আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামায়াতের চক্রান্তেই জঙ্গিবাদের বিস্তার, নিষিদ্ধ নয় কেন



ধর্মের নামে রাজনৈতিক অপতৎপরতার কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। এ দেশকে জঙ্গিবাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত জামায়াতে ইসলামী। তাই জঙ্গি নির্মূল করতে হলে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ধর্মীয় রাজনীতির নামে অপতৎপরতা রোধ করতে হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলের লহরী হলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদের হুমকি : বাংলাদেশ ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে দেশের সুধীজনরা এ মতামত দিয়েছেন।
সেমিনারে বক্তারা জঙ্গিবাদের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন।

তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘আপসকামিতাও’ দায়ী। আল-কায়েদাপ্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির সাম্প্রতিক অডিওবার্তায় বাংলাদেশের প্রতি হুমকিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবিষয়ক এ আলোচনায় বক্তারা আরো বলেছেন, দেশে ধর্মকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করছে তারা ক্ষমতার স্বার্থে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়, এ দলটি স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সেমিনারে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অংশ নেন। প্রাণবন্ত মত প্রকাশের এ অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি অনেকে ভিডিও কনফারেন্স ও স্কাইপের মাধ্যমেও যোগ দেন।


সেমিনারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, জঙ্গিবাদ এখন হুমকি নয়, এটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতা যদি আমরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি তা হলে অনেক মূল্য দিতে হবে। সরকারি দল ও যাঁরা প্রগতিশীল রাজনীতি করেন, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। নেতাদের জনগণের কাছে যাওয়া উচিত। জনগণের কাছে যেতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, যার প্রমাণ প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচন।

তিনি আরো বলেন, সরকারে থাকা ১৪ দলের নেতারা যদি মন্ত্রিত্ব আর সুবিধার রাজনীতি করেন, তা হলে আমরা জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি পাব না। জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করাই এখন দেশের প্রধান কাজ। যাঁরা বলছেন আরেকটি নির্বাচন করাই এখন সরকারের প্রধান কাজ তাঁদের বলব, জাতিকে ভুল পথে নিয়ে যাবেন না। আরো একটি সতর্কবাণী- জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করতে হবে প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না।
সেমিনারে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা এ কে মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের জনক জামায়াতে ইসলামী।

তাদের অর্থের উৎস খুঁজতে হবে। স্বাধীনতার পর জামায়াত মধ্যপ্রাচ্য থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে। ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করে এখন ইউরোপ থেকে অনুদান নিচ্ছে তারা। যুক্তরাজ্যে টিভিতে প্রচারণা চালাচ্ছে জামায়াত।
বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ধর্মের রাজনীতি ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আধুনিক বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

বর্তমান সময়ে বিশ্ব যে দানবের মুখে দাঁড়িয়ে তা হচ্ছে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাদ জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আর তাই বিশ্বে জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় গ্লোবাল টাস্কফোর্স গঠন এবং সরকারের প্রগতিশীল দল ও সংগঠনগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান সরকারের সাংগঠনিক দুর্বলতা দেশে জঙ্গিবাদ ছড়াচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জঙ্গিবাদের অবস্থান রয়েছে।

জঙ্গিবাদের একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেই নেটওয়ার্ক যদি আমরা না বুঝি তবে জঙ্গিবাদ দমন অসম্ভব। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী থাকলে দেশে ‘জঙ্গিবাদের চাষ’ হবে। তাই এই দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বারবার বলা হয় জামায়াত জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

যদি তারাই এটা করে থাকে তবে কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না। জঙ্গি সংগঠন হিসেবে হিজবুত তাহরীর ও জেএমবিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে কেন সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারছে না?
মানবাধিকার নেতা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, জঙ্গিবাদ একটি ‘আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলা’। জাতীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আপসকামী রাজনীতির কারণে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো আজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যাঁরা দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তাঁদের ওপর ওরা সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে।


সেমিনারে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আমীর-উল ইসলাম বলেন, জঙ্গিবাদকে কেবল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে ভুল হবে। তাদের উত্থানকে দেখতে হবে সমগ্র বিশ্বের আলোকে। বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা নেই। জঙ্গিবাদ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রতিটি মসজিদের ইমাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ ধর্মীয় নেতাদের একত্রে কাজ করতে হবে।


দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেছেন, বারবার জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতের নাম এলেও কেন তাদের নিষিদ্ধ করছে না সরকার? জামায়াত রাজনৈতিক তৎপরতার আড়ালে জঙ্গিবাদের বিস্তারে সক্রিয় আছে। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে গ্রামে জামায়াতের মহিলা কর্মীদের দিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, রাজনৈতিক বিভাজন থাকলে জঙ্গিবাদ সমস্যার সুরাহা হবে না। জঙ্গিবাদ কোনো দলের সমস্যা নয়, এটি এখন দেশের জাতীয় সমস্যা। মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্ররা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এটি একটি ভুল ধারণা।

কেননা দেশের মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সরোয়ার আলী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ভাবাদর্শের সংগ্রাম। এ অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে এখন তৃণমূল মানুষের কাছে ইসলামের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
সেমিনারে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, ইসলামী সংগঠনের নামে মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে। জিহাদের কথা বলে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

এদের বিরুদ্ধে এখনই সবাইকে সচেতন হতে হবে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক এলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী। কাওমি মাদ্রাসা, সাধারণ মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা যেন তিন দেশের তিনটি শিক্ষা পদ্ধতি। এখানে মনিটরিং নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের ছায়ায় রেখে দেওয়ার কারণেই জামায়াতে ইসলামী ও জঙ্গির উত্থান।

তারা (বিএনপি-জামায়াত) অনেক হিসেবী হয়ে এগিয়েছে, নির্বাচনের ফল তা প্রমাণ করে। জামায়াতের আর্থিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে সরকারকে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার আমলা ও গোয়েন্দানির্ভর হলে কাজটা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, এখন মনে হচ্ছে ধর্ম ও জঙ্গিবাদ সমান্তরাল হয়ে গেছে। অথচ পৃথিবীতে কোনো ধর্ম জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না।

তাহলে কিভাবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে ধর্ম আসে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
সেমিনারে সাবেক বিচারপতি আবদুর রশিদ বলেছেন, বাংলাদেশে ৪০টির মতো জঙ্গি সংগঠন ক্রিয়াশীল। জঙ্গিবাদের কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২২ হাজার ৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, বর্তমানে প্রশাসনের যে দুরবস্থা তা থেকে জঙ্গি দমন তো দূরের কথা, সুশাসন নিশ্চিতও কঠিন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীকে দক্ষ করতে হবে, বিএনপি-জামায়াতের সময় প্রশাসনে যারা তাদের অনুগত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের সরিয়ে ফেলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীদের সরকারি চাকরিতে ঢোকা বন্ধ করতে হবে।


সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। জঙ্গিবাদ একটি রোগ। আমাদের এ রোগের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। আর তা যদি না হয়, তবে বাংলাদেশ অগ্রসর হবে না। ’
শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদদীন মাসউদ বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে হবে।

আর জামায়াত যেহেতু সন্ত্রাসী দল, তাই জামায়াতের সব ধরনের প্রকাশ বন্ধ করতে হবে।
সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, বাংলাদেশে জাওয়াহিরির অসংখ্য অনুসারী জঙ্গি নেতা রয়েছেন, যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারকে মনিটরিং সেল গঠন করে মাদ্রাসাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
সেমিনারে আরো অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের বার্তা সম্পাদক গাজী নাসিরউদ্দীন, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নূরন্নবী প্রমুখ।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমির অনুষ্ঠাটি সঞ্চালনা করেন।


- See more at: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.