আজকাল দেশ নাকি ডিজিটাল হচ্ছে। সেই হাওয়া লেগেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও। নতুন প্রজন্মের একজন মানুষ হিসাবে আমরা এইসব ডিজিটাল জিনিস বেশ পছন্দ ই করি। অনেক ক্ষেত্রে অনেক সু্বিধা এনে দিয়েছে এইসব আধুনিক ব্যবস্থা। এই ক্ষেত্রে মোবাইলে বা অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষার ফরম পুরন এবং রেজাল্ট দেখার বেপারটার কথা বলতেই হয়।
কিন্ত এই গেল মুদ্রার এক পিঠ মুদ্রার অন্য পিঠ অর্থাত ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার ভোগান্তি নিয়েই আমার এই লেখা। একজন শিক্ষার্থী হওয়ার ফলে এই ভোগান্তিটা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি।
আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ক্লাসরুমে একটা জিনিস প্রায় ই দেখা যায় যে হোয়াইট বোর্ডে,পর্দায় বা দেয়ালে ল্যা্পটপ এবং প্রজেক্টরের সাহায্যে প্রজেকশন করে পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডের মাধ্যমে ক্লাস নেয়া। সুবিধাঃস্যারদের বোর্ডে লেখার কষ্ট বেচে যায়,মাউসের একটা ক্লিক এর মাধ্যমেই স্লাইড পরিবর্তন করা যায়,অনেক সময় বাঁচে,ইচ্ছা মত রঙ বা ডিজাইন করা যায়,ছবি এবং ভিডিও দেখা যায়,এক ক্লাসে তুলনামুলকভাবে বেশি পড়ানো যায় ইত্যাদি।
আমার মনে হয় এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের যত সুবিধা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা হয়েছে শিক্ষকদের।
একইসাথে যেটা তাদের জন্য সুবিধা ঐটাই আমাদের জন্য অসুবিধা। এক কথায় এই ব্যবস্থা ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের জন্য ফাঁকিবাজির মহা সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা সবাই জানি সব শিক্ষকই ক্লাসে ঠিকমত সময় দেন বা ঠিক মত পড়ান এমনটা সত্যি নয়। এই পদ্ধতির বহুবিধ বিচিত্র ব্যবহার তাদের জন্য খুবি আরামদায়ক হয়েছে।
আমার যেদিন প্রথম ডিজিটাল ক্লাস হলো সেদিন প্রজেক্টর সেট করা দেখে খুশিতে ৩২দাঁত বের করে খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।
স্যার ক্লাস নেয়া শুরু করলেন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি কি ঝকঝকে স্ক্রিন,বড়বড় রঙ্গিন বর্নমালা,কি সুন্দর ডিজাইন !!এর মাঝে এক সময় ক্লাস শেষ হয়ে গেল। পরে দেখি স্যারের কথা কিছুই শুনিনি হা করে শুধু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলাম,সমস্ত মনোযোগ ছিল সেদিকে কিন্ত ভালকরে কিছু পড়িনি তাই কিছু মনেও করতে পারছিনা। প্রথমে আগ্রহ থাকলেও পরে বুঝতে পারলাম এই পদ্ধতি ভাল না। কারন এটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়না।
তার চেয়ে ব্লাকবোর্ড ই ভাল। কারন স্যার যখন সাধারন ভাবে পড়ান তখন মাঝে মাঝে বোর্ডে লেখেন,ছবি আঁকেন এবং লেকচার দেন। আমরা দেখা, শোনা,বোঝার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাই এবং সেটা খাতায় নোট করতে পারি। কিন্ত এই পদ্ধতিতে স্যার কে কিছু লিখতে হয়না ,তিনি দ্রুত বলে যেতে থাকেন আমরা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। না পারি ঠিক মত স্যারের কথা শুনতে না পারি পড়তে আবার না পারি স্ক্রিন থেকে কিছু খাতায় তুলতে।
সেটা করতে গেলে লেখা শেষ হওয়ার আগেই স্লাইড চেঞ্জ হয়ে যায়।
এটার বহু্বিধ ব্যবহার আছেঃ১-অপব্যবহার,২-কিছুটা সঠিক ব্যবহার ,৩-পুরোপুরি সঠিক ব্যবহার। এদেশে সঠিক ব্যবহার হয় কিনা সন্ধেয় আছে। অপব্যবহার আছে অনেক রকম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অপব্যবহারই বেশি হয়।
আমার দেখা কিছু ধরন বলি। কেউ কেউ ক্লাসে এসে বোর্ড ব্যবহার করেন না। তারা স্লাইড থেকেই পড়ান এবং এত দ্রুত স্লাইড বদলান যে আমরা সেটা ভালো করে দেখতেও পারিনা এমন কি একদুইটা মূল শব্দ লিখে রাখতেও পারিনা। তার লক্ষ্য থাকে এক ক্লাসে কত বেশি স্লাইড দেখানো যায় । এর ফলে যেখানে ৩০বা ৪০টা ক্লাস লাগে সেই কোর্স মাত্র ১৫বা ১৬টা ক্লাস নিয়েই শেষ করা যায়।
আমাদের কি অবস্থা হচ্ছে আমরা এটা নিতে পারছি কিনা তা তারা দেখবেন না। তাছাড়া তারা অনেক রকম সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকেন আমাদের মত গাধা গরুদের পেছনে নষ্ট করার মত সময় তাদের কোথায়?আমরা যেহেতু কিছু ভালমত তুলতে পারছিনা এবং তাদের যেহেতু এত তাড়া তো ক্লাস শেষ করে স্লাইডটা আমাদের দিয়ে দিলেই হয় আমরা সেটা দেখে পড়ে নিতে পারি। তারা সেটা দিবেন না। আমাদের বলবেন নিজেরা পড়ে নাও বা ইন্টারনেট থেকে দেখে নাও। নিজেরা যে পরবো, পড়বোটা কোথা থেকে?আপনারা যেখান থেকে পরাবেন প্রশ্নতো সেখান থেকেই করবেন,বুক রেফারেন্স না দিলে কোথায় খুজে বেড়াবো।
আর ইন্টার নেটের কোথা থেকে আপনি পড়ালেন আমরা কিভাবে জানবো?আমরাতো লেকচারের কিছুই খাতায় তুলতে পারিনি। একটা ৪৫মিনিটের ক্লাসে যদি গুনে গুনে ১২৫টা স্লাই্ড দেখানো হয় তাহলে কার মাথায় কি ঢুকে?পাঠক আমি করেছি এমন ক্লাস এবং কিছু বুঝিনি কিছুক্ষন পর আর মনোযোগ থাকেনা। মনোযোগ থাকলেও লাভ নেই কারন আমরাতো সুপার কম্পিউটারের বাচ্চা নই আমরা মানুষের বাচ্চা। মানুষের মস্তিষ্কের একটা ধারন ক্ষমতা আছে,সময়ের সাথেও তার একটা সম্পর্ক আছে।
আবার কিছু শিক্ষক স্লাইড শো করে দিয়ে লেকচার দেয়া শুরু করেন তারাও স্লাইড দেবেন না ,বলে দেন যে তোমরা তুলে নাও।
ইনি হয়তো তুলে নেয়ার জন্য কিছু সময় দেন কিন্ত সেই সাথে তার লেকচারটাও দেন। আমাদের পূর্ন মনোযোগ থাকে ওটা খাতায় তোলার দিকে তাই তার কথা কিছুই শুনতে পারিনা। তিনি সেটা দিয়ে দিলে বা একটু পরে লেকচার দিলে কিন্ত এই সমস্যা হয়না। আবার কেউ কেউ কোন সাজানো প্রেজেন্টেশন ই আনেন না। এলোমেলো কিছু তথ্য কপি পেস্ট করে ঘন্টার পর ঘন্টা লেকচার দিয়ে যান।
তাদের লেখার কষ্ট নেই তাই বুঝতে পারেন না কিন্ত আমাদের তো শোনার এবং বোঝার কষ্ট আছে। কিছুক্ষন পর মাথার ভেতর বিস্ফোরন শুরু হয়।
আমার কথা হচ্ছে এই যে বিশ্ববিদ্যালয় এইসব আয়োজন এই ক্লাস সবকিছুই তো আমদের শিক্ষা দেয়ার জন্য তৈরী। একজন শিক্ষকের কথা থেকে আমরা যদি কিছু নাই বুঝলাম নাই শিখলাম তবে কি লাভ তার লেকচার দিয়ে????যেই লেকচারের স্লাইডটা আমাদের জন্য তৈরী সেটা আমাদের দিয়ে দিলে কি হয়?এটাতো কোনো নোট না আর উনারা আমাদের সহপাঠি না যে অন্য কেউ পেয়ে গেলে বেশি ভাল রেজাল্ট করে ফেলবে এই জাতিয় জিনিস কাজ করবে। আবার এক ই সাথে লিখতে বলে কথা বলা শুরু করলে যে তাদের কথা কেও শোনে না সেটা তারা দেখতেই পান তাহলে তাদের লেকচার যে জলে যাচ্ছে সেটা বুঝেও এমন ছেলেমানুষি কান্ড করার দরকার কি? আর প্রজেক্টর থাকলেই যে বোর্ডে কিছু লেখা যাবেনা এমন কোনো আইনতো নেই।
একজন শিক্ষক যখন একটা চিত্র আকেন তখন তা দেখতে দেখতে আমরা বিষয়টা আরো ভালকরে বুঝতে পারি । তাই সবকিছু যতই আধুনিক হোকনা কেন কিছু কিছু সনাতন পদ্ধতির আবেদন থাকবে চিরকাল।
এবার আসি সঠিক ব্যবহারের কথায়। আমাদের একজন স্যার তার লেকচার সিট দিয়ে দেন,তারপর প্রজেক্টরে ক্লাস নেন। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ক্লাস নেন ধৈর্য ধরে বোঝান তার ক্লাসে আমরা পূর্ন মনোযোগ দিতে পারি আমাদের মাঝে কোনও টেনশন কাজ করে না আবার স্লাইড চেঞ্জ হওআর আগে লিখে ফেলার ম্যারাথন রেস এ লেগে থাকতে হয় না।
আবার একজন স্যার যখন ক্লাসে পৃথিবীর উতপত্তির উপর একটা ভিডিও দেখলেন এবং মাঝে মাঝে ভিডিও থামায়ে বুঝায়ে দিলেন তখন বুঝলাম আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষালাভটাকে কত পরিপূর্ন আর মজার করে তুলতে পারে।
স্যারদের এই বিষয়টা বুঝা উচিত যে প্রজেক্টরটা আমাদের কাছে মুখ্য না সেটা আমাদের শিক্ষক না। আমাদের কাছে তিনি মুখ্য তার কাছে আমরা কিছু শিখতে চাই। আর বাকি সব কিছুই শিক্ষাদানের এক একটা উপকরন যেগুলো দিয়ে শিক্ষাটা আরো পরিপুর্ন করা যায়। কম্পিউটারের উপর সব দায়ভার ছেড়ে দিলে সেটা যেমন তার অপমান তেমনিই আমাদের মহাদুর্ভোগের কারন।
আমি যদি শিক্ষক হতাম তবে বোর্ড এবং প্রজেক্টর সবকিছুই ব্যবহার করতাম। ছাত্রদের আগেই লেকচার সিট দিয়ে দিতাম। কোর্স রিলেটেড ভিডিও এবং ছবি দেখাতাম। আমি যেটুকু জানি তা জানাতাম। চেষ্টা করতাম যাতে তারা কিছু শেখে বা শিখতে আগ্রহী হয়।
একটা প্রযুক্তি চালু করলেই হয়না সেটার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়। শুনলাম প্রাইমারী লেভেলেও এই ডিজিটাল ব্যপার চালু হচ্ছে। সত্যি বলতে আশাবাদী হতে পারছিনা,কারন বুঝতে পারি অপব্যবহারটাই বেশি হবে যার ফলে বাচ্চারা এতদিন যাও বা কিছু শিখত তাও ভাল করে শিখতে পারবেনা। আমার মনে হয় আমাদের এবিষয়ে সচেতন হওয়ার দরকার। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।