ও পথ মাড়িও না যে পথ তুমি চেননাকো----
১৯৭৭ সালের একুশের আগে কি কাজে যেন কলেজের পিছনে গেছি । খুব অবাক হয়ে দেখলাম কমার্শিয়াল বিভাগের জানালা দিয়ে কিছু ছেলে মেয়ে ভিতরে তাকিয়ে কি যেন দেখছে । আমিও যোগ দিলাম । বেশ কিছু সিনিয়ার ছাত্র মাটিতে বসে বড় বড় বোর্ড লিখছে । সবই বিখ্যাত বাংলা ভাষী কবিদের কবিতার ছত্র ।
বেশ অবাক হলাম । জানলাম এগুলো শহীদ মিনারের আশ পাশ দিয়ে সাজানো হবে । চমৎকার ব্যাপার । খুব ইচ্ছে জাগল ওদের মতো আমিও লিখি । কিন্তু তা সম্ভব নয় কারন যারা কাজ করছে তারা ঐ ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ।
ওদের শিক্ষকরা সরাসরি আমাদের শিক্ষক নন এবং এতো সুন্দর করে লেটারিং করার যোগ্যতা আমার নেই বা এভাবে করিনি । আমার খুব হিংসা হচ্ছিল ওদের।
একুশের দিন ভোরে দেখলাম ঐ বোর্ডগুলি শহীদ মিনারের উলটো দিকের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে । যাদের দেখেছিলাম তারা একই হলেই থাকি কিন্তু পরিচয় নেই । আস্তে ধীরে পরিচয় হল ।
জানালাম মনের আকুতি । মোস্তফা কামাল চুপচাপ শান্ত শিষ্ট ছাত্র । আমি রেজা ভাইয়ের সুবাদে তার সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম । তিনি বললেন লিখতে না জানলেও অন্যান্য অনেক কাজ আছে যা স্বেচ্ছাসেবীরা করে, তুমিও করবে।
১৯৭৮ সালে লেগে গেলাম ফেব্রুয়ারির আগেই ।
প্রায় ২০/২২ জন ছাত্র কাজ করবে । প্রথম বোর্ড গুলিকে কাঠ মিস্ত্রিরা বিট লাগিয়ে মজবুত করল । তারপর এগুলোতে সাদা রং ভরিয়ে দেওয়া হল ।
তাবৎ কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন শিল্পী হাশেম খান , ঐ বিভাগেরই শিক্ষক । সরকারী টাকায় এই আয়োজন হয়।
এবার একটা নতুন পিকাপও দিয়েছে । সেটা ভীষণ ব্যাস্ত মালামাল আনা নেওয়ায় । আমি বালতিতে করে পানি টেনে সাহায্য করছিলাম । বোর্ডগুলি সরিয়ে দেবার কাজে হাত লাগানো , রং বানিয়ে দেওয়া , তুলি ধুয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজে আমরা কজন লেগে গেলাম । তিন কি চারজন খুব ভালো লিখিয়ে লেখা শুরু করলেন ।
একটু অবসর পেলেই আমরা কয়েকজন দালানের পিছনে শিক্ষকদের এড়িয়ে ধূমপান করতাম । কদিন বাদে অবাক করে দিয়ে মগবাজারের প্যাকেট বিরিয়ানি এলো পিকাপে করে । অসম্ভব মজাদার খাবার আর প্যাকেট ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন । এক সন্ধ্যায় যাদের কাজ তেমন ছিলোনা , আদেশ হল তারা গিয়ে বিরিয়ানি নিয়ে আসবে । আমরা হইচই করে পিকাপের পেছনে চড়ে গিয়ে মগবাজারের মোড় থেকে প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে এলাম ।
এবার কাজের চাপ বেশী কারন বোর্ড বসবে মিনারের পাশে নতুন জায়গায় । ওরা যারা লিখছিলেন উবু হয়ে তারা রাত্রি জাগা শুরু করলেন । বাকী সবাই ফিরে যেতাম হল বা বাসায় ঘুমুতে । মোস্তফা কামাল ভাই এবং আরও দুজনকে সকাল ১০টায় দেখতাম এককোণে একটা চাদর গায়ে ঘুমিয়ে থাকতেন । সারা রাত কাজ করে ওরা খুবই ক্লান্ত ।
দুপুরে আবার কাজ শুরু হতো । যাদের কাজ ছিল বোর্ড রং করা তারা সকাল বেলায় শুরু করে দিতেন । আমরা হেল্পার রা আধা ক্লাস করে দুপুরের পর লেগে যেতাম কাজে । আমার সহপাঠীরা আনাগোনা শুরু করল এবং জানতে চাইল কি ভাবে ম্যানেজ করে ঢুকে গেলি রে । আমি আলগা একটা হাসি দিয়ে বললাম এই হয়ে গেল আর কি, ম্যানেজ করে নিতে হয় ।
ওরা হিংসায় জ্বলছিল । কাজ দ্রুত এগিয়ে চলল তবু এবারের চাপ বেশী । যারা ভালো লিখতেন তাদের উপর নির্দেশ এলো কাজে লাগবার । ৯/১০জন সিনিয়র ভাই লেগে গেলেন এবং গোটা বিষয়টি জমজমাট হয়ে উঠলো ।
এখানের কিছু লিখিয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় তো তারা হলে বসে সারা বছর পোস্টার লিখে ব্যয় নির্বাহ করেন ।
এখনকার মতো সময় এতো সহায়ক ছিলোনা । কাজ বলতে কিছু বইএর প্রচ্ছদ, পোস্টার, স্ক্রিন প্রিন্ট , প্লাস্টার মডেল এসব করেই কিছু ছাত্রকে সংগ্রাম করতে হতো । এদের মাসের দুবেলা হোস্টেলের খাবার বিল ১২০ টাকা জোগাড় হলেই তারা খুশী । কলেজের উলটো দিকে মোল্লার ডেরায় চা , পুরির পাশাপাশি ভাত রান্না হতো । মোল্লা ভাই দয়ালু ছিলেন ।
যারা ছবি আকে তাদের প্রতি মোল্লার ভালবাসা ছিল । এদের কিছু ছাত্রকে মোল্লা বাকিতে খাওয়াতেন । এরাও কোন কাজ থেকে পয়সা পেলেই আগে মোল্লার বাকী শোধ করত ।
২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আমরা চলে গেলাম শহীদ মিনারে । চারিদিকে লেখা বোর্ড আর নকশা বোর্ড লেগে গেছে ।
ওইসময় শহীদ মিনারের রাস্তা এমারজেন্সি গেট আর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভারসিটির মোড় বরাবর সোজা ছিল । মুল বেদি ছোট ছিল । বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাডেট রা এসে রাস্তার দুমুখ বন্ধ করে দিলো । রিকশা গাড়ি ভূগোল বিভাগের রাস্তা দিয়ে জগন্নাথের পূবের রাস্তা হয়ে যাতায়াত করছিলো । শিক্ষক শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী একটা ডিজাইনএর নির্দেশ ধরিয়ে দিলেন ছাত্রদের হাতে ।
আমরা নির্দেশমতো রশি ধরে গোল দাগ কাটলাম চক দিয়ে । মাঝের নকশা স্যাররা দেখিয়ে দিলেন একে । বাকী কাজ উচু ক্লাসের ছাত্ররাই করল । এরপর নকশাগুলো রং ভরানো শুরু হল । আমরা রং এগিয়ে দেবার কাজ পেলাম ।
একদম শেষে কিছু বড় জায়গায় রং ভরানোর কাজ নিলাম অনেক অনুরোধ করে যাতে রং ছড়িয়ে নষ্ট না হয় । অভিজ্ঞ ছাড়া কাউকেই নিখুঁত কাজে নিয়োগ করা হয়নি । তারপরও অল্প জায়গায় রং ভরিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিলাম একদিন নিশ্চয়ই করতে পারবো । শহীদ মিনারের পিছনে গোলাকার একটা লাল রংএর বেড়ি পড়ে আছে । ওটাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হল ।
খুব ওজন এবং মোটা পাইপের তৈরি , ওপর দিয়ে লাল কাপড় মোড়ানো । ৫০/৬০ জন শ্রমিক ও ছাত্র মিলে অনেক চেষ্টার পর ওটাকে মুল মিনার অর্থাৎ মাঝের মিনারের পিছনে স্থাপন করা হল । কজন সিনিয়র আর্টিস্ট যারা আমাদের শিক্ষক নন তারা ওটাকে মাঝ মিনার বরাবর বসানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন দূর থেকে ।
হ্যা , যা বসান হল তা লাল সূর্য , আগে বুঝিনি । ওটাই প্রথমবার, শহীদমিনারের ব্যাক গ্রাউনডে একটি লাল সূর্য স্থাপন হল ।
অনেকের সাথে আমিও ঐ সূর্য বসিয়েছিলাম ভাবতেই বুকটা গর্বে ভরে যায় ।
আমরা ফিরে এলাম । সবাই চলে গেল হলে, বাড়িতে । আমি ও কজন মিলে কলেজে । দীর্ঘ আড্ডা , মোল্লার দোকানে চা খাওয়া ইত্যাদি ।
রয়ে গেল কাজলদা আর আমি । রাত ১১ টায় হেটে টি এস সির দিকে রওয়ানা হলাম। আমাদের সামনেই অদুরে আরও কিছু লোক পাঞ্জাবি পায়জামা পরে হেটে যাচ্ছিলেন । কাজলদা বললেন তাড়াতাড়ি হেটে ওনাদের পিছু নিতে হবে না হলে অনেক দূর ঘুরে আসতে হবে। কি জ্বালা ! কিন্তু ওরা কারা? ওদের মধ্যে বিচারপতি কামালউদ্দিন আছেন ।
তাই করলাম যা কাজলদা বলেছিল । চারিদিকে ফাঁকা, হাহাকার । পুলিশ বিচারপতি কামালউদ্দিন কে আটকে দিলো । বলল এখান দিয়ে যাওয়া যাবেনা , গোরস্থান ঘুরে আসতে হবে । কামালউদ্দিন মানুষের অধিকার ও জরুরী যাতায়াত বিষয়ে উচ্চকণ্ঠে তর্ক করলেন ।
এবার বললেন আমি বিচারপতি কামালউদ্দিন , এখান দিয়ে যাবো , পারলে ঠেকান । পুলিশের বোধোদয় হল । একজন সার্জেন্ট ওয়াকি টকি তে উপরে আলাপ করলেন এবং ছেড়ে দিলেন , ক্ষমা ও চাইলেন । পুলিশ ওনাকে এগিয়ে দিতে চাইল কিন্তু বিচারপতি বললেন চাইলেত আমার গাড়ি ও পুলিশ নিয়ে আসতে পারতাম, আসিনি , হেটেই এলাম বাসা থেকে। আমরা সার্থকভাবে বিচারপতির সঙ্গী সাথী ভাব দেখিয়ে বুক চিতিয়ে চললাম ।
ওনার পিছ ছাড়িনি যদি পুলিশ আবার ধরে আর বলে যান গোরস্থান ঘুরে আসুন ।
চারিদিকে ফ্লাড লাইটের বন্যা । সূর্য টাকে অদ্ভুত উজ্জ্বল লাগছে । হটাৎ মিলিটারি হাজির হয়ে সবাইকে সরিয়ে দিতে লাগলো হুইসেল বাজিয়ে । আমরা ভুগোল বিভাগের ফুটপাথে দাঁড়ালাম ।
চারিদিক থমথমে নিরবতা । সাইরেন বাজিয়ে বিবিধ আলো জালিয়ে এলেন জেনারেল জিয়া । ঠিক ১২.০১ মিনিটে তিনি মাল্য দান করলেন । গান বাজল এবং জিয়া চলে গেলেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি সি ও শিক্ষকরা ফুল নিয়ে এগিয়ে এলেন ।
ওরা চলে যাবার সাথে সাথে চারিদিক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তরুন, যুবকরা । ক্যাডেটরা যে নিরাপত্তা বেষ্টনী করেছিল তা উধাও হয়ে গেল । মালা, ব্যানার আর জিয়া, মুজিব ,ভাসানির ছবি নিয়ে তরতর করে ছেলেরা বেয়ে উঠলো মিনারের শিক ধরে উপরে । বান্দর থেকে যে এরা বিবর্তিত হয়েছে তাতে আমার আর অবিশ্বাস রইল না। পুরো মিনার ঢাকা পড়ল মালা, ব্যানার আর ছবিতে ।
মাইকে বেজে চলছে সেই বিখ্যাত গান ---- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ---। কাজলদা বলল চলো আমরা যাই । হ্যা খুব ক্লান্ত আমি , ঘুম পাচ্ছে । কাল সকালে হলের মিছিলে আসতে হবে মালা দিতে । কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমার প্রথম অভিযাত্রা এভাবেই শেষ হল ।
বাকী রাত হলের সামনে দিয়ে বিরতিহীন ভাবে মানুষের চলাচল কারন আমাদের হল ঠিক আজিমপুর গোরস্থানের উলটো দিকে যেখানে পুলিশ বিচারপতি ও আমাদের জোর করে পাঠাতে চাইছিল । ওদের কণ্ঠে ছিল ভাষা শহীদদের গান আর গোরস্থানের ভিতরে বিশাল শোভাযাত্রা । ওদের পদচারনায় আর কণ্ঠে ছিলোনা কোনো ক্লান্তি , ওরা সদা সজীব সেই ভোর ৫টায়ও।
মায়ের ভাষার প্রতি কি ভালবাসা বাঙ্গালীর ।
বিখ্যাত সেই উক্তি “যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী , সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি”।
।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।