গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।
২৪-০৫-২০১৩
আজ সন্ধ্যায় মালিক সমিতির মিটিং আছে। নোটিশ হয়েছে আগেই। মূল এজেন্ডা লিফটম্যান রাশেদ ও ১১ তলার স্থায়ী কাজের মেয়ের বিচার। এই দু’জনের মধ্যকার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অনেকে মালিক সমিতির কাছে অভিযোগ করেছে ইতোমধ্যে।
আমি বরাবরের মতো অফিস থেকে বাসায় ফিরে রেষ্ট নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমার ঠিকা কাজের মেয়ে জোহরা আসে কাজ করতে। বাসায় ঢুকেই সে আমাকে প্রশ্ন করে মামী, আজ নাকি রাশেদের বিচার হবে ? আমি সাথে সাথে বললাম, তাতে তোমার কি ? জোহরা বলে, ঐ ছেড়াডা আসলেই একটা বদ। লিফটে আমার সাথেও একদিন খারাপ ব্যবহার করছিল। আমি ওরে চড় মারতে চাইছিলাম।
জোহরার কথা শুনে আমি বললাম, কবে সেটা ? একদিনও তো বলনি ? জোহরা উত্তর দিল, পনর দিন অইব। মনে করছিলাম কাউরে কমুনা। অহন দেখতাছি ছোড়াডা আসলেই একটা বদ। নাইলে সবার সাথে ফাজলামি করব কেন ? আমিও আইজ ওর নামে নালিশ দিমু।
আমি সাথে সাথে বললাম, এখন আর নালিশ দিয়ে কি হবে ? রাশেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মোটামুটি হয়েই গেছে।
ওকে আর চাকুরীতে রাখা হবেনা।
এরপর এ নিয়ে জোহরার সাথে আমার আর কোন কথা হয়নি। আমি চোখ বুজে শুয়ে রইলাম। জোহরা এরইমধ্যে কাজ শেষ করে চলে যায়। সাড়ে আটটায় মিটিং।
এশার নামাজের সময় বলে ন’টায় শুরু হয়। আমি পৌণে ন’টায় গেলাম মিটিংএ যোগ দিতে। ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সদস্য ছাড়াও ভবনে বসবাসকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডাকা হয়েছে এই মিটিংএ। মিটিং শুরু হবার ৩০ মিনিট পার হতে না হতেই দেখলাম জোহরা এসে হাজির হয়েছে সেখানে। তখন রাশেদকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে।
আমি পেছনে বসা। জোহরাকে নিষেধ করব সেই উপায়ও নেই। সেক্রেটারী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি চাই ? জোহরা বলল, সে রাশেদের নামে নালিশ করতে এসেছে। এমন সময় সহ-সভাপতি সাহেব বলে উঠলেন, একথা এতদিন পর বলতে আসছ কেন ? জোহরা এর কোন উত্তর দেবার আগেই সেক্রেটারী সাহেব আবার বলেন, আমরা এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করছি। তুমি এখন বাইরে যাও।
আমরা পরে ডেকে নিব।
জোহরা বের হয়ে যায় অফিস কক্ষ থেকে। পূর্বের আলোচনা আবার শুরু হয় এবং উপস্থিত সবাই মোটামুটি একাত্ম হয় যে, রাশেদকে আর চাকুরীতে রাখা হবেনা। জোহরা ততক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিল। ডাকা হয় ওকে।
ভিতরে ঢুকে জোহরা সেই কথাগুলো পুণরাবৃত্তি করল যা সে আমাকে বলেছিল। তারপর আর দাঁড়ায়না জোহরা সেখানে। সম্পাদক সাহেব জানতে চাইলেন মেয়েটি কার বাসায় কাজ করে। আমি বললাম, আমার বাসায় এবং এই বিল্ডিং এর আরও কয়েক বাসায় কাজ করে সেগুলো কোনগুলো আমি জানিনা।
এরপর কমিটি আবার পূর্বের আলোচনায় ফিরে যায়।
সেটা হলো রাশেদ। সিদ্ধান্ত হয় চলতি পুরো মাসের বিতন চুকিয়ে দিয়ে রাশেদকে এখনই চলে যেতে বলা হবে। সংগে সংগে রাশেদকে ডেকে এনে তার অপরাধের কথা জিজ্ঞেস করা হলে সে অকপটে স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ। ওর কাছ থেকে তখনই লিফট এর চাবী নিয়ে নেয়া হয় এবং জানিয়ে দেয়া হয় যে সে আর এখানে চাকুরী করতে পারবে না। ম্যানেজারের কাছ থেকে পুরো মাসের বেতন নিয়ে সে যেন কাল সকালে এখান থেকে চলে যায়।
রাশেদ আর দাঁড়ায়না সেখানে। চলে যায় সেও।
পরক্ষণে সহ-সভাপতি সাহেব বলে উঠেন, এবার ঐ মেয়েটাকে ধরেন। সে কেন এতদিন পন নালিশ করতে আসল ? সে আর এই বিল্ডিংএ ঢুকতে পারবেনা। ওকে আগামী এক তারিখ থেকে এই ভবনে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হোক।
আমি সাথে সাথে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, কারও বাসার কাজের মানুষকে আপনারা এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারেন না। একটা ভালো কাজের মানুষ পাওয়া আজকাল অনেক দুরূহ ব্যাপার।
এতক্ষণ ধরে নিরবে বসে থাকা সভাপতি সাহেব আমার একথা শুনে বললেন, আপা, আপনাকে কয়দিন সময় দিলে সুবিধা হবে আর একটি কাজের মেয়ে খুঁজে নিতে ? এর উত্তরে আমি বললাম, এখানে সময় দেয়াটা বড় কথা নয়। অন্যের বাসার কাজের মানুষকে আপনারা কেন তাড়াবেন ?
অবশ্য একথাটা আমি বলে শেষ করতে পারিনি। সভাপতির পাশে বসা বিশিষ্ট দু’জন, যারা কমিটির সদস্য নন, তারা একযোগে বলে উঠলেন, এসবক্ষেত্রে কিসের সময় দেয়া ? আমাদের কথা শুনেন।
এই মেয়েকে এক্ষুণি অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন। এক তারিখ থেকে এই মেয়ে এই বিল্ডিংএ ঢুকতে পারবেনা। গেটে এক্ষুণি বলে দিন।
সাথে সাথে গেটে জানিয়ে দেয়া হলো। আমি কমিটির একজন সদস্য হয়ে দুইজন নন-সদস্যের এরকম হস্তক্ষেপের কারণে আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরতে পারিনি।
তাছাড়া আমার উপস্থিতিতে আমার কাজের মেয়েকে তাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। এক্ষেত্রে মেয়েটির বিরুদ্ধে অভিযোগ সে কেন এতদিন পর বলতে আসল তার সাথে অভিযুক্ত রাশেদের অসদাচরণের কথা। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম পুরো বিচার প্রক্রিয়ার একপেশে স্বৈরাচারী আচরণ দেখে। বিচারের নামে অবিচার বা প্রহসন বোধহয় একেই বলে। একজন অসহায় খেটে-খাওয়া গরীব মানুষের রুটি-রোজগারের উপর এমন আগ্রাসী তান্ডব মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।
কিন্তু সেই মুহূর্তে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কাছে আমি ছিলাম সম্পূর্ণ অসহায়। তবু আমি বসে থাকলাম মিটিং এর শেষ অবধি। কিন্তু মনের ভিতর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ক্রমশ দানা বাঁধছিল। আমার কাজের মেয়ে জোহরাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করার মাধ্যমে ওর প্রতি অবিচার তো করা হয়েছেই, এমনকি আমার ন্যয্য অধিকারও হরণ করা হয়েছে। আমি আবারও প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সভাপতি ও সহ-সভাপতি বরাবরে চিঠি লিখলাম।
চিঠিতে আমার বক্তব্য হলো দেরীতে বিচার চাইতে যাবার কারণে জোহরার উপর যে শাস্তি আরোপ করা হয়েছে তা স্বচ্ছতার মাপকাঠিতে উৎরে যাবার দাবী রাখেনা। তাছাড়া যে অপরাধে রাশেদকে বহিস্কার করা হয়েছে, জোহরার বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। আমি আরও একটি কথা বলেছি। সেটা হলো, কোন ব্যক্তি যদি খুনের অপরাধেও অপরাধী হয়ে থাকে তারও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থাকে। জোহরা যদি সত্যিই এই ভবনের শালীনতা নষ্ট করে থাকে তাহলে সেই অভিযোগ প্রমাণের আগেই তার উপর শাস্তি বলবৎ করা কতটুকু সমীচীন হয়েছে ? তাই আমি বলছিলাম যে, লিফটম্যান রাশেদের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে অপরাধ করেছে যে কাজের মেয়েটি সে এই ভবনের কোন এক ফ্ল্যাটে স্থায়ীভাবে থাকে।
কাজেই ঠিকা কাজের মেয়ে, যার বিরুদ্ধে সত্যিকার কোন অভিযোগ নেই, তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার আগে এটা নিশ্চিত করা হোক যে, এই ভবনের আর কোন স্থায়ী কাজের মেয়ে কখনও এই ধরনের কোন অপরাধ করবেনা। সর্বশেষ আমি বলেছি, যে মেয়েটি আমার বাসায় কাজ করে আমি মনে করি ওকে কাজে রাখার কিংবা কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার একমাত্র আমার। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, মালিক সমিতিকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তাহলে অবশ্যই এর পেছনে যুক্তিসংগত কারণ থাকবে এবং থাকতেই হবে। একটি খেটে খাওয়া মানুষের রুটি রোজগারের উপর হস্তক্ষেপ করা আগে সেই যৌক্তিক কারণটা জানা আমার বিশেষভাবে দরকার।
আমার চিঠি পাবার পর পরই ইন্টারকমে ফোন করেন সম্পাদক সাহেব।
তিনি বলেন আসল ব্যাপারটা তিনি খেয়াল করেননি। বিচার প্রক্রিয়াটি ঠিক হয়নি। তবে মেয়েটির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। আমি বললাম, আমি ঐ অভিযোগের প্রমাণ চাই। দেখি কি করতে পারি বলে উনি ফোন রেখে দিলেন।
পরদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই সভাপতি সাহেবের ফোন পেলাম। উনারও একই কথা। আপা মনে কষ্ট পেয়েছেন ? আসলে এভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। আমি বললাম, মনে কষ্ট পাবার ব্যাপারটা এখানে ঠিক নয়। মূল কথা হলো, আমি কমিটির একজন সদস্য এবং মেয়েটি আমার বাসায় কাজ করে।
অথচ আপনারা মেয়েটাকে বের করে দেবার ব্যাপারে আমার মতামত নেয়ার প্রয়োজনই মনে করলেন না। কমিটির সদস্য নয় এমন দু’জন ব্যক্তির চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আপনারা ওর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। আমি আপনাদের এ রায় মানিনা।
আমার কথা শুনে সভাপতি সাহেব দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আসলে ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। কিন্তু উনার করার কিছু ছিলনা।
এরপর আর কোন কথা হয়নি সম্পাদক ও সভাপতি সাহেবের সঙ্গে। আমি একটি ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, দু’জনই স্বীকার করছেন যে কাজটি ঠিক হয়নি। কিন্তু এক তারিখ থেকে জোহরাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ওর উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সে বিষয়ে তারা কেউ কিছু বললেন না। আমি তাই মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম যে কমিটির সিদ্ধান্ত আমি কিছুতেই মানব না। আগের সমিতি আমার চিঠির জবাব দিবে তারপর আমি সিদ্ধন্ত নিব জোহরাকে আমি রাখব নাকি ছাড়িয়ে দিব।
জোহরাকে বলে রাখলাম এক তারিখে এই ভবনে ঢুকার সময় ওকে যদি গেটে আটকায় তাহলে ও যেন আমাকে একটা ফোন দেয়।
ঠিক তাই হলো। ১লা জুন, শনিবার। আমি সারাদিন বাসায় বসে রইলাম। জোহরা বিকেলে গেট থেকে ফোন দিল।
আমি নিচে নেমে গিয়ে সিকিউরিটিকে বললাম, আমি ওকে আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। যারা তোমাদেরকে বাধা দিতে বলেছিল, তাদেরকে বলে দাও যে আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। এখানে আর একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। সেটা হলো এক তারিখ সকালবেলা আমি সম্পাদক ও সভাপতি সাহেবকে ফোনে জানিয়েছি যে, আপনারা যেহেতু আমার চিঠির কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তাই আপনাদের রায়ের বিরোধীতা করে আমি জোহরাকে বাসায় ঢুকাব। সম্পাদক সাহেব ছিলেন ঢাকার বাইরে।
তাই তার অনুরোধে দুপুরবেলা সভাপতি ও ট্রেজারার সাহেব আমার বাসায় এসে আমাকে জানালেন আমি যেন এই কাজটা না করি। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। এ কারণে যে, আজ যদি আমি তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিই তাহলে যে অন্যায়টা উনারা করেছেন সেটা প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ করে দেয়া হবে।
স্বাভাবিকভাবে আমার একাজটি কমিটির মুখে চপেটাঘাতের মতো লাগে। তারা তাড়াতাড়ি আগামী চার তারিখে জরুরী মিটিং ডাকে।
আমিও উপস্থিত হই সেই মিটিংএ। সেক্রেটারী সাহেবের প্রথম অভিযোগ কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে আমি জোহরাকে বাসায় ঢুকিয়েছি। আমার উত্তর, হ্যাঁ আমি তা করেছি। কারণ, উপযুক্ত কারণ না দেখিয়ে আমার বাসার কাজের মেয়েকে আপনারা তাড়িয়ে দিতে পারেননা। তা ও আপনাদেরকে এক তারিখ পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু আপনারা আমার চিঠির কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
এমন সময় সভাপতি সাহেব বলেন, আর যাই হোক, এই মেয়েকে আপনি কাজে রাখতে পারবেন না। এই মেয়ের চরিত্র ঠিক নেই। নানা জনে নানা কথা বলে ওর সম্পর্কে। আমি বললাম, জোহরা আমার বাসায় চিরদিন কাজ করবে এমন কোন কথা নেই।
প্রথম দিন যখন মেয়েটার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সে এতদিন পর বিচার চাইতে এসেছে কেন ? আর যখন আপনাদের বিচার প্রক্রিয়াকে আমি চ্যালেঞ্জ করলাম তখন ওর চরিত্র নিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। ও রাস্তা দিয়ে হেলেদুলে চলে, গান গায়, শরীরের কাপড় ঠিক থাকেনা, মোবাইলে বেশী কথা বলে, কেউ কিছু বললে মুখের উপর জবাব দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, ও আমার বাসায় আসে, কাজ করে চলে যায়, বাইরে কিভাবে হাঁটাচলা করে তা নিয়ন্ত্রণ করা আমার কাজ নয়। তাছাড়া আপনাদের পারমানেন্ট যে কাজের মেয়ে সে বাইরে গেলে তার চলাফেরা কি আপনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে ? সে বাইরে গিয়ে যে এসব করেনা তা কি আপনারা জোড় দিয়ে বলতে পারবেন ?
এমন সময় কমিটির একজন বলে উঠলেন, একটা কাজের মেয়ের পক্ষে আপনি এত কথা বলছেন কেন ? এই মেয়ের চরিত্র ঠিক নেই আমরা আগ থেকে জানি। আমি বললাম, এই চরিত্রের সাফাই গেয়ে আমি আমার চিঠিতে একটিও কথা বলিনি, এখনও বলছিনা।
আমার প্রশ্ন হলো, এই মেয়েটা গত দুই বছরেরও বেশী সময় ধরে এই ভবনের বিভিন্ন বাসায় কাজ করছে। ওর সম্পর্কে আপনাদের এত অভিযোগ। কই ? কেউ তো কোনদিন খোঁজ করেননি যে মেয়েটি কোন বাসায় কাজ করে ? নিশ্চয়ই ও এই ভবনে হাওয়া খেতে আসেনা। আপনারা আগে বললে আমিও হয়তো ওকে কাজে রাখতাম না।
বলা বাহুল্য আমার এই প্রশ্নের জবাব সেখানে উপস্থিত কেউ দিতে পারেনি।
উপরোন্তু সভাপতি সাহেব দুঃখ প্রকাশ করেন প্রথম দিনের বিচার প্রক্রিয়াটি ঠিকমতো না করার কারণে। আমি বললাম, আমার প্রতি দুঃখ প্রকাশ করলেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবেনা। মেয়েটি এই ভবনের আরও কয়েক বাসায় কাজ করে। এমন সময় সহ-সভাপতি সাহেব বলে উঠলেন, মেয়েটা আরও যেসব বাসায় কাজ করে তারা তো কেউ কিছু বলছে না। তাহলে আপনার এত লাগছে কেন ? আমি উত্তর দিলাম, আমার লাগছে।
কারণ, প্রথম দিনের মিটিংএ ঐসব বাসার কোন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলনা। উপস্থিত ছিলাম আমি এবং জোহরার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমি কথা বলতে গেলে আমাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া অন্য যেসব বাসায় জোহরা কাজ করে তাদেরকে তো আপনারা জানানোরই প্রয়োজন বোধ করেননি যে, তাদের কাজের মেয়েকে আপনারা তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের একজন ই/৯ এর মঙ্গলবাবু, যার বাসায় জোহরা রান্না করে। আমাকে জানানো হলো মঙ্গলবাবু ইতোমধ্যে জোহরাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন শুধু জোহরা আমার জন্য এই ভবনে ঢুকছে। আমি বললাম, ঠিক আছে সবাই যদি তাড়িয়ে দিয়ে থাকে তাহলে আমিও তাড়িয়ে দিব।
কিন্তু কোন কিছু যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নেবার পাত্রী আমি নই। বাসায় এসেই ইন্টারকমে ফোন করি মঙ্গলবাবুর বাসায়। উনার ছোটভাই ফোন রিসিভ করে জানালেন উনি ঘুমুচ্ছেন।
আমি মঙ্গলবাবুর ছোট ভাই এর সাথেই কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা নাকি জোহরাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন ? এখন শুধু আমার কারণে সে এই ভবনে ঢুকছে।
সাথে সাথে উনি প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, মোটেই না। উনাদের সিদ্ধান্তে আমরা কেন আমাদের কাজের মেয়েকে তাড়িয়ে দিব ?
আর কিছু বলতে হয়নি। আমি বুঝে নিলাম যে আমাদের একজনকে দিয়ে আর একজনকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে মালিক সমিতি।
আমি সাথে সাথে মালিক সমিতির সেক্রেটারী সেন্টু সাহেব, যিনি মিটিংএ উপস্থিত ছিলেন, তাকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম আমার সাথে এই প্রতারণার আশ্রয় কেন নেয়া হলো ? এতবড় একটা মিথ্যাচার কেন করা হলো আমার সাথে ? আমি উনার কাছে এর জবাব চাইলাম। উনি পরে জানাবেন বললেন। কিন্তু এরপর উনি এ নিয়ে আমার সাথে আর কোন যোগাযোগ করেনি। আমি পরদিন জোহরা কাজ করতে আসলে ওকে বুঝিয়ে বললাম আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধিটা।
এখন জোহরার সাথে মালিক সমিতির সদস্যরা যে ব্যবহারটা করবে সেটা হলো ‘যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। ’ বললাম তোমার বোনকে আমার বাসায় কাজে দিয়ে তুমি আপাতত আমার বাসা থেকে বিরত থাকো। জোহরা জানাল, ওর বোন গতকালই বাড়ি গেছে। ১০ তারিখে আসবে। আমি জোহরাকে ১০ তারিখ পর্যন্ত কাজ করতে বললাম।
এর ঠিক দুই দিন পর জোহরা এসে জানাল যে মালিক সমিতির সহ-সভাপতির সাথে মঙ্গল বাবুর চরম বাক-বিতন্ডা হয়েছে ওকে নিয়ে। মঙ্গলবাবু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, উনার বাসার কাজের মেয়ের ব্যাপারে যেন কেউ নাক না গলায়।
এরপর ১০ তারিখে জোহরার বোন রাবেয়া আসলে ওকে রেখে জোহরাকে বিদায় করে দিই আমি। কিন্তু এই ভবনের অন্য দুই বাসায় জোহরা কাজ করে যেতে লাগল। মনে মনে খুশী হলাম আমি মালিক সমিতির এই নৈতিক পরাজয় দেখে।
এর কিছুদিন পর সর্বশেষ যে তথ্যটা আমার কানে আসে তা হলো, মূল সমস্যা যে কাজের মেয়েকে নিয়ে অর্থাৎ লিফটম্যানে রাশেদের সাথে যে কাজের মেয়ের প্রেমকে কেন্দ্র করে এত ঘটনা, সেই কাজের মেয়ে তখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও প্রথম দিন মালিক সমিতির মিটিং থেকে বলা হয়েছিল যে, ওকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
মালিক নৈতিক পরাজয়ের দ্বিতীয় আর একটি উদাহরণ সৃষ্টি করে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সহ-সভাপতি সাহেব, যিনি প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন জোহরাকে এই ভবনে ঢুকতে না দেয়ার জন্য। এর আগে বলে রাখা ভালো যে নভেম্বর মাসে জোহরার বোন রাবেয়ার বিয়ের সম্বন্ধ আসায় ও দেশে চলে যায়। আমি আবার জোহরাকে ডেকে আনি আমার বাসায় কাজ করতে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিন জোহরা এসে জানায় যে তাকে সহ-সভাপতি সাহেব গত রাতে ডেকে নিয়েছিল তাদের বাসায় রুটি বানানোর জন্য। কারণ, তাদের বাসার কাজের মেয়ে চলে গিয়েছে। সাথে সাথে তার বাসায় কাজ করার জন্যও জোহরাকে বলে। জোহরা জানায়, অন্যান্য বাসায় কাজ করতে করতে ওর রাত দশটা বেজে যায়। ওর পক্ষে সম্ভব নয় নতুন কোন বাসা নেয়া।
সহ-সভাপতি সাহেব বলে দিয়েছে, যত রাতই হোক তার বাসায় কাজ করতে হবে। সবশেষ জোহরা বলে এসেছে যে, তার বাসায় যে কাজ তাতে তিন হাজার টাকা না দিলে তার পোষাবে না। তারপর খোঁজ নেয় আমার বাসায় কবে থেকে কাজ করে, আমি কত টাকা দিই ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে আরও একটি কথা বলে রাখতে চাই যে, আমি এখন যে বাসায় থাকছি, ২০০৩ সাল থেকে এর পাশের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতাম। তখন থেকে জোহরা আমার বাসায় কাজ করে আসছে।
যাই হোক, এর ২/৩ দিন পর আবার জোহরা এসে জানায় যে, সহ-সভাপতি সাহেব তাকে গতরাতে আবার ডেকে নিয়ে ২০০০ টাকায় কাজ করতে বলেছে। কিন্তু জোহরার এক কথা, তাদের বাসায় অনেক কাজ। ৩০০০ টাকার নিচে সে কাজ করবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।