এক
তোর নাম কি? দন্ত পরিষ্কারের খিলান দিয়ে মাড়ি খুচাতে খুচাতে কবির ভাই জিজ্ঞেস করলেন।
কবির ভাই এলাকার উঠতি রাজনৈতিক নেতা। তার কলেজের ক্যাম্পাসের তিনি সভাপতি, শোনা যাচ্ছে কয়েক বছর পর কেন্দ্রেও ছাত্র সংগঠনের পদ পাবেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, বজলুর চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ধরিয়ে অপরাধ করে ফেলেছি কিনা! সিগারেট ধরানোর আগেও তিনি এখানে ছিলেন না। দিনের ৪র্থ সিগারেটটা ধরিয়ে আয়েশ করে যখন একটা টান দিয়েছি, সেই মুহুর্তেই দলবল নিয়ে বজলুর ক্যান্টিনে ঢুকলেন তিনি!
আমি নিজের নাম বলতে গিয়ে গলা কাঁপিয়ে ফেললাম।
মিজান। আমার নাম মিজান।
কবির ভাই দাঁত খুচানো বন্ধ করে কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পাশ থেকে একজন বলল- তুই তো এত বিয়াদপ সিলিনারে মিজাইন্না! বাইয়ে নাম জিগাইসে, আর তুই সুডো নাম কয়াই খালাশ? পুরা নাম ক’বেডা!
ভাই, আমার নাম নবি। নবিউল্লাহ মিজান।
কবির ভাইয়ের কড়া চোখের দৃষ্টি এবার কুঞ্চিত হল। নবি? নবি মানে? তুই বেটা নবি কিয়ের লাইগা? নবির কোন কামডা তুই করতে পারস? নবিরা জীবনে সিগার টানে ক্যান্টিনে বইসা?
ভাই, স্যরি। ভুল হয়ে গেছে। নামটা তো বাবা-মা রেখেছিল। আমার বাবা মা ভুল করেছে!
আশ্চর্য্যজনক ভাবে এই কথার পর কবির ভাইয়ের দৃষ্টি নরম হয়ে গেল।
বাবা-মা জাতীয় কোন ট্রাজেডি তার জীবনে থাকতে পারে, নাহলে বাবা-মায়ের নামে দোষ দেওয়ায় তার দৃষ্টি কেন শীতল হবে?
আচ্ছা শুন মিজান, তুমি কলেজে পড়?
জ্বি ভাই। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।
ভাল কতা, তোমারে একটা জরুরি কাজ দিবার চাইতাসি। চা খাও আরেক কাপ?
হঠাৎ করে কবির ভাইয়ের সম্বোধন কেন বদলে গেল বুঝতে পারলাম না। রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত একসাথে অনেকগুলো পার্সোনালিটি বহন করে চলেন।
এখন আবার চা খেতে বলছেন, তার উপর আমাকে কি কাজ দিতে চান? টের পেলাম, ঘামতে শুরু করেছি!
কবির ভাই আমার কাঁধে হাত রাখলেন হঠাৎ। তুমারে হঠাৎ দেইখা হঠাৎ মনে ধইরা গেল বুঝলা। চা খাও। চা খায়া আমার লগে বাইকে উডো। তোমার সাতে কথা আসে।
বজলুর বানানো চায়ে বরফ দেয়া ছিলনা। কিন্তু ভয়ে আমার কলিজা হিম হয়ে গেল!
দুই
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ। দুপুর ২টা। আমার হাতে একটা সিঙ্গাড়ার প্যাকেট। বেশ বড়সড় প্যাকেট।
গোটা পঞ্চাশেক সিঙ্গাড়া এই প্যাকেটে আছে। চারপাশে অনেকের জন্যেই হালকা নাস্তার ব্যবস্থায় এই সিঙ্গাড়া।
বেলা এগারোটা বারোটার দিকেও অনেক লোক ছিল। এখন ভিড় একটু পাতলা। রাস্তার ওপাশে অবশ্য লোকজনের বেশ বড় জমায়েত।
সেদিকে যাওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি আমার চারপাশের লোকজনের মাঝে উদার চিত্তে সিঙ্গাড়া বিলাতে লাগলাম। সবাই খুব খুশি মনেই সেই সিঙ্গাড়া নিল, এবং খেতে শুরু করলো।
তিন
কবির ভাই ডি’ব্লকের এক ঘুপচি গলির সামনে তার দলবল নিয়ে থেমেছিলেন ওদিন সন্ধ্যায়। বাইক থেকে নামলাম আমি।
তিনি তার এক সাঙ্গের হাতের শপিং ব্যাগ থেকে সবুজ একটা বোতল বের করে আমার হাতে দিলেন। বেশ ঘন কোন তরল পদার্থে বোতলটি ভর্তি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
কবির ভাই বললেন- তুমি তো খুব ভালা পোলা। তুমারে দিয়া বেশি কিছু করামু না।
তয় রোজ যে তুমি গণজাগরণ মঞ্চের আশপাশে ঘুরঘুর করো, এইটা আমি জানতে পারসি। রাজাকার গো বিচার তাইলে তুমি চাও?
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।
কাইল দুপুরে ছোট্ট এক কাজ করবা। আমার বুজম দুস্ত কামরুইল্লা তুমারে এক প্যাকেট সিঙ্গারা দিবো বাংলামোটর থাইক্কা। সেইটা তুমি শাহবাগে নিয়া যাইবা।
সবার লগে ভাগ কইরা সিঙ্গাড়া খাইবা।
মানে কি? সিঙ্গাড়ায় কি বিষ মাখানো থাকবে?
কি মিশানো থাকবো না থাকবো তুমার জাইনা কাম নাই। যেই কামডা দিলাম হেইডা করবা। নাইলে হাতের যেই বোতলডা দেখতাসো না, অমুন একখান বুতলে আগুন লাগায়া তুমার বাপে যখন রোজ সকালে অফিস যায়, হ্যার গায়ে মাইরা দিমু।
মানে কি?
মানে সোজা।
ওই বোতলডি প্যাট্রলভর্তি। কাইল দুপুরে যদি তুমি ওই কাম করবার না চাও, পরশু সকালে ধরো তুমার বাপে রাস্তায় পুইড়া কাবাব হয়া যাইবো! হাসপাতালে লোনের চান্সও পাইবানা!
চার
আজ একটা ছুটির বিকেল। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আমি আর বাবা টিভির সামনে বসে আছি। হঠাৎ একটা সংবাদ চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখে থমকে গেলাম। “শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে আন্দোলনে সমর্থন দিতে আশা পঞ্চাশজন ব্যক্তি ভয়াবহ ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মহাখালি কলেরা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে!
প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের মতে, অজ্ঞাত কোন কারণে শাহবাগে জড়ো হওয়া মানুষের একাংশ ঘটনাস্থলেই অসুস্থ হয়ে যান হঠাৎ করে।
সেখান থেকে তাদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল, পরবর্তিতে মহাখালি কলেরা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়!
পুলিশের তথ্যমতে কোন অজ্ঞাত গ্রুপ দুপুরের দিকে আক্রান্তদের খাবার বিতরণ করেছেন। সেই খাবারই এই ম্যাসাকারের কারণ বলে অনুমান করা হচ্ছে।
নানান মহল থেকে এই হীন কার্য্যের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করা হয়েছে। নগরীর সুশীল সমাজের একাংশ আজ বেলা এগারোটায় পাবলিক লাইব্রেরী চত্ত্বরে একটি বিক্ষোভ সভা আয়োজন করেছেন। তারা সরকারের নিকট দাবি করেছেন- এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের…
এদিকে সকাল থেকেই দলে দলে সাধারণ মানুষের ভিড় শাহবাগের মোড়কে জনসমুদ্রে রুপান্তরিত করেছে।
তারা যুদ্ধাপরাধিদের বিচার চান। তারা ফুড পয়জনিং এ আক্রান্ত পঞ্চাশজন মানুষের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার বিচার চান।
আমি কাঁপা হাতে চ্যানেল পালটিয়ে দিলাম। আমার মাথার রগ দপদপ করছে। নতুন চ্যানেলেও ভয়াবহ একটি ব্রেকিং নিউজ।
এক জেলা শহরে সিটিবাসে হরতালকারীদের অগ্নিসংযোগে আগুনে পুড়ে পিতা-পুত্র সহ আরো নয়জন নিহত!
বাবা বললেন- বেজন্মারা এই দেশটাকে আবার পাকিস্তান বানানোর পাঁয়তারা করছে। জিম্মি করে রেখেছে আমাদের সবাইকে যেন.. একটা স্বাধীন দেশে বসে স্বাভাবিক মৃত্যুও পাবোনা আমরা কেঊ?
তখন হঠাৎ কাছেই কোথাও গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হল। মাত্র দুবার। মাগরিবের সময় মসজিদে এলান করা হল- স্থানিয় প্রভাবশালী উঠতি নেতা এবং তরুণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কবিরুল আলম আততায়ির গুলিতে নিহত হয়েছেন! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…..
দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি-
ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে,
এবার তবে ফেল গো মোরে ঢাকি
অতি নিবিঢ় ঘন তিমির তলে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।