আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসুন্দর নামের সুন্দর জায়গা - বগালেক আর চিংড়ি ঝর্না



আমি খুবই ইন্টারনেট নির্ভর একজন মানুষ। আ্মার ধারনা, একমাত্র কাজের মানুষ ছাড়া বাকি সব কিছুই গুগল্ সার্চ দিলে পাওয়া যায় (কে জানে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে bua.com ধরনের কোন ওয়েবসাইট সেই সুবিধাও দেবে)।
তাই প্রথম যখন বগালেক যাবার কথা উঠল, আমি যথারীতি গুগলিং শুরু করলাম।
এই লেকের অবস্থান পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা উপজেলায়। স্থানীয় উপকথা, ইতিহাস এবং বৈজ্ঞানিক সূত্র মিলিয়ে তিনটি নাম পেলাম।

বগা, বাগা এবং বাগাকাইন। কোন নামের উৎস কি, অতো গভীরে না-ই বা গেলাম। কারন, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য পাঠকদের ভূগোল পড়ানো নয়, বরং বগালেক ভ্রমনের গল্প শোনানো।
অন্যসব আয়োজন হয়ে যাওয়ার পর পূর্বনির্ধারিত তারিখ (সম্ভবত ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর) রাতে শ্যামলী পরবিহনের বাসে উঠে বসলাম আমরা তিন বন্ধু। আমি, স্টকব্রোকার শুভ (শেয়ার কেলেঙ্কারিতে ওর জড়িত থাকার কোন প্রমান পা্ওয়া যায়নি) আর স্বঘোষিত 'হাইকোর্ট' এর উকিল শাহারিয়ার)।


রাত ১০:৪৫ মিনিটে ফকিরাপুল থেকে বাস ছাড়ার পর ভোর সকালে বান্দরবান পৌঁছানো পর্যন্ত অধিকাংশ সময় আমরা ঘুমিয়েই কাটালাম। তাই গল্প বলার মত কোন কিছু ঘটেনি।
বাস থেকে যখন নামলাম, মোটামুটি দিনের আলো ফুটে উঠেছে। আগেও বেশ কয়েকবার বান্দরবান আসার সৌভাগ্য হয়েছে, তাই শহরের পথঘাট চেনা। বাস থেকে নেমে কোন রিক্সা / ট্যাক্সি না নিয়ে বাক্স-পেটরা কাঁধে নিয়ে পদব্রজেই পৌঁছে গেলাম হোটেল প্লাজা বান্দরবান (শহরের একমাত্র লিফট্ যুক্ত হোটেল) যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ফারুখ ভাই, হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার।

ছোটখাটো নাদুসনুদুস গড়নের সদা হাস্যময় মানুষ। আগেও এই হোটেলে থাকার সুবাদে আমার সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে।
আমরা শুধু যাত্রাপথে প্রাতরাশ সারার জন্যে থেমেছি জেনে প্রথমে একটু মনক্ষুন্ন হলেও পরে যখন বললাম যে ফিরতি পথে তার এখানে অন্তত একরাত কাটিয়ে যাব, তার স্বভাবসুলভ আকর্নবিস্তৃত হাসি আবার দেখা গেল।
ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সারার পর আমরা বেশী দেরী করলাম না কারন রুমা-র বাস ধরতে হবে। দুপুরের মধ্যে রুমাবাজার পৌছতে না পারলে সেদিন আর বগালেক যেতে পারবনা কারন রুমা থেকে দিনের শেষ চান্দের গাড়ী দুপুর ৩টায় ছেড়ে যায়।


ফেরার দিনের জন্য একটা রুম বুকিং রেখে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। রুমা বাসস্ট্যান্ড শহর থেকে খুব বেশী দূর না হলে্ও আমার মত অলস মানুষের (জ্ঞাতব্য: ভ্রমনের প্রায় এক বছর পরে কাহিনী লিখতে বসলাম) জন্য ওইটুকুই অনেক দূরত্ব। তাই টমটম গাড়ী নিয়ে চলে আসলাম। এক ঘন্টা পর পর রুমা বাজারের উ্দ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়।
বাসের জানালা দিয়ে পাহাড়ের অপার সেৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম রুমা বাজারের দিকে।

শীতের এই সময়টাতে প্রকৃতি অনেকটা ধূসরবর্ন ধারন করার কথা থাকলেও এখানে তেমনটি নয়। হয়তো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে হওয়ায় এবং মেঘ আর কুয়াশার নৈকট্যের কারনে গাছপালা যথেষ্ট সবুজ রয়েছে। পথে কিছু কিছু জায়গায় দেখলাম সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে। এখানে বলে রাখা ভাল, পার্বত্য চট্টগ্রামের এইসব এলাকা একটা সময় পর্যন্ত খুবই দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল ছিল। রাত্রিযাপন তো দূরে থাক, দিনের বেলায়ও মানুষ এসব অঞ্চলে আসার সাহস পেতনা।

আমাদের সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও চরম সাহসিকতার ফলে এখানে পাকা রাস্তা হয়েছে, ব্রিজ হয়েছে, বেড়েছে লোকালয়। এখনো যে পাহাড়ে অপহরন বা খুনের মত ঘটনা ঘটেনা তা না, কিন্তু সেটা আগের চেয়ে অনেক কম।
পাহাড়ের কোল ঘেষে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে বাস। পাহাড়ি রাস্তাগুলো অনেক চড়াই-উৎরাই পূর্ন, তাই এখানে বাসগুলো খুবই ধীরগতিতে চলে। বিশেষ করে, কিছু পথের বাঁক এত সরু ও তীক্ষ্ণ যে, একটু এদিকসেদিক হলে বাস কয়েকশ' ফুট নীচে চলে যাবে।

তবে টাকা-পয়সার যদি টানাটানি না থাকে (আমার সবসময় থাকে), তাহলে বাসে না উঠে, চান্দের গাড়ী রিজার্ভ করে যাওয়া উত্তম। কারন তাহলে যাত্রাপথে পাহাড়শ্রেনীর অসাধারন রূপ উপভোগ করতে করতে যাওয়া সম্ভব। চান্দের গাড়ী বলতে যদি কারো কল্পনায় বিলাসবহুল মখমলের গদিযুক্ত কোন চর্তুচক্রযানের ছবি ভেসে ওঠে, তাহলে জেগে উঠুন। মান্ধাতা আমলের পেছন খোলা জীপ (সম্ভবত সরকারি নিলাম থেকে কেনা হয় এগুলো) এখা্নে চান্দের গাড়ী নামে পরিচিত। খোলা জীপ বলে চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করা খুবই আনন্দদায়ক হয়।


প্রায় ঘন্টা দুয়েক শম্বুক গতিতে চলার পর আমাদের বাস একটি ছোট্ট লোকালয়ে যাত্রাবিরতি করল মিনিট দশেকের জন্য। আমরা সবাই যার যার মত চা-পান-বিড়ি খেয়ে নিলাম। অনেকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চলে গেল। প্রকৃতি আমাকেও ডেকেছিল, কিন্তু নির্ধারিত স্থানে গিয়ে দেখলাম বন্যা হতে আর খুব বেশী বাকি নেই। তাই ভেসে যাবার ভয়ে এইদফা প্রকৃতিকে নিরাশ করে তার ডাকে সাড়া দেয়া থেকে বিরত থাকলাম।


কিছুক্ষন পরে আবার বাস ছাড়ল। আমরা তিনজন ঝিম মেরে বসে বাসের অন্যান্য যাত্রীদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। আমরা তিনজন এবং বাসের ড্রাইভার হেল্পার ছাড়া বাকী সবাই স্থানীয় আদিবাসী। তাই তাদের কথাবার্তা এক বর্নও বুঝতে পারছিলামনা। তবে এই আদিবাসী মানুষগুলোর কথাবার্তা, চালচলন, শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মধ্যে অদ্ভুত একটা সারল্য আছে যা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে।

এরা খুবই দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং অনেক পরিশ্রম করে জীবনধারন করে অথচ মুখের হাসিটা যেন চিরসুখী মানুষের।
প্রায় দুই ঘন্টা হামাগুড়ি দেয়ার পর বাস আমাদের এক জায়গায় নামিয়ে দিল। জানতে পারলাম যে বাস রুমাবাজার পর্যন্ত যায়না, বরং এখান থেকে চান্দের গাড়ী নিয়ে রুমাবাজার পর্যন্ত বাকীটা পথ যেতে হবে। চান্দের গাড়ী দাঁড়ানোই ছিল, তাই অসুবিধা হল না। আমরা চটপট উঠে বসলাম গাড়ীতে।

রুমাবাজার পর্যন্ত বাকীটা রাস্তার যা অবস্থা, তাতে আমি বলব, কারো যদি দীর্ঘদিনের বাতের ব্যথা বা কোমর ব্যথা থাকে, তাহলে এখানে আসতে পারেন একবার, ব্যথা কি জিনিষ বেমালুম ভুলে যাবেন।
রুমাবাজার পৌছনোর পর প্রথম কাজ একজন গাইড ঠিক করা। যদিও এখনকার উঠতি বয়সী প্রযুক্তি-সচেতন ছেলেপেলে গাইডের তোয়াক্কা করে না। বরং জিপিএস ট্র্যাকার জাতীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সহায়তায় নিজেরাই চলে যায় কেওক্রাডাং পার হয়ে জাদিপাই এর ঝর্না পর্যন্ত, কিম্বা সাতভাইখুম হয়ে অমিওখুম ঝর্না পর্যন্ত।
আমরা অত আধুনিকতার দিকে না গিয়ে সনাতন গাইড পদ্ধতির শরনাপন্ন হলাম।

লোকাল গাইড এসোসিয়েশনের অফিস থেকে পিয়াল বম্ নামে এক ১৮/১৯ বছর বয়সী গাইড ঠিক করা হল দিনপ্রতি ৪০০ টাকা চুক্তিতে।
আমরা দুপুরের খাবার পাট চুকিয়ে ফেললাম স্থানীয় হোটেলে। এর মধ্যে পরিচয় হল ঢাকার মিরপুর থেকে আসা একটা দলের সঙ্গে। সব কলেজ পড়ুয়া প্রানোচ্ছ্বল ছেলেপেলে। বয়সে আমাদের অনেক ছোট হলেও ওদের সাথে সহজেই মিশে গেলাম।

দূর পরবাসে দেশী মানুষ পেলে যেমন হয়, তেমনি পাহাড়ী অঞ্চলে 'ঢাকার পোলাপান' পেয়ে বয়সের পার্থক্য ভুলে গেলাম।
খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর এবার স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পে নাম নিবন্ধনের পালা। বাজারের কয়েকটা অলিগলি পেরিয়ে আমরা যখন ক্যাম্পের কাছে পৌছলাম, আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। ক্যাম্পটা একটা টিলার উপরে অবস্থিত, নীচে থেকে খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। ভরপেট খাওয়ার পর কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে জেনে মনে মনে গাইডের গুষ্ঠি উদ্ধার করলাম যে কেন আমাদের আগে বলেনি এত সিঁড়ি বাইতে হবে।


যা্-ই হোক, অনেক দম খরচ করে ক্যাম্পে গিয়ে নাম নিবন্ধন করালাম। মোটামুটি পূর্ন জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে হল। তবে ওদের দোষ দেয়া যাবেনা। কারন, আগেই বলেছি, এই অঞ্চলে এখনো অপহরন-ডাকাতি হয়। যদি আমাদের কেউ অপহরিত হয়, তাহলে তাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই সেনাবাহিনীর সদস্যদেরই পাহাড়ে জঙ্গলে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখতে হয় আর সেই সময় অপহরিতের স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়।


নাম নিবন্ধনের পর যখন আমরা বগার উদ্দেশ্যে চান্দের গাড়ীতে উঠে বসলাম, ঘড়িতে তখন প্রায় বেলা ৩টা। দিনের শেষ গাড়ী বলে গাড়ীতে একটু বেশী মানুষ হয়েছিল। কিছুদূর পর্যন্ত খোয়া বিছানো রাস্তা, তারপর আরেকটা ক্যাম্পে নাম নিবন্ধন। তারপর শুরু হল এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা। সেই পথের বর্ননা নাহয় না-ই দিলাম।


প্রায় ঘন্টাখানেক পরে জীপ আমাদের একটা ছোট্ট বাজারের প্রান্তে নামিয়ে দিল। বাজার বলতে কয়েকটা টিনের চালাঘর। মনিহারী সামগ্রী সাজিয়ে বসে আছে আদিবাসী লোকজন।
এখান থেকে শূরু হল পায়ে হাঁটা। ধীরগতিতে আমরা উঠতে শুরু করলাম।

আমাদের সাথে আসা মিরপুরের দলটা তরতর করে উঠে যেতে লাগল আমাদের পেছনে ফেলে। আমরা ওদের সাথে পাল্লা দিতে পারলামনা। বুঝলাম, বয়স নামের নীরব ঘাতক নীরবেই বাসা বাঁধছে শরীরে। একদিকে যেমন প্রচন্ড ক্লান্তি বোধ করছিলাম, অন্যদিকে তেমনি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম পড়ন্ত বিকেলে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। শীতের বেলা বলে সূর্য ইতিমধ্যে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।

পাহাড়ের মাথাগুলো বিদায়ী সূর্যের কাঁচা সোনা রোদ গায়ে মেখে যেন আমাদের দেখছিল। দম নেয়ার জন্যে আমরা কিছুক্ষন দাঁড়ালাম একটা জায়গায়। চারিদিকে সুনসান নিরবতা আর সাথে শিশির ভেজা লতাপাতার ভেষজ গন্ধ, এক অদ্ভুত ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল মন।
পাহাড়ী এলাকায় খুব হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নেমে আসে, তাই আমরা সেখানে খুব বেশী দেরী না করে আবার উঠতে শুরু করলাম। বেশ কিছু টিলা পেরোনোর পর একটা বাঁক ঘুরতেই যখন বগালেক দৃষ্টিসীমানায় ভেসে উঠল, মনে হল সব পরিশ্রম সার্থক।

সূর্য অনেকক্ষন আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাই লেকের পানি কালো দেখাচ্ছিল, কিন্তু লেকের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো সারি সারি পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন ম্রীয়মান সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে লেকের চারপাশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরী করছিল।
আমরা সেই দৃশ্য দেখে এতটাই শিহরিত হলাম যে তিন বন্ধু সব ভুলে গিয়ে পাগলের মত চীৎকার করে হাত পা ছুড়ে নাচতে লাগলাম।
প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর চোখে পড়ল বগালেক আর্মি ক্যাম্প (রনতূর্য সাত)। এটাও ছোট টিলার উপরে, তবে রুমাবাজারের মত অত খাড়া নয়। ওখানে নাম লেখানোর পর আমরা চলে আসলাম আমাদের কেবিনে।

'ওয়াই বি এ গেস্ট হাউস' নামটা শুনে যে একটা বিলাসবহুল চিত্র মনে ভেসে উঠেছিল, বাস্তবচিত্র অনেকটাই ভিন্ন। বাঁশের মাচার উপর টিনের চালা ঘর। কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। ঘরের ভেতর ৮/৯ টা কাঠের চৌকি পেতে তার উপর জীর্ন কাঁথা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ঘরের অন্যপাশের জানালাগুলো আর একটা দরজা খুলে দিতেই চোখ জুড়িয়ে গেল।

আমাদের কেবিনের ঠিক পরেই লেক শুরু।
আমরা সবাই ব্যাগ রেখে কাপড় পাল্টে কেবিন থেকে বেরিয়ে লেকের কোনায় ছোট্ট বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসলাম। মিরপুর গ্রুপের কয়েকজন তো লুঙ্গি পরে গোসল করতেই নেমে গেছে। ওদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস দেখে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে মগবাজার টিএন্ডটি কলোনীর পেছনে সোনালীবাগে।

আমাদের খেলার মাঠ ছিল টিএন্ডটি অফিসের ভেতরে। সেখানে মাঠের পাশে একটা বড় পুকুর (আমরা বলতাম 'পুষ্কুনি') ছিল। স্কুল বন্ধ থাকলে আমরা সকালেই বল নিয়ে চলে যেতাম সেই মাঠে আর খেলার পর ঝাঁপিয়ে পড়তাম ওই পুকুরে। বড় সুন্দর ছিল সময়গুলো।
বর্তমানে ফিরে আসি।

সন্ধ্যার পর তেমন কিছু করার ছিলনা, তাই কেবিনে বসে আড্ডা চলল। রুমা থেকে আমাদের সাথে যোগ দেয়া চট্টগ্রাম থেকে আসা তিন ব্যাংকারের সাথে আলাপ পরিচয় হল। এই মুহুর্তে হাবীব ব্যাংকের আমিনুল ভাইয়ের নামটাই মনে আছে শুধু। খুবই আলাপি মানুষ। গল্পে গল্পে রাত যখন ৮ টা, তখন আমাদের ডাক পড়ল রাতের খাওয়ার।

এই অঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন এখনো পৌছায়নি, সোলার এনার্জি ব্যবহৃত হয়। তাই এখানে লোকজন রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আমাদের কেবিনের সামনে একটা ছোট্ট খোলা মাঠের মত, তার উল্টো পাশেই আমাদের কেবিনের মালিক জুম্মন (আসল নাম: জিং মুনলিয়ান বম্) থাকে। কাঠের দোতলা ঘর। উপরে জুম্মন থাকে পরিবার নিয়ে আর নীচের ঘরে কয়েকটা টেবিল চেয়ার পেতে হোটেল বানানো হয়েছে।

জুম্মনের স্ত্রী রান্নাবান্রা করে। রসুইঘরটা পেছনে। বান্দরবানের গহীনে এই পাহাড়ী এলাকায় আমাদের খুবই অপরিচ্ছন্ন এবং নোংরা পরিবেশে আমাদের থাকতে হবে, এরকম মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল। কিন্তু জুম্মনের হোটেলটা আশাতীত রকমের ছিমছাম এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। তবে, এখানে বলে রাখি, ভোজনরসিক যারা, তাদের জন্যে বগালেক খুব একটা আদর্শ জায়গা নয় কারন এখানে তেমন কিছু পাওয়া যায়না।

আমরা আগেই বলে রেখেছিলাম খিচুড়ির কথা। আমরা গিয়ে বসার পর আমাদের সামনে পরিবেশিত হল লাকড়ির চুলায় রান্না করা গরমাগরম খিচুড়ি, সাথে ডিমভাজি আর মিষ্টি কুমড়া ভাজি, সাথে সালাত। কনকনে শীতের রাত, তার উপর সারাদিনের পরিশ্রম শেষে আমাদের কাছে মনে হল অমৃত। রান্নাটা সত্যি চমৎকার ছিল। এতই চমৎকার যে, আমরা পরদিন সকালের নাস্তার জন্যেও একই মেনুর ফরমায়েশ দিয়ে রাখলাম।

ভরপেট খেয়ে সবাই বাইরে খোলা মাঠে এসে বসলাম। জুম্মন আমাদের জন্য কাঠের বেঞ্চ আর কয়েকটা চেয়ার পেতে দিল।
ডিসেম্বরের এই সময়টাতে আমরা সাধারনত কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু বগালেকের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উপরে হওয়াতে মনে হয় কুয়াশা এত উপরে পৌছতে পারেনা। তাই রাত বাড়তে থাকার সাথে সাথে চাঁদের আর্বিভাব হল দিগন্তে।

কৃষ্ঞ পক্ষের ক্ষয়িষ্ঞু চাঁদ পূর্নরূপ পেতে বেশ অনেকটা রাত হল। পাহাড়ের পেছন থেকে উঠে আসা চাঁদের আলো যখন চারপাশ আলোকিত করে তুললো, আমরা সবাই মোহাবিষ্টের মত হয়ে রইলাম। রুমা থেকে আমাদের সাথে যোগ দেয়া সময় টেলিভিশনের স্পোর্টস রির্পোটার শাহীন ওর ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওকে দেখে যেন আমার মনে পড়ল আমার ব্যাগেও তো এসএলআর আছে। দৌড় দিয়ে গিয়ে ক্যামেরাটা বের করে নিয়ে আসলাম।

ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। এই ফাঁকে শাহীন আমাকে শিখিয়ে দিল কিভাবে শাটার স্পীড পরিবর্তন করে চাঁদের আলোর খেলাটা ছবিতে ধরা যায়। বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলাম। ভালোই হল ছবিগুলো।
এভাবে বেশ অনেক রাত হয়ে গেল।

আমরা কেবিনে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। সকালে কেওক্রাডাং যাওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছা আছে। সুপ্ত কারন, বগা পর্যন্ত পৌছাতেই আমাদের যে বেহাল দশা, তাতে কেওক্রাডাং পর্যন্ত পৌছানো হয়তো অসম্ভব মনে হতে পারে।
আগের রাত বাসে কেটেছে, তারপর সারাদিন পরিশ্রম, তাই বিছানায় গা এলানোর সাথে সাথে চোখ লেগে গেল আর এক ঘুমে রাত পার।
খুব সকালে ঘুম ভাঙল শাহীনদের ডাকে।

উঠে দেখি ওরা কেওক্রাডাং যাওয়ার জন্য তৈরী। চট্টগ্রামের ব্যাংকার গ্রুপ আজকেই চট্টগ্রাম ফিরে যাবে, তাই ওরাও শাহীনদের সাথে চিংড়ি ঝর্না পর্যন্ত যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। আমাদেরকেও যাবার জন্য অনেক পীড়াপিড়ি করল, কিন্তু আমরা ঘুমকাতুরে তিন বন্ধূ আবার কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
বেশ কিছুটা বেলা করে যখন উঠলাম আমরা, ব্যাংকার গ্রুপ ইতিমধ্যে চিংড়ি ঝর্না দেখে ফিরে এসেছে। ওদের ক্যামেরাতে ঝর্নার ছবি দেখে তো আমরা মুগ্ধ।

ঠিক হল যে, নাস্তা পর্ব সেরে আমরা ঝর্না দর্শনে বের হব।
জুম্মনের হোটেলে খিচুড়ি আর ডিমভাজি দিয়ে নাস্তা সারলাম। ব্যাংকার বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। অগ্রজদের পরামর্শ মত চিকন বাঁশের লাঠি নিয়ে নিলাম প্রত্যেকে। আমরা যারা পাহাড়ী পথে বছরে এক/দুই বার আসি, তাদের জন্যে এই লাঠি খুবই উপকারি জিনিষ।


আমাদের গাইড পিয়াল সকালেই শাহীনদের নিয়ে কেওক্রাডাং চলে গেছে। তাই আমরা তিন বন্ধু কোন সহায়ক ছাড়াই রওয়ানা হলাম চিংড়ি ঝর্নার উদ্দেশ্যে। বগা থেকে একটাই সর্পিল মেঠো পথ বেরিয়ে পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে, তাই দিক নির্ধারন করতে আমাদের কোন অসুবিধা হলনা। বেশ কিছুটা পথ পাহাড় আর প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে চললাম। পাহাড়ের গা বেয়ে চিকন পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে যেন অনন্তের পথে।

একপাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, আরেকপাশে পুরো খোলা, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ পাহাড়ের সারি। সূর্য প্রায় মাথার উপর চলে এলেও দূরের পাহাড়গুলো এখনো মনে হয় হালকা কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। কিছু কিছু টিলার গায়ে একচালা টিনের ঘর চোখে পড়ল। ওগুলো স্থানীয়রা জুম চাষের সময় থাকার জন্য ব্যবহার করে। কোন কোন টা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

বুঝলাম ওগুলোতে লোক আছে এখন।
শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে এখানে জীবন অনেক সহজ সরল। পাহাড়ের মানুষগুলো খুবই সাধারন জীবন যাপন করে। পার্থিব কোন ভোগ বিলাসিতার সুযোগ এদের নেই। কিন্তু সেই অভাবটা মনে হয় বিধাতা ন্যায্যভাবে পূরন করে দিয়েছেন প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য দিয়ে।


কিছুদূর যাওয়ার পর একটা দলের সঙ্গে দেখা হল যারা সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল, কেওক্রাডাং হয়ে ফিরে যাচ্ছে বগাতে।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা দিল বিপত্তি। একটা জায়গাতে পথ দুইভাগ হয়ে দুই দিকে চলে গেছে। আমরা মোহনায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন জল্পনা-কল্পনা করলাম। একবার মনে হয় ডানের পথ ধরি, আবার ভাবি বামেরটাই সঠিক রাস্তা।

পথ হারাবার ভয় ছিলনা মনে, কারন কিছুক্ষন পর পরই মানুষজন পাওয়া যাচ্ছিল। কেউ স্থানীয়, কেউ আমাদের মত বেড়াতে আসা। আমরা কোন জুয়া না খেলে পথের পাশে পড়ে থাকা গাছের গুড়িতে বসে আয়েশ করে সিগারেট (সংবিধিবদ্ধ সর্তকীকরন: ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর) ধরালাম আর অপেক্ষা করতে থাকলাম আবার কোন স্থানীয় মানুষের আগমনের। অনেকটা পাহাড়ি পথ চড়ার ফলে বেশ ক্লান্ত লাগছিল।
কিছুক্ষন পরে আমরা যেদিক থেকে আসলাম, সেদিক থেকে মানুষের আওয়াজ পাওয়া গেল।

দেখলাম কয়েকজন আদিবাসী মধ্যবয়সী মহিলা কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে চলেছে। ঝুড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বোঝাই করা। আমরা এগিয়ে যেতেই ওরা যেন বুঝে ফেললো যে আমরা পথের দিশা জানতে চাইব। তাই খিলখিল করে হাসতে লাগল আর নিজস্ব ভাষায় কি যেন বলাবলি করতে লাগল।
আমরা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম যে চিংড়ি ঝর্না কোন পথে যাব।

ওদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা কথা থেকে যা বুঝলাম, ওরা ওইদিকেই যাবে। ওদের গ্রাম কেওক্রাডাং পার হয়ে জাদিপাইপাড়া। চিংড়ি ঝর্না ওদের যাবার পথেই পড়বে। ওরা আমাদের ওদের সাথে আসতে বলল। আমরা এবার পথ হারাবার দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে ওদের অনুসরন করতে লাগলাম।

ওদের সাথে টুকটাক কথা হল। ওদের গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র পাওয়া যায়না। এসব কিনতে ওদের বগাতে যেতে হয়। অনেক দূরের রাস্তা, তাই ওরা সপ্তাহে একবার দল বেঁধে আসে।
পথে আমরা একটা প্রায় মৃত ঝিরি (স্থানীয় ভাষায় ঝর্নাকে ঝিরি বলে) দেখতে পেলাম।

আমাদের পাহাড়ী সঙ্গীদের কাছে জানতে পারলাম যে, বর্ষায় এখানে অনেক পানি থাকে। এখন শীতকাল বলে খুবই সূক্ষ জলধারা অবশিষ্ট আছে।
আমরা এগিয়ে চললাম ধীরে ধীরে। পথে কয়েকবার থামতে হল কারন বন্ধু শুভ খুব বেশী পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এভাবে থেমে থেমে প্রায় ঘন্টাখানেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যাবার পর আমাদের কানে এল পানির শব্দ।

কি যে সুমধুর সেই ঝিরিঝিরি ধ্বনি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তখন মনে হল, হয়তো এই আওয়াজের কারনেই আঞ্চলিক ভাষায় ঝরর্না হয়ে গেছে ঝিরি। আমাদের পথপ্রদর্শক পাহাড়ী দিদিরা আমাদের সাথে কিছুক্ষনের জন্য যাত্রাবিরতি করল ঝর্নার পাশে।
আমরা যেখানটাতে থামলাম, এখানে আসলে শুধু ঝর্না থেকে নেমে আসা একটা ধারা বয়ে যাচ্ছিল বড় বড় পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। মূল ঝর্নাটা চলার পথ থেকে বামদিকে বেশ অনেকটা উপরে।

ওখানে উঠার কোন আলাদা পথ নেই, বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে টপকে টপকে যেতে হয়। বড় পাথর মানে এত বড় যে কোন কোনটার উপর একজন পূর্নবয়স্ক মানুষ অনায়াসে শুয়ে থাকতে পারবে।
আমরা মূল ঝর্নায় ওঠার আগে কিছুক্ষন বসে জিরিয়ে নিলাম। দিদিরা দেখি তাদের ব্যাগ থেকে খালি বোতল বের করে ঝর্না থেকে পানি নিয়ে খাচ্ছে। আমরা তিনজন খুবই তৃষ্ঞার্ত ছিলাম কিন্তু ঝর্নার পানি এভাবে খাওয়া নিরাপদ কিনা ভাবছিলাম।

দিদিদের খেতে দেখে মনে হল খাওয়া যেতে পারে। আমরা প্রথমে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। শীতকাল হলেও অনেকটা পাহাড়ী পথ হেঁটে আসাতে আমাদের বেশ গরম লাগছিল। প্রত্যেকেই ঘেমে গিয়েছিলাম। ঝর্নার পানির শীতল স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল।

তারপর যখন আজলা ভরে পানি নিয়ে মুখে দিলাম, আহ.... কি যে শান্তি লাগল। মনে হল, বিধাতার সৃষ্টি এই শীতলতার কাছে মানুষের তৈরী রেফ্রিজারেটর তো কিছুই না।
আমরা প্রানভরে পানি পান করলাম। এরমধ্যে পাহাড়ী দিদিরা আবার পথে নামার জন্য প্রস্তুত, আরো অনেকটা পথ যেতে হবে ওদের। আমরা ওদের অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলাম আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য।

ওরা যাওয়ার আগে আমাদের কয়েকটা পাহাড়ী আমলকি বের করে দিল ব্যাগ থেকে। আমরা আবারো ওদের ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দিলাম আর মনে মনে মুগ্ধ হলাম এই স্বল্পশিক্ষিত পাহাড়ী মানুষগুলোর উষ্ঞ আন্তরিকতা দেখে। চলতি পথে দেখা হওয়া ক্ষনিকের সঙ্গী অচেনা মানুষকে আমরা 'শহুরে শিক্ষিত' মানুষরা কি কখনো আপ‌্যায়ন করার চিন্তা করি? অথচ এই গরীব অবহেলিত মানুষগুলো কত আন্তরিক।
দিদিরা পাহাড়ের বাঁক ঘুরে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার পর আমরা ঝর্নার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য পাথর টপকে টপকে উপরে উঠলাম। মূল ঝর্নাটা নেমে এসেছে প্রায় ৬০/ ৭০ ফুট উপর থেকে।

দীর্ঘদিনের পানির আঘাতে নীচে পাথরের চাতালের মত একটা জায়গা তৈরী হয়েছে। উপর থেকে পানি প্রথমে চাতালের উপর পড়ছে, তারপর পাথুরে দেয়াল বেয়ে নীচে একটা অগভীর ডোবায় জমা হচ্ছে আর অন্যদিক দিয়ে পাথরের ফাঁক গলে নেমে যাচ্ছে আমরা যেদিক থেকে উঠে এসেছি, সেদিকে। আমরা ওখানে বসে কিছুক্ষন ফটো সেশন করলাম।
শাহরিয়ার কেওক্রাডাং পর্যন্ত যাওয়ার প্রস্তাব দিল, আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম, তবুও ওর প্রস্তাবে আমি রাজী ছিলাম। কিন্তু বাধ সাধল শুভ।

ওর প্রবল আপত্তির মুখে আমরা আর দূরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
ফেরার পথ চিনতে খুব বেশী সমস্যা হলা না। কৈশোরে গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম যে, পাহাড়ে জঙ্গলে অচেনা পথে চলতে চিন্হ রেখে চলতে হয়। যাবার সময় ওই বিদ্যাটা কাজে লাগিয়েছিলাম, কিছুদুর পর পর গাছের ডাল ভেঙ্গে গেছি, তাই ফেরার পথে ভাঙ্গা ডাল লক্ষ্য করে অনায়াসেই ফিরে এলাম। এছাড়া আমরা ছাড়াও অনেকেই তখন কেওক্রাডাং হয়ে ফিরছিল।


আমরা যখন বগাতে ফিরে এলাম, তখন বেলা অনেকটা পড়ে গেছে। আমরা কেবিনে এসে ফ্রেশ হয়ে জুম্মনের হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলামবিকালটা লেকের আশপাশে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করে আর পাহাড়ের কোলে সূর্যাস্ত দেখে কেটে গেল। আগামীকাল ভোরে আবার শহুরে পঙ্কিল জীবনের উদ্দেশ্যে এই শান্তিময় জায়গাটা ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই সবার মন খারাপ হয়ে গেল।
তবে বিধাতা মনে হয় সিনেমার শেষ দৃশ্যের মত কিছু আকর্ষন আমাদের জন্য বাকী রেখেছিলেন। আগেই জুম্মনের কাছে জানতে পেরেছিলাম যে, এই অঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী।

লেকের পাশে ছোটখাট একটা গীর্জাও চোখে পড়েছে। রবিবার সকালে ওখানে বিশেষ প্রার্থনা হয়। রবিবার এখানকার লোকজন ছুটির দিন হিসেবে পালন করে আর তাই শনিবারের রাতে সবাই একটু বেশী রাত জেগে থাকে। অতএব আমরাও ঠিক করলাম যে বেশী রাত পর্যন্ত জেগে বগালেকের মাতাল জোছ্না যত পারি দেখে নেব, কে জানে আবার কখনো আসারা সুযোগ হয় কিনা। আমরা যথারীতি রাতের খাবার শেষে খোলা মাঠে বেঞ্চ পেতে বসলাম।

রাত বাড়ার সাথে সাথে পাহাড়ের ওপাশ থেকে চাঁদ উঁকি দিল। পুরো গ্রামটা এক অদ্ভুত আলো্‌ আঁধারির খেলায় মগ্ন হয়ে গেল যেন। কিছুক্ষন গল্পগুজব চলার পর সবাই চুপচাপ বসে বসে জোছনাস্নান করতে লাগলাম। হঠাৎ একটু দূর থেকে মিহি কন্ঠে গানের শব্দ ভেসে এল। গভীর রাতের সুনসান নীরবতার মাঝে গানের আওয়াজটা দারুন লাগল সবার কাছে।

জুম্মনের হোটেলের পাশ দিয়ে একটা মেঠো পথ উঠে গেছে পেছনের পাহাড়ের দিকে। ওই পথের দুই পাশে বেশ কিছু লোকবসতি আছে। তেমনি একটা ঘর থেকে আসছিল গানের শব্দ। আমরা ভাল করে শোনার উদ্দেশ্যে আমাদের বেঞ্চগুলো নিয়ে ওই ঘরটার পাশে এসে বসলাম চুপচাপ। যা বুঝলাম, একটা অল্প বয়সী মেয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় গান গাইতে চেষ্টা করছে আর একজন পুরুষ গীটার হাতে সঙ্গত দিচ্ছে।

মেয়েটা মিষ্টি কন্ঠে গাইছে, মাঝে মাঝে ভুল হলে বা কথা ভুলে গেলে নিজের ভুলে নিজেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। গীটারবাদক কিছুটা শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে, আবার নিজেও মেয়েটার হাসির সাথে তাল দিচ্ছে। কথাবার্তা আর হাসির শব্দ থেকে বুঝলাম ঘরের ভেতরে বেশ কয়েকজন শ্রোতা আছে।
আমাদের নীচুস্বরের কথাবার্তা আর নড়াচড়ার শব্দ থেকে ওরা টের পেল যে বাইরে মানুষ আছে। আমরা ভেবেছিলাম ওরা হয়তো দরজা জানালা লাগিয়ে দেবে বা গানই থামিয়ে দেবে।

কিন্তু ওরা তো কাঠখোট্টা শহুরে মানুষ না, তাই হয়তো আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েও নিজের মনে গান চালিয়ে গেল। চাঁদ ততক্ষনে পূর্নতা পেয়েছে। ওই আলোতে বসে সুরেলা কন্ঠের গান, কি যে অপার্থিব একটা পরিবেশ তৈরী করেছিল, সেটা লিখে বর্ননা করার জন্য কোন দক্ষ লেখকের কলমের খোঁচা দরকার। আমার মত অশিক্ষিত লেখকের সেই সাধ্য নেই।
ওখান থেকে আমরা যখন উঠলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই করছে।

গান তখনো চলছিল, কিন্তু সকালে ফিরতে হবে বলে আমরা আর বেশী দেরী করলামনা।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে জুম্মন আর তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন ফিরতি পথ ধরলাম, সবারই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বলে। ওঠার সময় যত কষ্ট আর সময় লেগেছিল, নামার সময় তার অর্ধেকও লাগলনা। বাঁশের লাঠির সহায়তা নিয়ে তরতর করে নেমে এলাম সবাই।
হোটেল প্লাজা বান্দরবানে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।

পরদিন সকালের বাসে ঢাকার পথে রওয়ানা হলাম আমরা। ও হ্যাঁ, ডিসি অফিস থেকে ক্যান্টনমেন্ট যেতে সাঙ্গু নদীর উপর যে ব্রীজটা, যতবার বান্দরবান আসি, রাতের বেলা ওই ব্রীজের উপর বসে আড্ডা দেয়াটা মিস করিনা। এবারো মিস করিনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।