জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের যুদ্ধাপরাধের রায় যে কোনো দিন। দু’জনের বিরুদ্ধেই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। সাঈদীর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখার পর স্কাইপিতে কথোপকথন বিতর্কে জড়িয়ে পদ ছেড়েছেন বিচারপতি মো. নিজামুল হক। তবে কালবিলম্ব না করে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করায় সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা বিলম্ব হবে না বলেই মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের মার্চ মাসে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর মামলারই সর্বপ্রথম শুনানি শেষ হয়েছে।
এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ৪১ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে দায়ের করা কোনো মামলা নিষ্পত্তির শেষ পর্যায়ে উপনীত হলো।
শুনানির শেষ পর্যায়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কোরআন স্পর্শ করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এই বিচার দুই পর্বে শেষ হবে। এক পর্বে আপনারা বিচারক, আমি আসামি। দ্বিতীয় পর্বে আরেকটি বিচার হবে কেয়ামতের মাঠে।
যেখানে বিচারক হবেন আল্লাহ। ওই বিচারের দিন আমি থাকবো বাদী। আপনাদের করবো বিবাদী। তার বক্তব্যের জবাবে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আল্লাহ যে দায়িত্ব আমাদেরকে দিয়েছেন তা যেন আমরা পালন করতে পারি। আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখেই এ মামলার রায় দেবো।
কাগজপত্রে যা আছে তার মধ্যে নিজেদেরকে রেখে রায় দেবো।
আদালতের কার্যক্রম শেষে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী সাংবাদিকদের জানান, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সব কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলাটি অপেক্ষমাণ আদেশের দিন ধার্য করেন। আসামির বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ১৯টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের দাখিলকৃত দালিলিক প্রমাণ এবং সাক্ষীদের জবানবন্দির মাধ্যমে আশা করছি তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
এর আগে প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তি উত্থাপনকালে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে মাওলানা সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলেন।
অন্যদিকে, মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। প্রসিকিউশনের আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ অভিযোগে তার একদিনের জন্যও শাস্তি হতে পারে না। তিনি বলেন, দেলাওয়ার হোসেন শিকদার নামের এক রাজাকারের অভিযোগ সাঈদীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে প্রসিকিউশন।
শিকদার ও সাঈদী এক নয়। শিকদার ভিন্ন ব্যক্তি। প্রসিকিউশন তার অভিযোগ সাঈদীর নামে চালিয়ে দিচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর দায়ের করা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি মামলায় মাওলানা সাঈদীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
গত বছরের ১১ জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ১৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শেষে ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনকালে মুক্তিযুদ্ধকালে পিরোজপুর জেলায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের অপরাধে সাহায্য করা ও জড়িত থাকার ঘটনায় ২০টি অভিযোগ আনা হয়। গত বছরের ২০ ও ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উত্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান।
মামলায় সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। প্রায় সাড়ে চার মাসে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে ২০ জন ঘটনার বিষয়ে এবং সাতজন জব্দ তালিকার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, মাহাবুব উদ্দিন হাওলাদার, রুহুল আমীন নবীন, মিজানুর রহমান তালুকদার, সুলতান আহমেদ হাওলাদার, মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার, মানিক পসারি, মফিজ উদ্দিন পসারি, মো. মোস্তফা হাওলাদার, মো. আলতাফ হোসেন হাওলাদার, বাসুদেব মিস্ত্রি, আবদুল জলিল শেখ, আবদুল আওয়াল এমপি, গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা, আবদুল হালিম বাবুল, মো. সেলিম খান, জুলফিকার আলী, মধুসূদন ঘরামী, মো. হোসেন আলী, মো. মোবারক হোসেন ও সাইফ হাফিজুর রহমান। আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেনÑ পিআইবি’র ক্যাটালগার মো. রবিউল আলম খান, পিআইবি’র চতুর্থ শ্রেণীর বুক সর্টার এসএম আমিরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গাইড-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা বেগম, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গাইড মো. নেছার, বাংলা একাডেমীর গ্রন্থাগারিক ইজাব উদ্দিন মিয়া, বাংলা একাডেমীর গ্রন্থাগারিক ডিস্ট্রিবিউটর মাসুম-উল কবির এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান।
রাষ্ট্রপক্ষের ২৮তম ও শেষ সাক্ষী হিসেবে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন ৮ এপ্রিল। ৯ কার্যদিবসে ২৪ এপ্রিল তার সাক্ষ্য শেষ হয়। আসামিপক্ষ ২৫ এপ্রিল তাকে জেরা শুরু করেন। ৪৮ কার্যদিবসে অর্থাৎ ১৩ আগস্ট তার জেরা শেষ হয়। এর মাধ্যমে শেষ হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা।
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালের আদেশে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তারা হচ্ছেন উষা রানী মালাকার, সুখরঞ্জন বালি, আশিস্ কুমার, গণেশ চন্দ্র সাহা, শহিদুল ইসলাম খান সেলিম, মো. মোস্তফা, আবদুল লতিফ হাওলাদার, আইয়ুব আলী হাওলাদার, সেতারা বেগম, অনিল চন্দ্র ম-ল, রানী বেগম ও অজিত কুমার শীল।
গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এর আগে সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিতে আসামিপক্ষ ৪৮ জনের নামের তালিকা দিলেও ২০ জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য অনুমোদন দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০ জনের মধ্যে আসামিপক্ষ ১৭ জন হাজির করে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ান।
গত ২৩ অক্টোবর তারা আর কোনো সাফাই সাক্ষী আনতে না পারায় সেদিনই সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। সাঈদীর পক্ষে যে ১৭ জন সাক্ষ্য দেন তারা হলেনÑ শামসুল আলম তালুকদার, আবদুর রাজ্জাক আকন্দ, নুরুল হক হাওলাদার, আবুল হোসেন, খসরুল আলম, রওশন আলী, জামাল উদ্দিন ফকির, কুবাত আলী, হেমায়েত উদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, আনোয়ার হোসেন, হাফিজুল হক, সাঈদীর ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী, এমরান হোসাইন, আব্দুস সালাম হাওলাদার, আবদুল হালিম ফকির ও গণেশ চন্দ্র সাহা।
এদিকে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে শুনানি শেষ হয়েছে গত ২৬ ডিসেম্বর। এখন যে কোনোদিন এ মামলার রায় ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি এম ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল ২৬ ডিসেম্বর এ আদেশ দেয়।
ট্রাইব্যুনাল-২ এ এটিই প্রথম মামলা, যার কার্যক্রম শেষ হলো। তবে মামলার কার্যক্রম শুরুর প্রথমদিন থেকেই পলাতক আবুল কালাম আযাদ। ২৬ ডিসেম্বর তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন ট্রাইব্যুনালের নিয়োগ দেয়া আইনজীবী আবদুস শুকুর খান। এরপর প্রসিকিউটর এডভোকেট সাহিদুর রহমান আসামি পক্ষের যুক্তি খ-ন করে সমাপনী বক্তব্য দেন। গত ২৬ নভেম্বর আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ৩৩ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন।
এর পরদিনই তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষে ২২ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামি পক্ষ কোনো সাফাই সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। এর আগে গত ৪ নভেম্বর আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে আটটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিত ও দেশান্তরিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ২৬ জুলাই তার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। গত ৩ এপ্রিল আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফরিদপুরে ঢোকে। ওইদিনই তাদের সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুরের জগদ্বন্ধু আশ্রমের ৮ পূজারীকে হত্যা করে আযাদ।
পরে খুন করে কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায় ও তার ছেলে মণিময় রায়কে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আযাদ ছাত্রসংঘের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ২৫ মার্চের কালরাতের পর সে নিজেই একটি বাহিনী গড়ে, যারা পরে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়।
শেষ পর্যায়ে আরো ৪ মামলা
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ জামায়াতের শীর্ষ সাতজন ও বিএনপির দুইজনসহ মোট নয়জনের বিচার কাজ চলছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪ জনের বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।
খুব শিগগিরই যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ শেষ হতে পারে তাদের মধ্যে রয়েছে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেন, আমরা চেষ্টা করছি ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে আটক ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়। আশা করছি, সহসাই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটকদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হবে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আরেক সিনিয়র কর্মকর্তা সানাউল হক বলেন, আমরা তদন্ত সংস্থা থেকে উপলব্ধি করতে পারছি যে, যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হচ্ছে, তাদের সাক্ষী বেশি হলেও পরবর্তী আসামীদের বিরুদ্ধে সাক্ষীর সংখ্যা আনা হবে তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, গোলাম আযম, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাক্ষী একটু বেশি হওয়ায় তাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে কিছুটা বিলম্ব হলেও আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, আব্দুল আলিমের বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, আসামীপক্ষ সাফাই সাক্ষীর তালিকায় বেশি সাক্ষীর নাম দেয়ায় একটু বেশি সময় লাগতে পারে। তবুও বিচার দ্রুত শেষ করা চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ মানুষকে হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্মান্তরিত করা, লুট ও আগুন ধরিয়ে দেয়াসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের জন্য ২০১০ সালে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিচার ত্বরান্বিত করতে চলতি ২০১২ সালে ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হয়। এ দুই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের যে সাতজনের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলছে তারা হলেনÑ জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর কাশেম আলী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি, জিয়া সরকারের মন্ত্রী আব্দুল আলিম এবং জামায়াতের সাবেক রুকন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার।
গত ১৪ মে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার আদেশ দেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গত ৫ জুন রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন ও মাহাবুব উদ্দীন আহম্মদ বীরবিক্রম জবানবন্দি পেশ করেন। জামায়াতের সাবেক এ আমীরের বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা ও চক্রান্ত করার জন্য ছয়টি, পরিকল্পনার জন্য তিনটি, উস্কানি দেয়ায় ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ২৪টি এবং ব্যক্তিগতভাবে হত্যা ও নির্যাতনের একটি অভিযোগ রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর গত ১ জুলাই প্রসিকিউশন সূচনা বক্তব্য শেষ করেন।
গত ২৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরের প্রথম সাক্ষী ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী তার জবানবন্দি পেশ করেন। তার বিরুদ্ধে ১৬টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, বুদ্ধিজীবী হত্যায় সহযোগিতা, উস্কানি, প্ররোচনা ও পরিকল্পনা করা। তার নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৮ মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে লোক জড়ো করে নির্বিচারে অসংখ্য লোককে হত্যা করার অভিযোগ আছে। জামায়াতের বর্তমান আমীরের বিরুদ্ধে সাড়ে চার শতাধিক হিন্দুকে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।
সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধেও এরই মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে গিয়েছে। ১৯ জুলাই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ওপেনিং স্টেটমেন্ট শেষ করা হয়। গত ২৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরের প্রথম সাক্ষী ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি সাংবাদিক লেখক শাহরিয়ার কবির তার জবানবন্দি পেশ করেন। সাক্ষীকে জেরার কার্যক্রম শুরু করছেন ট্রাইব্যুনালে আসামীপক্ষের আইনজীবী। আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজউদ্দিন হোসেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, বদিউল আলমসহ ৫ জনকে পাক সেনাদের সহযোগিতায় তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এমপি হোস্টেল থেকে ধরে নিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের চর-ভদ্রাসন, বৈদ্দাডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালুডাঙ্গি এলাকায় ৩৯ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে গত ২০ জুন তার বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে একজন নারী ভিকটিমসহ সাক্ষীরা তাদের জবানবন্দি পেশ করেছেন। আব্দুল কাদের মোল্লা রাজধানীর মিরপুর এলাকার কসাই হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
একাত্তরে মিরপুর ১২ নম্বরের সামনে পল্লবকে হত্যা, কবি মেহেরুন্নিসা, তার বৃদ্ধা মা ও দুই ভাইকে হত্যা এবং আলোকদি গ্রামের ৩৪৪ জনকে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। দলের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধেও গত ৪ জুন অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের পাঁচজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি পেশ করেন। তার বিরুদ্ধে বৃহত্তর ময়মনসিংহে হত্যা, লুট ও নারী নির্যাতনসহ ৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি নিজ হাতে অনেককে হত্যা করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত নয়জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ২৩টি ঘটনায় সংঘটিত অপরাধ উল্লেখ করে এ অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামের হিলটেক, কু-েশ্বরী, রাউজান, বোয়ালখালী, মুন্সিরহাট, হাটহাজারী, ডাবলমুড়িং এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে ২৩টি সুনির্দিষ্ট ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব এলাকায় তার নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে কু-েশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নতুন চন্দ্র সিংহ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মোজাফ্ফর আহমেদকে হত্যা, ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরীকে নির্যাতন, উনসত্তর পাড়ায় গণহত্যা, নূর মোহাম্মদকে হত্যা, ফয়েজ আহমদ, সেকেন্দার, ধীরেন্দ্র নাথসহ তিন শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা, গণহত্যা, সহস্রাধিক ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বাধ্য করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন ‘গুডস্ হিল’-এ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, অপহরণের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আরেক বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে সাক্ষীগ্রহণ শুরু হয় গত ৬ আগস্ট। বিএনপি নেতা আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে ১৭টি ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আব্দুল আলিম জয়পুরহাটের ডা. আবুল কাশেম হত্যা ও ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার গণহত্যার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত বলেন, আলিম মুক্তিযুদ্ধকালে নিরীহ মানুষ, রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত নির্যাতন এবং পাক বাহিনীর সহযোগিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের নির্যাতন চালান। আলিম মুক্তিযুদ্ধকালে বগুড়া জেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান ও পাক সহযোগী বাহিনীর অন্যতম নেতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ উস্কে দেন। আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগের মধ্যে রয়েছেÑ জয়পুরহাটের ছাত্রনেতা ফজলুর রহমানকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। ডা. আবুল কাশেমকে হত্যার অভিযোগ। জয়পুরহাট চিনিকলে নিয়ে ২৩ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গঠিত অভিযোগের মধ্যে আরো রয়েছে জয়পুরহাটের কড়াইকাদিপুর এলাকায় একাত্তরের ২৬ এপ্রিল গণহত্যা। এতে বলা হয়, ওইদিন আলিমের সহযোগিতায় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগিরা নাম জানা ৩৮ জন ও নাম না জানা ৩৩২ জনকে হত্যা করে। জয়পুরহাটের পাহনান্দা গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে জামায়াতের আরেক নেতা কেন্দ্রীয় সুরার সদস্য দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের মালিক মীর কাশেম আলী ও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি এটিএম আজহার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্ত অব্যাহত আছে।
তাদের বিচারের কাজও অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।