাফিজ ও আবুল হোসেন (একজন শীর্ষস্থানীয় উলফা নেতা) জানান, তাঁরাই মালের মালিক। কোনো ভণিতা না করেই তাঁরা স্পষ্ট জানান, ‘ট্রলার দুটিতে অস্ত্রশস্ত্র আছে।
প্রশাসনের সবাই বিষয়টি জানে। ’
একপর্যায়ে পুলিশের দুই সার্জেন্টের সঙ্গে আবুল হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাফিজ বলেন, ‘উনি উলফার নেতা, অস্ত্র তাঁদেরই। ’ এসব অস্ত্রের কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না, তা পুলিশের দুই কর্মকর্তা জানতে চাইলে খেপে যান হাফিজ। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘কিসের কাগজ, এই অস্ত্র আসার খবর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবার জানা আছে, এগুলো নামাতে বাধা দিলে আপনার ক্ষতি হবে। ’
জানা গেছে, পুলিশ ও অস্ত্র খালাসকারীদের মধ্যে এভাবে তর্ক শুরু হলে ঘাটের শ্রমিকেরা একে একে সরে পড়তে থাকেন।
ঘাটশ্রমিকদের বলা হয়েছিল, পুলিশের বাধা তো দূরের কথা প্রয়োজনে কোস্টগার্ড এসে এগুলো খালাসে সাহায্য করবে। একপর্যায়ে অস্ত্র খালাসের কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে খবর পেয়ে হাবিলদার গোলাম রসুলের নেতৃত্বে বন্দর ফাঁড়ির সব সদস্য, কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান, ঘাটের আনসারসহ আরও অনেকে ঘাটে এসে জড়ো হন। নিজেদের শক্তি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে তখন দুই সার্জেন্ট অস্ত্র খালাসকারীদের সঙ্গে দরকষাকষির চেষ্টা চালান। কিন্তু হাফিজ টাকা দিয়ে সমঝোতার চেষ্টার পরিবর্তে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা বলে পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
এ সময় তিনি মুঠোফোনে ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন।
একপর্যায়ে হাফিজ তাঁর মুঠোফোনটি সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকে দিয়ে বলেন, ‘তোর বাপের সঙ্গে কথা বল, ডিজিএফআইয়ের বড় অফিসার লাইনে আছে। ’ কিন্তু সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ভয় পেয়ে ওই ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পাল্টা বলেন, ‘আমি এবার তোমার বাপকে খবর দিচ্ছি। দেখি তোমাকে কে বাঁচায়?’
এরপর হেলালের সঙ্গে পরামর্শ করে আলাউদ্দীন ডিসি-পোর্টকে মুঠোফোনে অস্ত্র খালাসের বিষয়টি জানান।
একই সঙ্গে তিনি কয়লার ডিপোর সার্জেন্ট হেলালসহ আশপাশের সব ফাঁড়ি থেকে পুলিশ পাঠানোর আবেদন জানান। ডিসি-পোর্ট আবদুল্লাহ হেল বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তাঁকে আশ্বস্ত করেন। এরপর ডিসি-পোর্ট আশপাশের সবাইকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার বার্তা দিয়ে নিজেও আসছেন বলে জানান।
ইতিমধ্যে হাফিজের সঙ্গে থাকা উলফা নেতা আবুল হোসেন নিজের মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথা বলে সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকেও কথা বলার অনুরোধ করেন। আলাউদ্দীন ফোন ধরলে অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে বলেন, ‘দেখুন, আমরা ১৯৭১ সালে আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক সহায়তা করেছি।
এসব অস্ত্রশস্ত্রও আপনাদের মতো আমাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সৃষ্টির কাজে লাগবে, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না। ’ এসব অস্ত্র নামানোর কাজে বাধা না দেওয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশের সদস্যরা তাঁদের পরিচিত অন্যান্য পুলিশ, বিডিআর, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের মুঠোফোনে খবর দেন। খালাসকারীরা যাতে কোনোভাবেই পার পেয়ে যেতে না পারে, সে জন্য এটা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না বলে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন জানান।
উপস্থিত পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, হাফিজ ও তাঁর সঙ্গী বাদানুবাদের একপর্যায়ে পুলিশের দলকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব করেন।
কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ টাকা নিতে রাজি হয়নি।
জানা গেছে, এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে শুরু করেন। রাতেই বিষয়টি এমনভাবে জানাজানি হয়ে যায় যে, তখন আর কোনোভাবেই তা চেপে যাওয়ার কিংবা অস্ত্রবোঝাই ট্রাকগুলো ও ট্রলার দুটি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসন অনেকটা বাধ্য হয় বলে জানা যায়।
**পরিকল্পনা হয় ব্যাংককে**
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের উপকণ্ঠে বেঙ্কাপি চংচানের লাতপ্রাও এলাকার তিন তারকা মানের হোটেল ‘বেঙ্কাপি রয়েল রোজ হোটেল ব্যাংকক’।
এ হোটেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে অভিযোগ আছে। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) জেটি থেকে যে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক হয়, তা পরিবহনের পরিকল্পনা এই বেঙ্কাপি রয়েল রোজ হোটেলে বসেই করা হয় বলে জানা গেছে।
প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকক শহর থেকে কিছুটা দূরে এই বেঙ্কাপি রয়েল রোজ হোটেলের অবস্থান। জায়গাটা কিছুটা নিরিবিলিও।
চট্টগ্রামে আটক অস্ত্রের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান করেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিরক্ষা সাময়িকী জেনস ইন্টেলিজেন্স রিভিউয়ের (জেআইআর) সাংবাদিক অ্যান্থনি ডেভিস। এই সাময়িকীর ২০০৪ সালের ১ আগস্ট সংখ্যায় তাঁর লেখা ‘নিউ ডিটেইলস ইমার্জ অন বাংলাদেশ আর্মস হাউল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ বৈঠকের বিষয়টির উল্লেখ আছে।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ব্যাংককে ডেভিসের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। ডেভিস বলেন, বিভিন্ন সূত্র তাঁকে নিশ্চিত করেছে, বেঙ্কাপি রয়েল রোজ ব্যাংকক হোটেলটি উলফা ও অস্ত্র চোরাকারবারিদের আস্তানা। তিনি বলেন, ‘এ হোটেলে বৈঠক করে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয় বলে আমি জেনেছি।
ওই বৈঠকে যারা ছিল, তাদের সবার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে বৈঠকে নাগা বিদ্রোহী নেতা অ্যান্থনি শিমরে যে ছিলেন, সে ব্যাপারে আমি অনেকখানি নিশ্চিত। কারণ, এ চালানের অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে মূল ব্যক্তি ছিলেন তিনি (শিমরে)। ’
**কার জন্য এ অস্ত্র**
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য এই বিপুল অস্ত্র আনা হয়। জানা গেছে, উলফার অস্ত্র সংগ্রহের দরকার ছিল মূলত তাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে।
কারণ ২০০৩ সালের ডিসেম্বর ও ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় ভুটান সরকার তাদের ভূখণ্ডে থাকা উলফার ঘাঁটি ধ্বংসে ‘অপারেশন অল ক্লিয়ার’ নামের বড় ধরনের সেনা অভিযান শুরু করে। অভিযানে উলফার ঘাঁটি ধ্বংসের পাশাপাশি তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস হয়। অনেক উলফা সদস্য নিহত হয় বা ধরা পড়ে। এ কারণে উলফা অস্ত্র সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে।
জেনসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উলফার সঙ্গে নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (আইজ্যাক-মুইভা) বা এনএসসিএনের (আইএম) আগে সুসম্পর্ক ছিল না।
কিন্তু ভারতের অভিযানে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৌশলগত কারণে এ দুই সংগঠন ঘনিষ্ঠ হয়। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীটির মূল অস্ত্র সংগ্রাহক অ্যান্থনি শিমরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানিদের ভালো যোগাযোগ আছে।
অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট একাধিক লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এই বিরাট অস্ত্রের চালান পাঠানোর পেছনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সহায়তা ছিল।
জানা গেছে, ওই বৈঠকে অস্ত্রের চালানটি মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দরে কিংবা কক্সবাজার উপকূলে খালাস করে তা মিয়ানমারের চিন প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্য হয়ে সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই দুর্গম পথটি যথেষ্ট নিরাপদ নয় ভেবে শেষ মুহূর্তে এ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে অস্ত্রের চালান চট্টগ্রাম উপকূলে পাঠানো হয়।
অস্ত্র পাঠানোর গতিপথ শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন এক ধরনের কৌশলও হতে পারে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
**চীন থেকে বেশির ভাগ অস্ত্র কেনা হয়**
চট্টগ্রামে আটক ১০ ট্রাক অস্ত্রের বেশির ভাগই চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না নর্থ ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (নোরিনকো) তৈরি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বাকি অস্ত্রশস্ত্র ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এমনকি থাইল্যান্ডের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কালোবাজার থেকে কেনা হয়। যদিও এসব অস্ত্রের গায়ে কোনো দেশের নাম লেখা নেই।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চীনের আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান নোরিনকো থেকে অস্ত্র কেনা খুব কঠিন কিছু নয়।
তবে অস্ত্র কিনতে হয় নির্ধারিত কিছু এজেন্টের মাধ্যমে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের পর ‘সর্বশেষ ব্যবহারকারীর সনদ’ (এন্ড ইউজার্স সার্টিফিকেট বা ইইউসি) জমা দিলে কারখানা থেকেই প্রয়োজনমতো অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ পাওয়া সম্ভব।
অবৈধ অস্ত্র ও জঙ্গিবাদের উত্থান বিষয়ে অভিজ্ঞ র্যাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, উপযুক্ত এজেন্ট পেলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চোরাই পথে অস্ত্র কেনা কঠিন ব্যাপার নয়। তবে এ অস্ত্র কিনতে হবে বেশি করে, ন্যূনতম ১০ লাখ ডলারের। নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে অস্ত্র কেনা হলে ওই অস্ত্র গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও অনেক সময় ওই এজেন্ট নিয়ে থাকে।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল ভোরে যেসব অস্ত্রশস্ত্র চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাটে খালাস হয়, তা এ রকম নির্দিষ্ট কোনো এজেন্টের মাধ্যমে কেনা ও পাঠানো হয় বলে তিনি মনে করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রখ্যাত প্রতিরক্ষা সাময়িকী জেনস ইন্টেলিজেন্স রিভিউর (জেআইআর) এশিয়া প্রতিনিধি অ্যান্থনি ডেভিস এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি একরকম নিশ্চিত, চট্টগ্রামে যে অস্ত্রের চালান আটক হয়েছে তার মধ্যে নতুনগুলো চীনের প্রতিষ্ঠান নোরিনকোতে তৈরি। এ অস্ত্র কেনার জন্য যে সনদ জমা দেওয়া হয়েছে সেটাও ভুয়া ছিল বলে আমার মনে হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের অস্ত্র চোরাচালান চক্রটি অতীতেও এ ধরনের ভুয়া সনদ দিয়ে নোরিনকো থেকে অস্ত্র কিনেছে বলে অনেক প্রমাণ আছে। ’
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, অপারেশন ড্রাগন ফায়ার নামে একটি অভিযান চালানোর পরে নোরিনকোর কয়েকজন কর্মকর্তা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন।
২০০৩ সালে বুশ প্রশাসন ইরানের কাছে ক্ষেপণাস্ত্রপ্রযুক্তি বিক্রির জন্য নোরিনকোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
জেআইআরের ২০০৮ সালের নভেম্বর সংখ্যার ‘ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, চেঞ্জিং ট্রাফিকিং ট্রেন্ডস’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রচ্ছদ প্রতিবেদনেও নোরিনকো থেকে চোরাই পথে অস্ত্র বিক্রির বিষয়টির উল্লেখ আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার পরিবর্তে চীনের সরকারি কারখানার অস্ত্র এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। ব্যাংককের নিরাপত্তা বিশ্লেষক রবার্ট কার্নিলকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাপী চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চীন এখন সরকারিভাবে অস্ত্র বিক্রির চেয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে সরাসরি অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে ভালো লাভ পেতে শুরু করেছে। ’
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে পাঠানো অস্ত্রের একটি অংশ হংকং এবং অপরটি সিঙ্গাপুর থেকে একই জাহাজে তোলা হয়।
থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন কিংবা আশপাশের দেশ থেকে অবৈধ পথে জোগাড় করে কিছু অস্ত্র সিঙ্গাপুরের সমুদ্র এলাকার একটি জাহাজে রাখা হতে পারে।
কনটেইনার স্ক্যানার ও সিসিটিভির মতো নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে অবৈধ অস্ত্রের চালান জাহাজে তোলা হলো, জানতে চাইলে অ্যান্থনি ডেভিস প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আসলে অস্ত্রের ওই চালানটি সিঙ্গাপুর বন্দরের মূল ভূখণ্ডে তোলা হয়নি। সাগরে ভাসমান কোনো জাহাজে রাখা ছিল। মূল চালান নিয়ে অস্ত্রবাহী জাহাজটি দক্ষিণ চীন মহাসাগর অতিক্রম করার সময় ভাসমান জাহাজ থেকে তা মূল জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। এরপর দুটি চালানের পণ্য একই জাহাজে নিয়ে এটি সিঙ্গাপুরের মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করে আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরের আকিয়াব বন্দরের অদূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় এসে নোঙর করে।
এখান থেকেই বাংলাদেশের দুটি ট্রলার গিয়ে ওই জাহাজ থেকে চোরাই অস্ত্রের চালানটি খালাস করে চট্টগ্রাম বন্দরের সিইউএফএল জেটি পর্যন্ত নিয়ে আসে।
জেনস ইন্টেলিজেন্স রিভিউ পত্রিকায় ২০০৪ সালের আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নিউ ডিটেইলস ইমার্জ অন বাংলাদেশ আর্মস হাউল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অ্যান্থনি ডেভিস লিখেছেন, উলফার টাকা আর নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এনএসসিএন-আইএম অংশের আন্তর্জাতিক অস্ত্র কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জোগাড় সম্ভব হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অস্ত্র কিনতে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ জোগায়। এ অর্থ এনএসসিএন-আইএম অংশের একজন এজেন্টের মাধ্যমে হংকংয়ে পরিশোধ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতা অ্যান্থনি শিমরে মূলত ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় অবস্থান করে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত চক্রটির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
চট্টগ্রামে আটক অস্ত্রের চালানটি তাঁর উদ্যোগেই সংগৃহীত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এমনকি অস্ত্র খালাসের সময় শিমরে ম্যানিলা থেকে ব্যাংকক হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসেছিলেন। শিমরে ও উলফা প্রধান পরেশ বড়ুয়া দুজনই অস্ত্র খালাসের সময় চট্টগ্রাম অবস্থান করছিলেন বলে জেনসের প্রতিবেদনে বলা হয়।
র্যাবের চট্টগ্রামের সাবেক আঞ্চলিক অধিনায়ক লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে যত অস্ত্র গেছে তার বেশির ভাগই শিমরে এনেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে দুবার আসামের গুয়াহাটি কারাগারে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু শেষবার তিনি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ম্যানিলায় স্থায়ীভাবে আশ্রয় নেন। এখন সেখানে বসেই অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবসা করছেন।
**চট্টগ্রামে পরেশ বড়ুয়াসহ একাধিক উলফা সদস্য**
অস্ত্র খালাসের আগে চট্টগ্রামে এসে ঘাঁটি গাড়েন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ একাধিক উলফা সদস্য। ছিলেন প্রধান অস্ত্র সংগ্রহকারী অ্যান্থনি শিমরে। তাঁদের অনেকে নাম পাল্টে ওঠেন চট্টগ্রাম নগরের হোটেল গোল্ডেন ইনে।
কিন্তু বিপুল এই অস্ত্রের চালান আটক হওয়ায় কাউকে কিছু না বলে তাঁরা দ্রুত চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।
এই মামলার প্রধান আসামি হাফিজুর রহমান ওরফে হাফিজ আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে জামান নামের এক লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তিনি জানতে পারেন, জামানই উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া। পরবর্তী সময়ে জামান তাঁকে জানান, প্রচুর মেশিনারিজ পার্টস আসবে। পরেশ বড়ুয়া তাঁকে ট্রলার ঠিক করার দায়িত্ব দেন এবং যে ঘাটে মাল নামবে, সেটিও ঠিক করতে বলেন।
উলফা নেতা জানান, বাকি সব কাজ তাঁরা নিজেরাই করবেন। পরেশ বড়ুয়া তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের প্রধানেরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের হোটেল গোল্ডেন ইনের রেজিস্টার পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অস্ত্র খালাস শুরুর তিন দিন আগে ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ ভোর পৌনে ছয়টায় হোটেলের ৩০৫ নম্বর কক্ষটি বরাদ্দ নেওয়া হয় আসিফ জামান নামের এক ব্যক্তির নামে। তাঁর ঠিকানা দেওয়া হয় ৯৭/৫ শেরেবাংলা রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। এই জামানই উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া।
আর আসিফ আরেক উলফা নেতার ছদ্মনাম বলে ধারণা করা হয়। জেনস ইন্টেলিজেন্স রিভিউর ২০০৪ সালের ১ আগস্ট সংখ্যায় অ্যান্থনি ডেভিসও লিখেছেন, অস্ত্র খালাসের ঘটনার সময় পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে প্রধান অস্ত্র সংগ্রহকারী ও নাগা বিদ্রোহী নেতা অ্যান্থনি শিমরেও চট্টগ্রামে ছিলেন। শিমরে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় স্থায়ীভাবে থাকলেও ওই সময় ব্যাংকক হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। আসিফ, জামান, আবুল হোসেন, শহিদুল ইসলামসহ যেসব ব্যক্তি অস্ত্র খালাসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে নানাভাবে এসেছে, তাঁদের প্রত্যেকের নামে হোটেল গোল্ডেন ইনের কক্ষ ভাড়া নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০০৪ সালের ২৮ থেকে ৩০ মার্চের মধ্যে এসব ব্যক্তির নামে বিভিন্ন কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়।
২ মার্চ ভোরে অস্ত্র আটকের পর থেকে তাঁরা আর হোটেলে ফিরে যাননি বলে জানা গেছে।
গোল্ডেন ইনের ৩১৭ নম্বর কক্ষটি ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ ভোর পৌনে ছয়টায় বরাদ্দ নেওয়া হয় শহিদুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তির নামে। এই শহিদুলের ঠিকানাও দেখানো হয়েছে ৯৭/৫ শেরেবাংলা রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। অর্থাত্ জামান ও শহিদুলের ঠিকানা একই। ওই সময় ঢাকার মোহাম্মদপুরের ৯৭/৫ শেরেবাংলা রোডে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ওই ঠিকানায় একটি ছয়তলা ভবন আছে।
তবে এই ভবনের কোনো তলায় আসিফ জামান নামের কোনো ভাড়াটিয়া আগেও ছিলেন না, এখনো নেই বলে বাড়ির মালিক আবদুল খালেক তখন জানিয়েছিলেন।
২০০৪ সালের ২৮ মার্চ ভোররাতে হোটেল গোল্ডেন ইনের বিভিন্ন কক্ষে আরও চার যুবক অবস্থান নেন, যাঁদের মধ্যে নাম দেখানো হয়েছে ফরহাদ আহমেদ (গুলশান, ঢাকা, কক্ষ নম্বর-৩১৪), এম রহমান (১২/১০ ইসলামপুর, ঢাকা, কক্ষ নম্বর-২০৭), সফিকুর রহমান (৪৫৯/২ দক্ষিণ কাফরুল, ঢাকা, কক্ষ নম্বর-৪০৫) এবং আনিসুর রহমান (৪৫৯/২ দক্ষিণ কাফরুল, ঢাকা, কক্ষ নম্বর-৫০৫)।
২০০৪ সালের ২৭ মার্চ এক দিনেই ২০ জন ভারতীয় নাগরিকের জন্য হোটেল গোল্ডেন ইনের ১০টি কক্ষ ভাড়া করা হয়। তাঁরা সেখানে অবস্থানও করেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই ঠিকানা দেখানো হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাবড়ার বাবুপাড়ায়।
অস্ত্র আটকের দিন থেকে তাঁদের আর ওই কক্ষে পাওয়া যায়নি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হোটেল গোল্ডেন ইনের যে রেজিস্টারে অস্ত্র খালাসের সঙ্গে জড়িত লোকজনের নামে-বেনামে কক্ষ বরাদ্দ নেওয়ার বিষয় লিপিবদ্ধ ছিল, সে রেজিস্টারটি উধাও হয়ে গেছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এত দিনের পুরোনো রেজিস্টার তাদের কাছে নেই। দু-তিন বছর পর তারা বাতিল কাগজের সঙ্গে বিক্রি করে দিয়েছে। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রমতে, অস্ত্র আটক ঘটনার ছয়-সাত মাস পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ওই রেজিস্টার জব্দ করে নিয়ে গেছেন।
হোটেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য এটা স্বীকার করেনি।
প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ অস্ত্র চালান আমদানির পুরো বিষয় হাফিজুর রহমান ওরফে হাফিজের জানা ছিল। সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সে সময়ের প্রধান এ কে এম কবির উদ্দীন ও পরিদর্শক মো. শাহ আলম অস্ত্র আটকের ব্যাপারে ২০০৪ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সিআইডির সদর দপ্তরে যে পর্যালোচনা প্রতিবেদন পাঠান, তাতে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের আইএসআই কানেকটেড আন্তর্জাতিক চোরাচালান নেটওয়ার্কের সঙ্গে আসামি হাফিজুর রহমানের সম্পর্ক আছে বলে প্রতীয়মান হয়। ’
ওই প্রতিবেদনের অন্য একটি অংশে বলা হয়, অস্ত্র-গোলাবারুদ আটক ঘটনার ছয় মাস আগে ঢাকার হোটেল সুন্দরবনে এক পাকিস্তানির সঙ্গে তাঁর হোটেলকক্ষে হাফিজ সাক্ষাত্ করেন বলে জানা যায়। এরপর হাফিজুর রহমান পাকিস্তান, চীন, রেঙ্গুন (মিয়ানমার), ব্যাংকক (থাইল্যান্ড) গেছেন বলে তাঁর পরিচিতজনেরা সিআইডিকে জানিয়েছেন।
**অস্ত্রের চালান আসে উলফার ট্রলারে!**
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাহাজ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করে তা চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) জেটি পর্যন্ত নিয়ে আসার কাজ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সদস্যদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে করা হয়। এ জন্য ‘এমভি খাজার দান’ ও ‘এফবি আমানত’ নামে দুটি ট্রলার ব্যবহার করা হয়। এ দুটি ট্রলারের যে মালিকানা দেখানো হয়েছে বাস্তবে ওই নামের কোনো লোকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রথম আলোর অনুসন্ধানে। ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার ও আটকের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ ট্রলার দুটি বেনামে উলফারই।
২০০৯ সালে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্তও আটক এই ট্রলার দুটির মালিকানা কেউ দাবি করেনি।
এমভি খাজার দান ও এফভি আমানত নামের দুটি ট্রলার সরকারি সংস্থা সমুদ্র বাণিজ্য অধিদপ্তরে (এমএমডি) নিবন্ধিত আছে। এই নিবন্ধিত ট্রলার দুটির সঙ্গে একই নামের আটক দুটি ট্রলারের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, কোন দেশে তৈরি এবং কত শক্তির—তার কোনো মিল নেই।
এ প্রসঙ্গে সরকারি সংস্থা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে ওই সময় বলেছিলেন, অস্ত্র পরিবহনের সময় আটক এমভি খাজার দান ও এফভি আমানত এবং আমাদের দপ্তরে ওই দুই নামে যে দুটি নৌকা নিবন্ধন করা হয়েছে, তা এক নয়। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেব, আটক ট্রলার দুটি অন্য কোনো মালিকের।
আটকের পর থেকে কার্গো বোট ও ট্রলারটি চট্টগ্রামের নগরের অভয় মিত্র ঘাট এলাকায় এসআরভি পুলিশ ফাঁড়ির জিম্মায় রাখা হয়।
এ ফাঁড়ির দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ উপপরিদর্শক (টিএসআই) কাউছার ২০০৯ সালে ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে আলাপকালে জানান, গত পাঁচ বছরেও কেউ বোট দুটির মালিকানা দাবি করতে আসেননি।
প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে এমভি খাজার দানের কথিত মালিক সোবহান দাবি করেছিলেন, ‘খাজার দান নামের আটক ট্রলারটি আমার নয়। ’ তাহলে এ ট্রলার কার? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখুন। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকেও বলুন খোঁজ নিতে। তাহলে বুঝতে পারবেন বোটটি কার।
’ অস্ত্র আটক মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় এক বছর জেল খাটার পর এখন তিনি জামিনে আছেন।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উলফার মালিকানাধীন কয়েকটি ট্রলার বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশি জলসীমায় চলাচল করে। তবে কৌশলে এসব ট্রলারের মালিকানা রাখা হয়েছে স্থানীয় লোকজনের নামে। আটক ট্রলার দুটিও বেনামে উলফার মালিকানাধীন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
**কি কি অস্ত্র ছিল**
ওই রাতে ১০টি ট্রাক থেকে মোট এক হাজার ৪৬৩টি বাক্স উদ্ধার করা হয়।
এর মধ্যে একটি ট্রাক থেকে সর্বোচ্চ ২৭৮টি এবং অন্য ট্রাক থেকে সর্বনিম্ন ৪১টি বাক্স উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার করা অস্ত্রের পরিমাণ: ১০টি ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল এক হাজার ৭৯০টি। এর মধ্যে গুলি ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০, গ্রেনেড ২৭ হাজার ২০, ম্যাগাজিন ৬ হাজার ৩৯২ ও রকেট লঞ্চার ১৫০টি।
যে ধরনের অস্ত্র ছিল: এসব অস্ত্রের মধ্যে ৬৯০টি ৭.৬২ এমএম টি৫৬-১ এসএমজি, ৬০০টি ৭.৬২ এমএম টি৫৬-২ এসএমজি, ৪০০টি ৯ এমএম সেমি অটোমেটিক স্পোর্টিং রাইফেল, ১০০টি টমিগান, ১৫০টি ৪০ এমএম রকেট লঞ্চার টি৬৯, ছয় হাজার ৩৯২টি বিভিন্ন অস্ত্রের ম্যাগাজিন, ৭.৬২ এমএম এসএমজি গুলির সংখ্যা সাত লাখ ৩৯ হাজার ৬৮০টি, ৭.৬২ পিস্তলের (টমি) গুলি চার লাখ, জাপানের তৈরি একটি ওয়াকিটকি (সেট নম্বর টি ০০৬৩৮৫), ২৭ হাজার ২০টি গ্রেনেডের মধ্যে ২৫ হাজার ২০টি ছিল হ্যান্ড গ্রেনেড টি-৮২-২।
**রায়**
১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির ও জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং বিএনপি নেতা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
অস্ত্র আইনের মামলাটিতে একই আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
তথ্যসমুহ সংগ্রিহীত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।