তখন আমি বক্ষব্যাধি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। সকালে হাসপাতালে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে ফোন এলো। ‘তোমার আজকে থেকে ‘সোয়াইন ফ্লু’ আউটডোরে ডিউটি। তুমি আউটডোরের উপরের রুমে চলে যাও। ’ চলে গেলাম।
একটু পরে লোকাল অর্ডার হাতে পেয়ে গেলাম, পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত আমি এই দ্বায়িত্ব পালন করব।
মাত্র কয়েকদিন আগেই ‘সোয়াইন ফ্লু’ খবরে এসেছে। নতুন একটি রোগ। কয়েকজন মারা গেছেন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে। এর বেশী কিছুই জানি না।
সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী যে কয়েকটি হাসপাতাল এর চিকিৎসা দিবে তাঁর মধ্যে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল একটি। আর আমিই যে সেই ব্যক্তি জানলাম আজকে হাসপাতালে এসে। মুঠোফোনে ইন্টারনেট থাকায়, খোজ শুরু করলাম। যতটা পারলাম পড়লাম। রোগটাকে খুব ভয়ের লাগলো না।
কিন্তু এই নিয়ে এতো তুলকালাম কেন চলছে বুঝতে পারলাম না।
আমি তখন একজন বক্ষব্যাধির বিশেষজ্ঞ। কিন্তু রোগটি আবিস্কার হয়েছে কিছুদিন হল। তাই এর সম্পর্কে বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা নেই। একজন শিক্ষকের কাছে গেলাম, ‘স্যার, এতো ভাইরাল জ্বরের মত একটা রোগ, কি চিকিৎসা দিব?’ স্যার জানালেন, এভিয়ান ফ্লু র সময় প্রচুর অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ কেনা হয়েছে।
ওষুধের অভাব নেই। জ্বর তিন দিনের কম হলে আর শ্বাসকষ্ট থাকলে অ্যান্টি ভাইরাল দিবা, বেশী শ্বাসকষ্ট থাকলে ভর্তি করবা। যাদের জ্বর তিন দিন পেরিয়েছে কিন্তু শ্বাসকষ্ট নেই তাঁদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
চিকিৎসা দিতে শুরু করলাম। আমার বেশীরভাগ সময় কাটল বোঝাতে যে ভয়ের কিছু নেই।
ভাইরাস টির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে লাগে দুই থেকে তিন দিন। এরপর আর ভয়ের কিছু নেই। অল্প কিছু মানুষ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাঁরা সমস্যায় পড়তে পারেন। আমার কাজ এই অল্প কিছু মানুষ খুঁজে বের করা। আর বাকীদের সাহস দেয়া।
মানুষের ভিতর ভীতি কি পরিমাণ বিরাজ করছে কিছুক্ষণের ভিতরই টের পেলাম। যতই বোঝানোর চেষ্টা করি আপনার তিন দিন পার হয়ে গেছে এখনও যেহেতু শ্বাসকষ্ট নেই অতএব ভয়ের কিছু নেই। ‘যদি কিছু হয়?’ ‘কিভাবে আপনি সিওর হচ্ছেন?’ স্যারের কাছে আবার গেলাম, সমস্যা জানালাম। স্যার বললেন, বেশী ভয় পেলে ওদেরও ওষুধ দিয়ে দিও। শুরু হল ভয়ের চিকিৎসা।
একজন সাংবাদিক যখন কোন রোগ সম্পর্কে রিপোর্ট করেন, তখন তথ্যের চেয়ে তাঁর কাছে অনেক বেশী জরুরী হয় ‘সেনসেশান’। রোগটিতে কয়জন মারা গেছেন, কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, কত দ্রুত ছড়াচ্ছে এই তথ্য গুলো তাঁদের কাছে বেশী জরুরী। যিনি মারা গেছেন, তিনি এই রোগের কারণে মারা গেছেন নাকি তাঁর অন্য কোন অসুখ ছিল তা খুব জরুরী না তাঁদের জন্য। একবারও তাঁরা ভেবে দেখেন না, যে প্যানিক তাঁরা তৈরি করছেন তা কি ভোগান্তি তৈরি করছে জনগণের মাঝে। শুধু যদি তাঁরা রিপোর্ট করতেন, এই ফ্লু সাধারণ ফ্লু র মতই এক ধরনের ফ্লু।
ভয়ের কিছু নেই। শুধু কারো শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন, ভোগান্তি অনেক কমে যেত।
এবার আসি সম্প্রতি খুন হওয়া বিশ্বজিতের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তি নিয়ে। কয়েকটি পত্রিকায় এসেছে সেই চিকিৎসক স্বাচিপ এর নেতা, টাকা খেয়ে তিনি নাকি এর আগেও ভুল রিপোর্ট দিয়েছেন এবং এবার ও তিনি রিপোর্টে কোপ এর কোন চিহ্ন দেখতে পান নি। এবং যিনি রিপোর্ট করেছেন তিনি প্রয়োজনও বোধ করেন নি একবার খোঁজ নেয়ার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে ইনজুরির বর্ণনা কিভাবে লেখা হয়।
পোস্ট মর্টেম কিংবা যে কোন ইনজুরির নোট নেয়ার সময় কয়েকটা ব্যাপার নোট করা হয়। সংখ্যা, ইনজুরি গুলো কোথায়, কতটা গভীর এবং ইনজুরি সৃষ্টিতে কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে অর্থাৎ ‘ভোতা’ না ‘ধারালো’। এর সঙ্গে লিখবেন কোন ধমনী কাটা পড়েছে কি না ইত্যাদি। তাঁর চোখের সামনেও যদি ঘটনাটি ঘটে থাকে তারপরও তিনি রিপোর্টে সেই অস্ত্রের নাম লিখতে পারবেন না। তাঁকে লিখতে হবে ‘ধারালো অস্ত্র’ কিংবা ‘ভোতা অস্ত্র’ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
পত্রিকা গুলো রিপোর্ট করে দিল, টিভিতে এতজন লোক দেখলো, আসামী নিজেও স্বীকার করল সে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়েছে এর পরও ডাক্তার রিপোর্টে চাপাতির কথা বলে নি। এবং এর একটাই কারণ হতে পারে তিনি স্বাচিপ এর নেতা, ছাত্রলীগ কে বাঁচাতে চাইছে। আর নয় টাকা খেয়েছে।
রিপোর্ট যিনি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলবার ইচ্ছা নেই। কারণ এই প্রবণতা সব সাংবাদিকের ভেতরই কম বেশী আছে।
‘একটি খবর চাই’। রিপোর্টে চাপাতির উল্লেখ না থাকা তাঁর কাছে একটি খবর। কিন্তু আঘাত দেখে কেন অস্ত্রের নাম না বলে শুধু অস্ত্রের ধরন বলা হল রিপোর্টে, এই তথ্যটা জানতেও চাইলেন না। শুধু যদি তিনি কষ্ট করে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে একবার কথা বলতেন!
তিনি ক্ষমা চাইবেন এমনটা আমি আশা করি না। একজন ডাক্তারের নামে অহেতুক কলঙ্ক দেয়ার ভেতর একটা আনন্দ আছে।
অনেকের ভেতরই দেখা যায় এই আনন্দ লাভের চেষ্টা। ভুল চিকিৎসা, অবহেলায় মৃত্যু এমন অভিযোগ তো আমাদের নিত্য সঙ্গী। কিন্তু কখনই সঙ্গে থাকে না সঠিক চিকিৎসা টা কি? কোন সঠিক ওষুধটি দেয়া হয় নি। অবহেলা টা কি? নতুন যুক্ত হল অস্ত্রের নাম ‘চাপাতি’ না লেখা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।