ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো।
রবার্ট কচ (১৮৪৩-১৯১০)
আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও যক্ষ্মাকে মরণব্যাধি বলে গণ্য করা হত। আজ যেমন এইডস রোগ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক, অর্ধশতাব্দী কাল আগে যক্ষ্মা নিয়েও এমনি ছিল আতঙ্ক। একটি সাধারণ প্রবাদ ছিল- যার হয়েছে যক্ষ্মা তার নেই রক্ষা। কিন্তু সেই ঘাতকব্যাধি যক্ষ্মা আজ পোষ মেনেছে মানুষের হাতে।
যক্ষ্মা কে আজকাল কেউ বড় রোগ বলে গণ্যই করে না। যার আবিষ্কারের ফলে এই মরণব্যাধি যক্ষ্মা আজ মানুষের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে তিনিই হলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী রবার্ট কচ। তিনিই প্রথম যক্ষ্মার জীবাণু (Mycobacterium Tuberculosis) শনাক্ত করেন এবং পরে তা ধ্বংস করার ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। বিশ্বের মানুষ মুক্তি লাভ করে যক্ষ্মার হাত থেকে।
রবার্ট কচের পুরো নাম হল হেইনরিখ হারম্যান রবার্ট কচ (Heinrich Hermann Robert Koch)।
তিনি ছিলেন জার্মানীর প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং জীবাণুতত্ত্ব বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই প্রথম যক্ষ্মার জীবাণু এবং কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করেন। এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসা শাস্ত্রে অবদানের জন্য তাকে ১৯০৫ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তার জন্ম হয়েছিল জার্মানীর ক্লাউস্থাল (Clausthal) নামক শহরে ১৮৪৩ সালের ১১ ডিসেম্বর। নিজ শহরে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি ১৮৬৬ সালে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য ভর্তি হলেন গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Gottingen)।
পাস করার পর তিনি কয়েকটি মফস্বল শহরে ডাক্তারি করেন। তিনি ছিলেন শল্য চিকিৎসক। সার্জারিতে তার ছিল প্রচন্ড দক্ষতা। ১৮৭০-৭১ সালের ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধের সময় সামরিক হাসপাতালে সার্জারিতে তিনি দারুণ নাম করেন। ফলে প্রমোশন পেয়ে জার্মানীর ওলস্টেইন (Wollstein) জেলার ডিস্ট্রিক্ট সার্জন পদে মনোনীত হন।
এই সময়ে তিনি জেলা শহর হাসপাতালে নিজের চেষ্টায় একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। থাকার মধ্যে ছিল একটি মাইক্রোস্কোপ এবং মাইক্রোটোম নামে একটি যন্ত্র যা দিয়ে সুক্ষ্ণভাবে টিস্যু কাটা যায়। এছাড়া ছিল তার নিজের হাতে তৈরি করা একটি ইনকিউবেটর। এই ল্যাবরেটরিতেই তিনি Algae এবং রোগ জীবাণু নিয়ে গবেষণা করতেন।
তখনকার সময়ে Wollstein জেলার গবাদিপশুর খামার গুলোতে মাঝে মাঝে অ্যানথ্রাক্স এর আক্রমন দেখা যেত। কিন্তু কিসের দ্বারা গবাদি পশু এই রোগে আক্রান্ত হত সেটা সবার কাছে অজানা ছিল। রবার্ট কচ এর শিক্ষক এবং গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরতত্ত্ব বিদ্যার অধ্যাপক ফ্রেডরিখ গুস্তাভ জ্যাকব হেনলে (Friedrich Gustav Jacob Henle) ১৮৪০ সালে একটি বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন- ছোঁয়াচে রোগ বিস্তার লাভ করে এক ধরনের জীবাণুর দ্বারা। এরপর ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরজীবীবিদ্যার অধ্যাপক ক্যাসিমির জোসেফ জ্যাভাইন (Casimir Joseph Davaine) ১৮৫০ সালে অ্যানথ্রাক্স এর সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ ও গবাদি পশুর রক্তে একধরনের জীবাণুর সন্ধান পেলেন। কচ তখন এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।
সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত একটি ভেড়ার রক্ত নিয়ে ইনজেকশন দিলেন একটি সুস্থ সবল ভেড়ার শরীরে। দেখা গেল কয়েকদিনের মধ্যে সেই সুস্থ ভেড়াটিও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। রোগাক্রান্ত ভেড়াটির রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল তার রক্তেও রডের (Rod) এর মত এক ধরনের অণুজীবী রয়েছে, যেগুলো সুস্থ অবস্থায় এর শরীরে ছিল না। তা হলে রক্তে এই অণুজীবীদের উপস্থিতির কারণেই ভেড়াটি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সত্যি সত্যি ভেড়াটি দিন কয়েক রোগ ভোগ শেষে মারা গেল।
অর্থাৎ তাহলে বোঝা গেল, কোনো প্রাণীর দেহে এই ধরনের অণুজীবীর অনুপ্রবেশ ঘটলেই সে রোগাক্রান্ত হয় এবং এর পরিণাম হয় মৃত্যু।
যদিও Davaine, Rayer এবং Pollender অণুজীবীটির উপস্থিতি আগে সনাক্ত করেন, তারপরও তখনো এর সম্পর্কে সার্বিক ধারণা কারো হয়নি। এসব জীবাণুর জন্ম, বংশ বিস্তার, আচার আচরণ সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। সে কাজটি প্রথম করলেন রবার্ট কচ। তিনিই প্রথম এই রডের মত আকৃতি বিশিষ্ট জীবাণুগুলোকে তুলে এনে কাঁচ পাত্রে রাখলেন এবং অনুকূল পরবেশে সেগুলোকে বাড়তে দিলেন, বংশ বিস্তার করতে দিলেন এবং লক্ষ করলেন ওদের জীবনচক্র।
দেখলেন জীবাণুগুলো কেমন বিস্ময়কর ভাবে নিজেদের দেহ খণ্ডিত করে বংশ বিস্তার করে। তিনি আরো লক্ষ করলেন এদের জীবন অত্যন্ত শক্ত। এরা শুকনো অবস্থায়ও দীর্ঘদীন, এমনকি বছরের পর বছর সুস্থ থাকতে পারে। পরে অনুকূল পরিবেশ পেলেই আবার জীবনীশক্তি ফিরে পায়। শুরু করে বংশ বিস্তার।
এই জীবাণুর বংশ বিস্তার এবং জীবন প্রণালী আগে কেউ দেখাতে পারেনি। অ্যানথ্রাক্স রোগ সৃষ্টিকারী এই জীবাণুর নাম হল Bacillus anthracis । এভাবে রবার্ট কচ রোগাক্রান্ত পশু থেকে Bacillus anthracis পৃথক করার মাধ্যমে তখনকার সময়ে রোগ সৃষ্টির জন্য প্রচলিত Spontaneous Generation Theory কে ভুল প্রমাণ করে Germ Theory(রোগ সৃষ্টির জন্যে জীবাণু দায়ী) প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে লুই পাস্তুর দেখান যে, অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণুকে তাপ প্রয়োগে দুর্বল করে ফেলা যায়। এসব দুর্বল জীবাণুকে যদি সুস্থ গরুর দেহে প্রবিষ্ট করা যায়, তবে ওই সব গরু অ্যানথ্রাক্স রোগে মারা যায় না।
তাদের দেহে এমন কিছু উৎপন্ন হয়, যা অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণুকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। যেসব গরুর দেহে তাপ প্রয়োগ করে দুর্বল করে ফেলা অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু প্রয়োগ করা হয়, পরে তাদের দেহে অ্যানথ্রাক্স রোগের সবল জীবাণু প্রয়োগ করলে অ্যানথ্রাক্স রোগ হয় না। এভাবে আবিষ্কৃত হয় অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা।
রবার্ট কচ তার এই গবেষনার ফল প্রথম প্রকাশ করেন ১৮৭৬ সালে ব্রেসলো (Breslau) এর এক বিজ্ঞান সম্মেলনে। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিলেন প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী ফার্ডিনান্ড কন (Ferdinand Cohn) এবং বিশিষ্ট প্যাথলজিস্ট জুলিয়াস কনহেইম (Julius Conheim)।
মূলত এরা দুজনে উৎসাহিত হয়ে কচের আবিষ্কারকে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই এই সম্মেলন আহবান করেছিলেন। ফার্ডিনান্ড কন তার উদ্বোধনী ভাষণে রবার্ট কচের আবিষ্কার প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ''I regard it as the greatest discovery ever made with bacteria and I believe that this is not the last time that this young Robert Koch will surprise and shame us by the brilliance of his investigations.''
এই বছরই (১৮৭৬ সাল) বিজ্ঞানী ফার্ডিনান্ড কনেরও জীবাণুরত্ত্বের উপর একটি গবেষনা তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছিল। গবেষনা পত্রটি কচের খুব কাজে এসেছিল। তিনি এই লেখাটি থেকেও গবেষনার দিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন। তারপর ফার্ডিনান্ড কনের জনৈক মেধাবী ছাত্র জোসেফ স্ক্রোয়েটারও (Joseph Schroeter) জীবাণুবিদ্যার উপর একটি নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন।
এক ধরনের রঙিন জীবাণু যারা শুধু রক্তের মত তরল পদার্থ নয়, অনেক শক্ত পদার্থের উপরও বংশ বিস্তার করতে পারে। এরা এক স্থানে কলোনি সৃষ্টি করে বাস করে, তারপর আবার সেখান থেকে ভিন্নস্থানে গিয়েও অনুরুপ কলোনি সৃষ্টি করতে পারে। এই রঙিন অনুজীবীরা গোলআলু, পচা ডিম, গম, মাংস এবং রুটির মধ্যেও বংশ বিস্তার করতে সক্ষম। এই অনুজীবীদের নতুন স্থানে বংশ বিস্তার করার ক্ষমতা- এখান থেকেই রবার্ট কচ শুরু করলেন তার জীবানুবিদ্যার উপর গবেষণা।
অতঃপর রবার্ট কচ ১৮৭৮ সাল থেকে রোগ সংক্রমণের উপর তার গবেষণা কেন্দ্রীভূত করলেন।
তিনি বিভিন্ন প্রাণীর(মানুষসহ) বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের জীবাণুর নমুনা সংগ্রহ করলেন। এভাবেই তিনি মোট ৬টি সংক্রামক ব্যাধির রোগ জীবাণু সনাক্ত করতে সক্ষম হলেন। কোন কোন জীবাণু দ্বারা কোন কোন রোগ সংক্রমিত হয় তারও তালিকা তৈরি করলেন। তিনি এসব জীবানুকে সুস্থ পশুর দেহে সংক্রমিত করে রোগ সৃষ্টি করতেও সক্ষম হলেন। এভাবেই তিনি বুঝতে পারলেন জীবাণুর বিস্তার ঘটানো বা চাষের জন্য প্রাণীদেহই অত্যন্ত উপযুক্ত যায়গা।
একজন সেরা জীবাণুতত্ত্ববিদ হিসেবে সারা দেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। এবার সরকারের দৃষ্টি পড়ল তার উপর। সরকার নিজেই তাকে ডেকে এনে বার্লিনে জার্মান হেলথ অফিসে স্থান করে দিল। সেখানে গবেষণার জন্য তাকে দেয়া হল সব রকমের আর্থিক সহযোগিতা ও অনুদান। সরকারি সহযোগিতা পেয়ে এখানেই তিনি স্থাপন করলেন একটি উন্নত মানের গবেষণাগার।
তিনি প্রাণীদেহের বাইরে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীবাণুর বংশবৃদ্ধির এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি গলিত শিরিসের (gelatin) মধ্যে জীবানুকে মিশ্রিত করলেন, তারপর শিরিস যখন শুকিয়ে শক্ত হয়ে এল তখন তিনি এর একটি অংশকে অন্য মাধ্যমে স্থানান্তরিত করলেন। দেখা গেল সেখানে গিয়েও জীবাণু সমানভাবেই বংশবৃদ্ধি করছে। কচ বিশেষকরে যক্ষ্মার জীবাণু নিয়ে গবেষনা করতে লাগলেন। তার লক্ষ্য ছিল যক্ষ্মার জীবাণু গুলোকে সনাক্ত করা এবং তাদেরকে আলাদা করে ফেলা।
তিনি জানতেন যক্ষ্মা সংক্রামক ব্যাধি এবং এক ধরনের জীবাণু দ্বারা এর রোগের সৃষ্ট হয়। তিনি আসলে যক্ষ্মার এই জীবাণু গুলোকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তখন পর্যন্ত কেউ এই যক্ষ্মার জীবাণুর সন্ধান পাননি বা তাদের আলাদাও করতে পারেননি। এবার সেই চেষ্টাই করতে লাগলেন তিনি। তিনি তার পরীক্ষা পদ্ধতিকে আবার পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করলেন।
অবশেষে তিনি সত্যি সত্যি সাক্ষাৎ পেলেন লুকানো সেই ক্ষুধে শয়তানদের। তিনি আলাদাভাবে সনাক্ত করতে পারলেন যক্ষ্মার জীবাণুকে।
তিনি যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করলেন বটে কিন্তু আরেকটি সমস্যা দেখা দিল। জীবাণুগুলোকে দিয়ে অন্য জীবাণুর মত প্রাণীদেহের বাইরে বংশ বিস্তার ঘটানো যাচ্ছে না। কিন্তু এই দুরূহ কাজটি তিনি করতে পারলেন আরও দীর্ঘ সাধনার পর।
অবশেষে ১৮৮২ সালের ২৪শে মার্চ ঘোষণা করলেন তার গবেষণার ফলাফল। তিনি বার্লিনের ফিজিয়োলজিক্যাল সোসাইটির এক সম্মেলনে ঘোষনা করলেন তার এই বিস্ময়কর আবিস্কারের কথা। দেখালেন তার আবিস্কৃত এই জীবাণুই সকল রকম যক্ষ্মার জন্য দায়ী।
রবার্ট কচ এসময় রোগ সৃষ্টি এবং এর পেছনে অণুজীবের ভূমিকার কথা ৪টি স্বীকার্য এর মাধ্যমে প্রকাশ করে। স্বীকার্যগুলো হল-
(১) রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে অবশ্যই অধিক পরিমাণে রোগটির জন্য দায়ী অণুজীব পাওয়া জাবে,কিন্তু কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে সেই অণুজীবটি পাওয়া যাবে না।
(২) রোগের জন্য দায়ী অণুজীবটি অবশ্যই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে পৃথক করা যাবে এবং ল্যাবে তার বংশবৃদ্ধি করা যাবে।
(৩) ল্যাবের এই অণুজীব থেকে কিছু অণুজীব নিয়ে কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করানো হলে অই সুস্থ ব্যক্তিটি রোগাক্রান্ত হতে পারে।
(৪) এই নতুন ভাবে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে পুনরায় অণুজীবটিকে পৃথক যাবে এবং রোগের কারণের জন্য এই নির্দিষ্ট অণুজীবটিকে দায়ী করা যাবে।
এই স্বীকার্য গুলো Koch's four postulates নামে বিখ্যাত যা আজও আধুনিক মাইক্রোবায়োলোজির অন্যতম ভিত্তি বলে গণ্য করা হয়।
এই আবিস্কারের পরপরই সহসা আরেকটি বড় কাজ এসে পড়ল তার হাতে।
মিশরে দেখা দিয়েছিল কলেরা মহামারী। মিশরের কলেরা মহামারী ইউরোপের জন্য ও ছিল ভয়ের ব্যাপার। কারণ এই সংক্রামক ব্যাধির ইউরোপে ও বিস্তার ঘটতে পারে। তাই এর এখনি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। অবশেষে জার্মান সরকার রবার্ট কচের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম পাঠালেন মিশরে।
কলেরা নিয়ে গবেষণা করা এবং এর বিস্তার রোধ করা যায় কিনা তার উপায় উদ্ভাবন করাই ছিল এই প্রতিনিধিদলের কাজ। তিনি এর জীবাণু পরীক্ষা করে দেখলেন কমার (,) মত দেখতে এক জাতের জীবাণুই হল এই রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিন্তু এই রোগ মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করে কেমন করে তা তিনি বুঝতে পারলেন না প্রথমে। এই জীবাণুগুলো এত দ্রুত ছড়ায় কেমন করে? আবার চলল তার গবেষণা। অবশেষে তিনি এরও সমাধান করতে সক্ষম হলেন।
তিনি দেখলেন পানীয় জন, খাদ্য ও পরিধেয় বস্ত্রের মাধ্যমেই এই মারাত্নক জীবাণুগুলো দ্রুত এক দেহ থেকে অন্য দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তাই পানীয় খাদ্য গ্রহণ ও বস্ত্র পরিধান সম্পর্কে যদি জনগণকে সাবধান করে দেয়া যায় তবে এই রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। কলেরা সৃষ্টিকারী এই জীবাণুর নাম হল Vibrio cholerae ।
তিনি কলেরা মহামারী নিয়ে গবেষণা করার জন্য ভারত তথা কলকাতা পর্যন্ত এসেছিলেন। এরপর তিনি আবার নতুন করে যক্ষ্মার জীবাণু নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।
তিনি এবার পরীক্ষা করলেন একই দেহে জীবিত যক্ষ্মার জীবাণু ও মৃত জীবাণু একসাথে প্রবিষ্ট করালে কি প্রতিক্রিয়া হয়। মৃত জীবাণু সেখানে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে কিনা। তিনি তার গবেষণায় আংশিক সফল হলেন। তিনি এই মর্মে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগীকে ভালো করে তোলা সম্ভব।
শুধু যক্ষ্মা এবং কলেরাই নয়, তিনি অন্যান্য রোগজীবাণু নিয়েও গবেষণা করেছেন।
কুষ্ঠরোগ (Leprosy), গবাদি পশুর সংক্রামক ব্যাধি (Rinderpest), প্লেগ (Plague), টেক্সাস ফিভার (Texas fever) এবং ম্যালেরিয়ার জীবাণু নিয়েও তিনি গবেষণা করেছেন। ম্যালেরিয়া কেন দ্রুত বিস্তার লাভ করে তার কারণ তখন মানুষ জানত না। তিনিই প্রথম বললেন যে, একজাতের মশার দ্বারাই এই রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এই মশকেরা ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহক। এরা যখন রক্ত খাওয়ার জন্য মানুষকে দংশন করে তখনি ওদের দেহ থেকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু মানবদেহে সংক্রমিত হয়, তখন সেই ব্যাক্তিও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস ও (Ronald Ross) একই ধরনের আবিষ্কার করেছিলেন।
১৯০১ সালে কচ যক্ষ্মার জীবাণু সম্পর্কে যে সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন এবং এই জীবাণু নিয়ে তিনি যেসব গবেষণা করেছেন তার উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন, বোভিন টিউবারকিউলোসিস (Bovine Tuberculosis) নামে যে জীবাণু দ্বারা মানুষ আক্তান্ত হয় তা এতই বিরল যে তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কচের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। পরে আমেরিকা এবং ইউরোপে এই সিদ্ধান্তের উপরেই অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল।
দেখা গেছে এ ধরনের আক্রান্ত ঘটনা বিরল নয় বরং বহুল।
ব্যাক্তিজীবনে রবার্ট কচ ১৮৬৭ সালে Emma Adolfine Josephine Fraatz কে বিয়ে করেন। তাদের একটি কন্যা সন্তান ছিল। ১৮৯৩ সালে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং ওই বছরই কচ অভিনেত্রী Hedwig Freiberg কে বিয়ে করেন। Berlin Academy of sciences এ টিউবারকিউলোসিস গবেষণার উপর লেকচার প্রদানের ৩ দিনের মাথায় ১৯১০ সালের ২৭শে মে Baden-Baden এ ৬৬ বছর বয়সে এই কৃতী বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।
যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কারের জন্য ১৯০৫ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। যতদিন সভ্যতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, ততোদিন মানুষ শ্রদ্ধাভরে রবার্ট কচের অবদান কে স্মরণ করবে। যুগে যুগে তিনি মানুষকে অনুপ্রেরনা যুগিয়ে যাবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।