আহমাদ ইউসুফ
মিছিলটা শুরু হলো টিএসসি থেকে। গন্তব্য টিএসসি থেকে কলাভবন হয়ে ফুলার রোড হয়ে নবনির্মিত শহীদ মিনার। তপু আর দীপা মিছিলের মাঝ বরাবর। তপুর হাতে বিশাল এক প্লাকার্ড। তাতে লেখা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
দীপার হাতেও শোভা পাচ্ছে অ, আ, ক, খ লেখা প্লাকার্ড। মুখে শ্লোগান, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সবার মনেই দৃঢ় প্রত্যয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। তবে ব্যতিক্রম একজন আর সে হলো তূর্য্য।
দীপার জন্যই মূলত ওর মিছিলে যোগদান। তূর্য্য দীপাকে ভালবাসে। তাই দীপাকে চোখে চোখে রাখার জন্যই ওকে ছায়ার মতো অনুসরন করে ও। কিন্তু মেয়েটা ওকে মোটেও পাত্তা দেয়না। সারান ঝাড়ির উপরে রাখে।
সহপাঠী হিসাবে যতটুকু সম্পর্ক থাকার কথা ততটুকুই রাখতে চায় দীপা। কিন্তু তূর্য্য এতে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তূর্য্যর সেই এক কথা। আমাকে ভালবাসতে তোমার বাধা কোথায়? আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন মানুষ। দেখ আমার রক্তও তোমার মতো লাল।
আমি পাকিস্তানী বলে আমাকে ঘৃনা করনা। দেখ আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি দীপা। কিন্তু দীপা ওকে সাফ সাফ বলে দিয়েছে ওকে কিছুতেই ভালবাসতে পারবে না। ও যেন ভবিষ্যতে কোন সিনক্রিয়েট না করে। কিন্তু ছেলেটা যে কিনা! পাগল কোথাকার।
আড়চোখে তাকায় দীপা। নিশ্চিত হয় অবশেষে। আছে। পাগলটা আছে। তপু আর দীপার দুই হাত পিছনেই ঠোট মিলাচ্ছে তূর্য্য।
আর আড়চোখে দীপার দিকে নজর রাখছে।
তূর্য্যর বাবা পাকিস্তান সরকারের একজন বড় আমলা। ওদের ফ্যামিলিও পাকিস্তাানি বংশোদ্ধুত। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য তো কোন পাকিস্তানীর প্রানপাত করার কথা নয়। কিন্তু তূর্য্য কেন এইসব মিছিলে? ওকি জানেনা এটা অনেক রিস্কি।
যে কোন সময় পুলিশের লাঠিচার্জ হতে পারে। গোলাগুলিও বিচিত্র কিছু নয়। কারন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্টভাষা করার ঘোষনা দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারী পাকিস্তানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার ঘোষনা দেন।
এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ তমুদ্দিন মজলিস গঠন করেছে। সারা দেশব্যাপী হরতাল, মিছিল, সমাবেশ হয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। সারা দেশব্যাপী গন-আন্দোলন থামানোর জন্য সৈরশাসক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে।
সকাল বেলা বাসা থেকে বেরুতেই বাবার সামনে পড়ে গেল দীপা।
কিরে মা কোথায় যাচ্ছিস?
কই আবার? ভার্সিটিতে যাচ্ছি বাবা।
আজ কি না গেলে হয় না মা?
তা কি করে হবে বাবা, আজ তো যেতেই হবে।
নারে আজ আর যাসনে। বাইরের পরিস্থিতি মোটেও ভালো না। রেডিওর খবরে বললো আজ নাকি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে ।
১৪৪ ধারা করছে তো কি হয়েছে? এত ভয় পেলে চলে বাবা? দীপার যুক্তি।
তারপরও তুই মেয়েমানুষ। এত গন্ডগোলের ভিতরে বাইরে যাবি? ভরসা পাচ্ছি না মা!
বাবা! তুমি শুধু শুধু টেনশন কর। আমার মতো কত মেয়েই তো যাচ্ছে। দেখ বাবা বিষয়টা খুবই সেনসিটিভ।
আমাদের আতœার সাথে জড়িয়ে আছে। এটা কি করে সম্ভব বাবা? ওরা! ওরা! আমাদের নিঃশ্বাস কেড়ে নিতে চায়। আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তবুও তুমি বলছ আমাকে চুপ করে থাকতে। না বাবা এটা হয়না।
আমি জানি রে মা। কিন্তু আমি যে পিতা, আমি তোকে এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছেড়ে দিতে পারিনা।
ওহ! বাবা তুমি কিচ্ছু ভেবনা। আমার সাথে তপু থাকবে।
তপু কোনটা রে।
প্রশ্ন আনিস সাহেবের।
কেন চিনতে পারছ না? তোমার সাথে না পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওই যে মাথায় ঝাকড়া চুল, খোচা খোচা দাড়ি, খদ্দরের পাঞ্জাবী পড়ে, সবসময় কাধে একটা চটের ব্যাগ ঝোলানো থাকে। আর কবিতা টবিতা লেখে।
ও হ্যা হ্যা ! এবার চিনতে পারছি।
ওই লাজুক ছেলেটা। বেশ ভদ্র একটা ছেলে। মনে মনে আশ্বস্থ হন আনিস সাহেব।
আচ্ছা ঠিক আছে যা, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস মা।
মিছিলটা ধীর গতিতে এগুচ্ছে ফুলার রোড হয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে দিয়ে।
রাস্তার দুপাশেই সশস্র দাঙ্গা পুলিশ দাড়িয়ে আছে। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ। ছাত্র-শিক, বুদ্ধিজীবী, যুবা কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার একটাই দাবী রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে খন্ড খন্ড মিছিলগুলো শেষ পর্যন্ত এক বিশাল জন সমুদ্রে পরিনত হল।
এত দীর্ঘ মিছিল দেখে শাসক গোষ্ঠী হকচকিয়ে গেল। তাদের শাসনের ভিত নড়ে উঠল। তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাঙ্গালীর প্রানের দাবীকে সমূলে বিনাশ করার জন্য দমন নিপীড়নের পথ বেছে নিল। শাসকগোষ্ঠী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল, যে ভাবেই হোক গনজাগরন ঠেকাতে হবে। প্রয়োজনে রক্তের বন্যা বইবে।
লাশের স্তুপ হবে। তবু মিছিল ছত্রভঙ্গ হবে। এমন নির্দেশে ঠিক দুপুর ২:১৫ মিনিটে শুরু হল গোলাগুলি। তিরিশ মিনিটের ব্যবধানে রক্তের বন্যা বয়ে গেল। একের পর এক লাশ পড়তে লাগল।
হঠাৎ অতর্কিত আক্রমনে একে একে ঢলে পড়লেন রফিক, শফিক, জব্বার, শফিউর সহ আরো নাম না জানা অনেক তাজা প্রান। আহতদের আর্তচিৎকারে কেপে উঠল পুরো দুনিয়া।
দীপার চোখের সামনেই একের পর এক লাশ হতে লাগল তারই সহপাঠী বন্ধুরা। দীপা কি করবে ভেবে পেল না। কেমন হতবিহবল হয়ে গেল।
একটু সম্বিত ফিরতেই তপুকে খুজল দীপা। না। নেই তপু তো নেই। তপু তো দীপার হাত ধরেই ছিল। তপু গুলি খায়নি তো? তপুর অমঙ্গল আশঙ্কায় হৃদপিন্ড কেপে উঠল দীপার।
ইতোমধ্যে পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে। লাশগুলো সব তোলা হচ্ছে গাড়িতে। লাশের স্তুপের ভিতরে ীন কন্ঠের ‘দীপা’ ডাক শুনতে পেল। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল ওর। ওহ! তাহলে তপু ওখানে? দৌড়ে কাছে গেল দীপা।
রক্তাক্ত তূর্য্যকে দেখে হতভম্ব হল ও। পাজরে গুলি লেগেছে তূর্য্যর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। দীপা কি করবে ভেবে পেলনা। তূর্য্য এভাবে ভালোবাসার প্রমান দিয়ে গেল।
দীপার জন্যই তূর্য্যরে আজ এ পরিনতি। তূর্য্য তো শুধু দীপার ভালবাসার জন্যই উম্নুখ ছিল। হায় দীপা একি দেখল শেষ পর্যন্ত।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তূর্য্য। ীন অস্ফুট কন্ঠে বলল তূর্য্য, দীপা আমাকে মা কর।
আমি আর তোমার পিছু নেব না। তোমার পথের কাটা হয়ে দাড়াব না। আমাকে একটু ধর বলে হাত বাড়িয়ে দেয় তূর্য্য। রক্তাক্ত হাতটা ধরে দীপা। পুলিশের দুজন কনস্টেবল তূর্য্যকে তুলতে এল।
আর একটা কথা, দীপা আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কর। দেখ আমার রক্তও লাল। এই রক্তের কসম। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
দেখ মরার সময় কেউ মিথ্যা বলে না। আমাকে একটু ভালোবাসতে পারলে না দীপা? আমার কি অপরাধ ছিল? জড়ানো আহত কন্ঠ তূর্য্যর।
তূর্য্যকে নিয়ে গাড়িটা ঢাকা মেডিকেলের দিকে চলে গেল। তোমার কি অপরাধ তা আমি জানিনা তূর্য্য। হয়তো তুমি আমাকে একটু বেশীই ভালোবেসেছিলে।
অস্ফুট কন্ঠে বলল দীপা।
প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় পৌছল তপু। যাক বড় বাঁচা গেল। এ যাত্রা কোনমতে রা। জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পারার আনন্দে আতœহারা ও।
এতন দীপার কথা মনেও ছিল না ওর। রেডিও সেটের সামনে বসল তপু। রেডিওতে বিশেষ বুলেটিন হিসাবে মিছিলে গোলাগুলির খবর প্রচারিত হল। সবমিলিয়ে ৬ জন নিহত আর প্রায় ৫০ জনের মতো আহত হল। নিহতের মধ্যে একজন মেয়ে।
বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল তপুর। নিহত মেয়েটা কে? দীপা নয়তো। দীপার অমঙ্গল আশঙ্কায় অন্তরাতœা কেপে উঠল ওর। দীপা কেমন আছে, দীপা সুস্থ্য আছে তো? এ চিন্তাটা মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু। কিন্তু বাইরের অবস্থা তো উত্তপ্ত।
মিছিলে গোলাগুলির পর রাস্তায় বেরুনো তো খুবই রিস্কি হয়ে যাবে ভেবে বাইরে বেরুনো থেকে নিজেকে নিরস্ত করল তপু। কাল না হয় একবার দীপার বাসায় গিয়ে ওর খোজ করে আসবে ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিল ও। রেডিও তে সন্ধ্যার বুলেটিনে নিহত ৬ জনের নাম, ঠিকানা প্রকাশ হল। যাক হাফ ছেড়ে বাঁচল তপু। দীপা তাহলে ওদের মধ্যে নেই।
দীপা তাহলে সুস্থ্যই আছে। যদি আহত হয়ে গিয়ে থাকে? নিজেকে খুব ছোট মনে হল তপুর। হায় সেতো একটা কাপুরুষ। তপু তো দীপার হাত ধরেই ছিল। লাঠিচার্জ হতে না হতেই তপু আর দীপাকে খুজেই পেলনা।
আর দীপাই বা কোথায় গেল? তপু একটা ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টা করল। দীপা নিশ্চয়ই নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিরাপদ জায়গায় সরে গিয়েছে। তপু তো দীপাকে খুজেছে। আর খুজে না পেলে ও কি করতে পারে। তারপরও বিষয়টা কেমন খটকা হয়েই থাকল।
অপরাধবোধে ভুগতে লাগল তপু।
ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলেও তূর্য্যকে বাঁচানো যায়নি। দীপার চোখের সামনেই তূর্য্য মারা গেল। দীপার হাতটা তখনও ধরে ছিল তূর্য্য। হঠাৎ করে সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
তূর্য্য চলে গেল। চোখ ফেটে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল দীপার। হায়রে ভালোবাসা। এভাবেই যুগে যুগে ভালবাসার জন্য কত প্রেমিক নিজেকে উৎসর্গ করে। তূর্য্যও অবশেষে তাই করল।
অপরাধবোধে ভুগতে লাগল দীপা। দীপার জন্যই তো তূর্য্যরে আজ এমন পরিনতি। এর জন্য দীপাই দায়ী। ভালোবাসার জন্য তূর্য্য জীবন দিয়েছে। কিন্তু দীপা এমন ভালবাসার কি প্রতিদান দিতে পারে? দীপা কি এতটাই স্বার্থপর হবে।
দীপার অবচেতন মন বলে উঠল। নাহ! দীপা এতটা স্বার্থপর হতে পারবে না। তূর্য্যর ভালোবাসার প্রতিদান হিসাবে তার কিছু একটা করা উচিত। তূর্য্যর ভালোবাসার ঋণ এতটা ভারী যে তা বহন করা দীপার জন্য খুব সহজ হল না। তবুও দীপা সারাজীবন একা থাকারই সিদ্ধান্ত নিল অবশেষে।
কারন ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গের তুলনায় এটা খুব বেশী কিছু নয়। আর তপুর ভালোবাসার স্বরুপও তার এখন অজানা নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।