বিএনপি নেতা-কর্মীরা এখন না পুরোদমে আন্দোলনমুখী, না নির্বাচনমুখী। গুম, খুন, হামলা-মামলায় হতাশাগ্রস্ত নেতা-কর্মীরা এখন চরম অস্থিরতায় ভুগছেন। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ও এখন অনেকটাই চুপচাপ। উপজেলা নির্বাচনের বার্তা ছাড়া কেন্দ্র থেকে কোনো দিক নির্দেশনা পাচ্ছেন না মাঠের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা অংশ নিলেও নেতা-কর্মীরা এখনো উৎসবমুখর নন।
আগের মতো চাঙ্গাভাব নেই। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে তাদের মধ্যে যেমন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তা তৃণমূলে এখনো অনুপস্থিত। এদিকে উদ্যোগ নিয়েও হঠাৎ অজ্ঞাতকারণে বন্ধ করে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফর। দল গোছানোর কথা বলা হলেও কেন্দ্রে এ নিয়ে কোনো কার্যক্রমই নেই। দল গোছানোর কাজ কবে থেকে শুরু হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সব মিলিয়ে কোন পথে যাচ্ছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপি- তা নেতা-কর্মীদের কাছে এখনো অস্পষ্ট। বিএনপি কোন পথে যাচ্ছে জানতে চাইলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি এখন উপজেলা নির্বাচনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এই নির্বাচনের পরই বিএনপির আন্দোলন, সাংগঠনিক সফর, দল গোছানো সবকিছুই জনমনে পরিষ্কার হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অবশ্য গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে সহিংসতা ও অস্থিরতা চায় না বলেই বেগম খালেদা জিয়া চুপচাপ বসে আছেন। তিনি ডাক দিলে এই সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না।
এ সরকারকে চলে যেতে হবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে বিএনপির আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। এ পর্যন্ত বিএনপি অপেক্ষায় থাকবে। উপজেলায় ভালো ফল এলে সরকারবিরোধী আন্দোলন এক ধরনের হবে। অন্যদিকে মন্দ ফল হলে আন্দোলন অন্যরূপ নেবে।
জানা গেছে, আগামী সেপ্টেম্বরের আগে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে না বিএনপি। উপজেলা নির্বাচন, পরবর্তীতে ইউপি নির্বাচন, বর্ষা, রমজানসহ দুই ঈদের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি আসবে না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কোরবানি ঈদের পরই নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় মামলায় অভিযুক্ত বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এখনো ঘরছাড়া। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন কোনো উৎসাহ কাজ করছে না।
জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অনেকেই আবার গুম, খুনের শিকারও হচ্ছেন। সিরাজগঞ্জের তিন বিএনপি নেতা মামলার আসামি হয়ে জামিন নিতে হাইকোর্ট এলাকা থেকে গুমের শিকার হন। পরবর্তীতে তারা তিনজনই বিভিন্ন স্থানে লাশে পরিণত হয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ওভারব্রিজ এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৫) নামে বিএনপির এক কর্মীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জাহাঙ্গীর সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের বাসিন্দা।
এদিকে নাটোরে একজন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ সাতজন হাইকোর্টে জামিন নিতে গিয়ে চারজন নিখোঁজ হন। এখনো পর্যন্ত ওই উপজেলা প্রার্থীসহ চারজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছে বিএনপি। অবশ্য পুলিশের দাবি, জাহাঙ্গীর জেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলার ১৮ নম্বর আসামি।
সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কায় বিএনপি : আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ নিয়ে আশঙ্কায় বিএনপি। দলের তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিদিন কেন্দ্রে র্যাব, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণায় নানাভাবে বাধার অভিযোগ আসছে।
বিভিন্ন এলাকায় নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা হুমকির খবর পাওয়া গেছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীসহ স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। এদিকে স্থানীয় নেতাদের পরামর্শে একক প্রার্থী দেওয়া নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ইতোমধ্যে ১৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে আজ তৃণমূল নেতাদের সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়ে কেন্দ্র থেকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। তৃণমূলে নানা বাধা-বিপত্তি নিয়ে আজ দলের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনও করা হতে পারে।
দলের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, এখনো হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা অনেকটা গোপনে গোপনে প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রকাশ্যে এলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা ধরনের বাধা-নিষেধ আসছে। তারপরও নির্বাচন মোটামুটিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে দল সমর্থিত প্রার্থীরা অধিকাংশ উপজেলায় বিজয়ী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে উপজেলা নিয়ে কাজ করছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান, বরকতউল্লাহ বুলু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, রুহুল কবীর রিজভী এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী আসাদুজ্জামান আসাদ। কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মাঠ পর্যায়ে একক প্রার্থী দেওয়ার জন্য শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে বিদ্রোহ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা বলেন, আসন্ন ১৯ ফেব্রুয়ারিতে ৯৭ উপজেলা নির্বাচনের প্রায় ৯০ ভাগে একক প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সূত্রে জানা যায়, হামলা-মামলার ভয়ে এখনো এলাকাছাড়া বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ।
তা ছাড়া উপজেলায় সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নানা আতঙ্ক নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যৌথবাহিনীর হামলার আশঙ্কা তাদের। এ ছাড়া স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের ভয়েও প্রার্থীরা। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়েও সংশয়ে এসব প্রার্থী।
শুক্রবার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হোসেন মিয়ার সমর্থনে প্রচারণা শেষে ফেরার পথে বরিশালের গৌরনদীতে বিএনপির সহসভাপতি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তমের গাড়িবহরে হামলা করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা।
এ সময় আবুল হোসেনের ব্যবহৃত মাইক্রোবাসে ভাঙচুর চালায় তারা। এ প্রসঙ্গে আলতাফ হোসেন চৌধুরী জানান, প্রচারণায় বহরের সামনে থাকায় তাদের গাড়ি হামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে বহরের পেছনে থাকা চেয়ারম্যান প্রার্থীর গাড়িটি ছাত্রলীগ ভাঙচুর করেছে এবং এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু অভিযোগ করেন, সদর উপজেলায় দলীয় প্রার্থী মজিবুর রহমান লেবুর পক্ষে প্রচারণা চালানোর কারণে খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করীমের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের মোড় গ্রাম ঘেরাও করে রাখে পুলিশ।
হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে প্রার্থী প্রকাশ্যে প্রচারণা চালাতেও ভয় পাচ্ছেন।
নাটোর জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীন অভিযোগ করে বলেন, সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী ইবরাহীম খলিল সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হন। ওই সময় আরও তিনজন নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তাদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দলের যুগ্ম-মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তৃণমূলে যৌথবাহিনীর হামলার আশঙ্কায় প্রার্থীরা সঠিকভাবে প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না। এ ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেন্দ্রে এসব অহরহ অভিযোগ আসছে। আমরা সরকারকে বলব, তৃণমূলে জনপ্রিয়তা যাচাই করতে চাইলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিন। যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীও ইতোমধ্যে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে উপজেলায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, সরকার উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করছে। স্থানীয় প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ওপর হামলা করছে। তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করছে। তিনি অবিলম্বে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করার দাবি জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।