প্রকীর্ণ করি অর্ণে আলোক বিসর্গী বীথিকায়
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লালন মঞ্চে এক বৃদ্ধকে প্রায়ই একাকী বসে হুঁকোয় দম দিতে দেখা যায়। একদিন খুব আগ্রহ ভরে তার সাথে কথা বলতে যাই। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে পাশে বসতে ইশারা করে সে। আমি প্রণোদিত চিত্তে বসে পড়ি। বহুক্ষণ সে কোন কথা বলে না, আমিও বহুক্ষণ তার অন্তর্মুখিতায় ব্যাঘাত ঘটাই না।
একসময় বলে উঠি, এদিক দিয়ে হররোজ আসা যাওয়া করি। আপনাকে প্রায়ই দেখি, ভাল লাগে। বৃদ্ধ বলে, সব মানুষের নয়, তবে প্রায় মানুষেরই আয়না দেখতে ভাল লাগে। কেউ যত কুৎসিতই হোক না কেন, আয়নার সামনে নিজ চেহারার একটা বিশেষত্ব তার কাছে ধরা পড়বে। তখন সে তাকে ফিরে ফিরে দেখবে।
মেয়েটাকে তুমি কতটা ভালোবাসো?’
হঠাৎ এ প্রশ্নে আমি বিচলিত হই। তথাপি জবাব দিই, আমার প্রাণকে যেমন।
বুড়ো বলে, দারুণ বলেছ। কোন অত্যুক্তি করনি। বলনি প্রাণের চেয়ে।
আমি মৌন থাকি। মন বলে বৃদ্ধের কথা শেষ হয়নি। আরও আছে। হুঁকোয় দুটো টান দিয়ে একরাশ নীল ধোঁয়া ছেড়ে বৃদ্ধ বলে, তোমাদের আমি লক্ষ্য করেছি আমাকে যেমন করেছ তুমি। তোমাদের প্রেম বড় প্রেম।
শুনে আমি আনন্দিত হই। কারণ মনের গভীরে আমিও তাই জানি। আমার স্বতঃস্ফূর্ত দন্তবিকাশের দিকে বুড়ো চেয়ে থাকে। বলে, যে সম্পর্ক যত বড়, তা ভাঙার কারণ তত তুচ্ছ। খুব তুচ্ছ কারণে একদিন তোমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাবে।
বুড়োর কথা শুনে তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় খুন চেপে যায়। ইচ্ছে হয় হুঁকোটা কেড়ে নিয়ে ধাঁ করে টেকো মাথাটার ওপর বসিয়ে দিই। মুণ্ডুটা ফাঁক হয়ে যাক। নিজেকে বহুকষ্টে নিবৃত করি। দাঁতে দাঁত চেপে বলি, আমাদের সম্পর্ক ঠিক এতখানি দৃঢ় যে আপনার বাঁজা ঘিলু কোনদিনও তার ঠাহর পাবেনা।
বৃদ্ধ আমাকে ফেটে পড়তে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, আমিও, আমিও ঠিক এমন করেই বলেছিলাম!
আমি হনহন করে হেঁটে চলে এলাম।
এরপর দু বছর কেটে যায়। বুড়োর সঙ্গে সেই উদ্ভট কথোপকথনের এক বছরের মাথায় চঞ্চলার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভেঙে যায়। কারণটা ঠিক এতটাই তুচ্ছ যে গত সপ্তাহে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে টের পাই আমি আদৌ তা মনে করতে পারছি না।
এ দু বছরের একদিনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাস মাড়াইনি। আজ কি মনে করে ঢুকে পড়ি। দূর থেকে দেখি লালন মঞ্চে সে বুড়ো সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি কাছে এগিয়ে যাই। বুড়ো আমাকে চিনতে পারে।
তামাকসেবীদের স্মৃতিশক্তি নাকি শেষ বয়েসেও অটুট থাকে। আমি কাছে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ি।
-নাও। তাহলে তামাক খাও।
আমি তার হাত থেকে হুঁকোটা নিই।
গুড়ুক গুড়ুক দুটো টান দিয়ে বিষম খেয়ে চোখে অন্ধকার দেখি। আমার মনে একটি প্রশ্ন ফেনিয়ে ওঠে। কে লোকটি? বৃদ্ধের অন্তর্কর্ণ অতিশয় পরিষ্কার। আমার প্রশ্নটি সে শুনতে পায়। বলে, আমি হচ্ছি তুমি।
সেই প্রথম দিনই তোমাকে অন্য ভাবে বলেছিলাম কথাটা। যাহোক। আমার কাজ শেষ হয়েছে। বৈশ্বিক অন্তর্মুখীভ্রান্তিচক্রের আমার অংশটি পূর্ণ হয়েছে। আজ হতে আমি মুক্ত।
এবার আমি তোমাতে আরেকজনাকে পশিয়ে দিয়ে যাব। তার সাথে তোমার অর্ধশতাব্দী পর দেখা হবে যখন তোমার সায়াহ্ণ উপস্থিত। সেদিন চক্রের তোমার অংশটি পূর্ণ হবে। তুমি মুক্তি পাবে।
বুড়ো কখন ভোজবাজির মতন হাওয়া।
আমার হাতে তার হুঁকো। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রই।
অর্ধশতাব্দী, দীর্ঘ সময়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।