২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার বাংলামোটরে ডিউটিতে ছিলেন সার্জেন্ট হেলালউদ্দীন ভূঁইয়া। আর মহাখালীতে ছিলেন সার্জেন্ট আলাউদ্দিন। দুজনের ওয়াকিটকিতেই মেসেজ আসে। হেলালকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের দফতরে (ডিবি অফিস) এবং আলাউদ্দিনকে হাজির হতে বলা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (উত্তর) ট্রাফিক কার্যালয়ে। দুজনই মেসেজ অনুযায়ী গন্তব্যে পেঁৗছেন।
আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ দুজনকেই অভিযানের কথা বলে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে তুলে নেয়। তাদের প্রথমে উত্তরা র্যাব অফিস এবং পরদিন চট্টগ্রাম র্যাব-৭ কার্যালয়ে নেওয়া হয়। র্যাব কার্যালয়ে হেলালকে দেখামাত্র এক কর্মকর্তা হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন। অন্য কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ওকে এখানে এনেছ কেন? ওকে তো ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা! এ কথা বলেই হেলালকে রড দিয়ে পিটিয়ে একটি পা ভেঙে দেন ওই কর্মকর্তা। পেটাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, 'তোর কারণে দেশে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে'।
অপর সার্জেন্ট আলমগীরের শরীরের ওপর চলে আরও ভয়ঙ্কর নির্যাতন। পুলিশের এই দুই সার্জেন্ট হেলালউদ্দীন আর আলাউদ্দিনের সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার কারণেই ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে উদ্ধার হয়েছিল ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান। অনেকেই ভেবেছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাহস ও সততার জন্য পুরস্কৃত হবেন তারা। কিন্তু পুরস্কৃত হননি তারা। উল্টো খড়গ নেমে আসে সাহসী এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার ওপর।
চাকরি হারান। তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। মিথ্যা অস্ত্র মামলার আসামি হয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ২৭ মাস। এর আগে এক বছর পালিয়ে বেড়িয়েছেন ফেরার হয়ে। মামলা চালাতে গিয়ে ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে।
সমাজে হয়েছেন ধিকৃত। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের কাটাতে হয়েছে মানবেতর জীবন। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের নায়ক এই দুই সার্জেন্ট হলেও তাদের জীবন হয়েছে তছনছ। এখন তাদের দিন কাটছে নিরাপত্তাহীনতায়। অথচ হেলাল আর আলাউদ্দিনের এই সাহসিকতার ঘটনাটি স্থান পেয়েছে নতুন সার্জেন্টদের পাঠ্যসূচিতে।
সাহসিকতার নিদর্শন হিসেবে যখন এই দুই সার্জেন্টের এ ঘটনাটি উদাহরণ হিসেবে শিক্ষার্থী সার্জেন্টদের বলা হয়, হয়তো তখনই ভাঙা পায়ের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন সার্জেন্ট হেলাল।
দীর্ঘ ছয় বছর পর আদালতের নির্দেশে চাকরি ফেরত পেয়েছেন সেই দুই সার্জেন্ট হেলাল এবং আলাউদ্দিন। আলাউদ্দিন নিয়মিত পদন্নোতি পেয়ে পরিদর্শক হয়েছেন। বর্তমানে তিনি এসপিবিএন-এ রয়েছেন। আর সার্জেন্ট হেলালের পদন্নোতি পর্যন্ত হয়নি।
তার বর্তমান কর্মস্থল চট্টগ্রাম সদরঘাট ডাম্পিং স্টেশন ও ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম। পা ভাঙার পর বিনা চিকিৎসার কারণে ঠিকমতো ভাঙা পা জোড়া লাগেনি। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। ব্যথায় কখনো কুঁকড়ে যান। চিৎকার করে কান্না করেন।
১০ ট্রাক অস্ত্র থেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল খোয়া গেছে এবং সেগুলো এই দুই কর্মকর্তা চুরি করে বিক্রি করেছেন_ এ অভিযোগে নির্মম অত্যাচার চালানো হয় তাদের ওপর। পিটিয়ে পা ভেঙে দেওয়া হয় সার্জেন্ট হেলালের। অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকেও। দুর্ধর্ষ আসামির মতো পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করা হতো আদালতে। পরে অপরাধ তদন্ত বিভাগের রিপোর্টে দেখা যায়, ১০ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যে কোনো একে-৪৭ রাইফেলই ছিল না।
জীবনবাজি রেখে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান মাত্র দুজনেই আটকে দিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিলেও তারা আর তা মনে করতে চান না। চাকরি ফিরে পেলেও দুঃখ আর কষ্ট নিয়ে এই দুই সার্জেন্ট তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। হেলালউদ্দীন ও আলাউদ্দিন চাকরি ফিরে পেয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, কে ফিরিয়ে দেবে তাদের হারানো সময়? ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন বলেন, সব মানুষের কাজের একটি পিক টাইম থাকে। আমি তো জীবনের সেই সময় হারিয়ে ফেলেছি।
এখন আমি বৃদ্ধ। ছয় বছর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শেষে নতুন জীবন পেয়েছি বটে, তবে সে জীবনের কোনো স্বাদ নেই। আমার পুরো জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। সামাজিক জীবনে আমি আর আমার পরিবার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন হয়েছে তছনছ।
সার্জেন্ট হেলাল বলেন, জীবনের মায়া ত্যাগ করে সেদিন অস্ত্র আটক করেছিলাম। আমাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। আমরা কিছুটা অাঁচ করতে পেরেছিলাম যে, এতে বড় ধরনের কেউ জড়িত রয়েছে। এর পরেও আমরা পিছপা হইনি। আমাদের সেই কাজ আর মনে করতে ইচ্ছা হয় না।
এ অস্ত্র উদ্ধার করেই জীবনটা ওলট-পালট হয়ে যায়। আমাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।
যা ঘটেছিল সেদিন : অনুসন্ধানে জানা গেছে, অস্ত্র আটকের প্রায় এক বছর পর এই দুই সার্জেন্টকে ঢাকায় পোস্টিং দেওয়া হয়। এরও তিন মাস পর তাদের ডেকে পাঠানো হয় ডিবি ও ট্রাফিক অফিসে। সেখান থেকে ঢাকা র্যাব অফিসে নেওয়ার পর সেখানে একজন র্যাব কর্মকর্তা নিজেকে কর্নেল গুলজার পরিচয় দেন।
তার টেবিলে থাকা দুটি একে-৪৭ রাইফেল দেখিয়ে বললেন, 'এ অস্ত্র দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রের দুটি। ' এ অস্ত্র সম্পর্কে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। হেলালকে নেওয়ার আগে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরদিন (২০ আগস্ট) তাদের দুজনকে চট্টগ্রাম র্যাব-৭ এর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভোর আনুমানিক ৬টায় র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন র্যাবের এক কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করেন হেলাল কার নাম।
নাম বলতেই তাকে ধরে বেধড়ক পেটানো শুরু হয়। একপর্যায়ে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে তার বাম পা ভেঙে দেওয়া হয়। পা ভাঙার পর হেলাল তাকে কেন মারা হচ্ছে জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা তাকে বলেন, 'তোর কারণে দেশে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। '
আগের দিন ১৯ আগস্ট সকাল ৭টায় উদ্ধার করা নোয়াখালীর সুধারাম থানার অস্ত্র মামলার আসামি হিসেবে তাদের দুজনকে নোয়াখালী কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অথচ তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয় ওই দিন বিকালে।
দীর্ঘ দেড় মাস বিনা চিকিৎসায় নোয়াখালী কারাগারে ভাঙা পা নিয়ে দিন কাটান সার্জেন্ট হেলালউদ্দীন। এর মধ্যে তাদের খুনের দুর্ধর্ষ আসামির মতো ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে সাক্ষী দিতে নেওয়া হয়। এ সময় তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে বিদেশি বন্দীদের সঙ্গে ২৫ নং ওয়ার্ডে রাখা হয়। যেখানে বেশ কয়েকজন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ উলফার সদস্য বন্দী ছিল। যারা তাদের পাশেই থাকত।
আদালতে সাক্ষী দিতে আনার পর একটি কাগজ দেওয়া হয় হেলালউদ্দীনকে। সেখানে যা লেখা ছিল আদালতে তা বলার জন্য বলা হয়। পরে ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনের আদেশ দিলে ১৩ নভেম্বর নোয়াখালী কারাগার থেকে জামিনে বের হন তারা। তারা নিয়মিত অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২৪ জুন হেলালকে ডাকা হয় চট্টগ্রাম কারাগারে।
কারাগারে টিআই প্যারেডের (শনাক্তকরণ মহড়া) মাধ্যমে মেজর লিয়াকতকে চিহ্নিত করেন হেলাল। তিনিই ঘটনার রাতে সিইউএফএল ঘাটে নিজেকে উলফা সদস্য আবুল হোসেন বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এতে ঘটল আরেক বিপত্তি। শনাক্তকরণ মহড়ার পরপরই হেলালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। আবারও কারাগারে যাওয়ার ভয়ে তিনি পালিয়ে যান।
ফেরারি আসামির মতো এক বছর পরিবার-পরিজন ছেড়ে তাকে পালিয়ে থাকতে হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা পুনরায় তদন্ত শুরু হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনিরুজ্জামান চৌধুরী তার তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ১০ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যে কোনো একে-৪৭ রাইফেল ছিল না। সার্জেন্ট হেলাল ও সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে একে-৪৭ রাইফেল রাখার দায়ে অস্ত্র মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সিআইডির এ রিপোর্টের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩তম সভায় দুই সার্জেন্টের নাম অস্ত্র মামলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
২০১১ সালের আগস্টে দুজনই আবার চাকরিতে যোগদান করেন। কুমিল্লার চান্দিনার মৃত আমীর আলীর সন্তান সার্জেন্ট হেলাল। তার বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার মা হোসনে আরা এখনো চান্দিনার বরকুইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কয়েক দিন পর চাকরি জীবনের ইতি টানবেন।
২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট থেকে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত এই দুই সার্জেন্টের জীবনে ছিল চরম ক্রান্তিকাল। কঠিন এক দুঃসময়ের মধ্যে তাদের পরিবারের সদস্যরা কালযাপন করেছেন এ ছয়টি বছর। একে-৪৭ রাইফেল হাতে দেওয়া তাদের ছবি যখন পত্রিকায় প্রকাশ পায়, তখন তাদের সন্তানরা স্কুলে যেতে পারতেন না। কোনো অপরাধ না করেও সামাজিকভাবে হতে হয়েছে হেয়প্রতিপন্ন।
চাকরিতে যোগদানের পর বেতন-ভাতা পেলেও ছয় বছরের পরিবারের রেশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন হেলালউদ্দীন।
যা ছিল তার ন্যায্য পাওনা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হারিয়েছেন পায়ের ভারসাম্য। অস্ত্র মামলায় জামিন নিতে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে পৈতৃক সম্পত্তি। প্রতিনিয়ত চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন নিজে ও পরিবারের সদস্যরা। পা ভাঙার পর বিনা চিকিৎসার কারণে ভাঙা পায়ে ঠিকমতো লাগেনি জোড়া।
সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না সার্জেন্ট হেলাল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।