বাংলা আমার দেশ
প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় অমর একুশে যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গেই পালিত হচ্ছে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বা একুশের প্রত্যুষে আমাদের অমর একুশে বা বিশ্ববাসীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আনুষ্ঠানিকতা চললেও পহেলা ফেব্রুয়ারিতেই গণমাধ্যমে আমাদের একুশের যাত্রা শুরু হয়। এই আনুষ্ঠানিকতা আমাদের পুরো বছরের কান্নাকে লুকিয়ে রাখার একটি প্রচেষ্টাও বটে। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য প্রচার করার এই উটপাখিসুলভ প্রচেষ্টা অন্যের কাছে কেমন লাগে সেটি জানি না, আমার কাছে একে আত্মপ্রতারণাই মনে হয়। অবস্থাটিকে আমি 'মুখ মে শখ ফরিদ আওর বগল মে ইট' বলেই মনে করছি।
প্রতিদিন আমাদের রাষ্ট্রে সমাজে পরিবারে বাংলা ভাষা পরাজিত হচ্ছে আর আমরা গণমাধ্যমে একুশের মাহাত্ম্য প্রচার করছি, এটি নিজের বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কী হতে পারে? এমনকি যে প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার নিয়ে বাঙালি জাতি একুশের জন্ম দিয়েছিল তার কোনটাই কি পূরণ হয়েছে?
জীবিত ভাষাসৈনিক যারা তাদের কথাই শোনা যাক, তারা এমন একটি দেশ, এমন একটি সংস্কৃতি কি চেয়েছিলেন যেখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে, এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি চেয়েছিলেন যেখানে বৈষম্য থাকবে? যেসব ভাষা সৈনিক মৃত্যুবরণ করেছেন তারাও জীবনের আকাঙ্ক্ষা গুলোর অপূর্ণতা নিয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের ভাবনার প্রকাশ হচ্ছে - সর্বত্রই ব্যর্থতা বা উল্টো পথে যাত্রা। আমি নিজে মনে করি, কোনো কাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়াই যায়। সকল কাজে সফলতা আসে না। কিন্তু যদি সেই কাজের চেষ্টা না করা হয় বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো অঙ্গীকারের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করা হয় তবে তাকে সদিচ্ছা বলা যাবে না।
আমরা একুশের অঙ্গীকারে সফল হয়েছি। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে কিছু লোক একদিকে একুশের প্রতিজ্ঞাকে বিনষ্ট করছে, অন্যদিকে আমাদের মাতৃভাষাকে পিছু হটিয়ে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। সেজন্যই বাংলা ভাষার নামে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে অসহায় বাংলা ভাষাকে দেখে কষ্ট লাগে। একইসঙ্গে একুশের গণতান্ত্রিক অসামপ্রদায়িক শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজ থেকে যখন অনেক দূরে উল্টো স্রোতে যাত্রা দেখা যায়, তখনো বুকের কষ্ট চেপে রাখা দায় হয়ে পড়ে।
এখন কিছু লোকের কাছে আমাদের একুশ মানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা, গণমাধ্যমের কিছু চিৎকার। এই সময়ে গণমাধ্যমে '৫২-র ফেব্রুয়ারির কোন্ তারিখে কোথায় কোন্ ঘটনা ঘটেছিল, কোন্ ভাষাসৈনিক কী বলছেন, কেমন আছেন তারা, এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই পত্রিকার একটি কলাম বরাদ্দ থাকে এই খাতে। এমনকি যেসব বাংলা টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে, আচার-আচরণে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না তারাও পেছনে ইংরেজি ভাষার ব্যানার লাগিয়ে একুশের বইমেলা থেকে সরাসরি টিভি অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকেন। এসব টিভি চ্যানেলের নাম থেকেই উপলব্ধি করা যায় যে, মাতৃভাষার প্রতি তাদের কত গভীর দরদ রয়েছে! এদের কারো কারো পুরো নামই ইংরেজি।
আবার কেউ কেউ ইংরেজি শব্দের সঙ্গে নিজেদেরকে বাংলা শব্দ দিয়ে যুক্ত করেন। এমনকি আমাদের জাতীয় টিভি নেটওয়ার্ক বিটিভি এখন বিটিভি ওয়ার্ল্ড হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষায় ওয়ার্ল্ড শব্দের কোনো বাংলা অর্থ নেই। কার্যত বিটিভির ব্যাপারটি আমাদের পরাজিত শত্রু পাকিস্তানের নির্লজ্জ অনুকরণ। ওরা পিটিবি এবং পিটিবি ওয়ার্ল্ড বলে।
অন্যদিকে আমাদের লোকজন পিটিভি'র বদলে বিটিভি লেখে। দুর্ভাগ্য আমাদের যে, একটি বাংলা বর্ণ তাদের দৃষ্টিতে পড়তে পারেনি। ইংরেজি ছাব্বিশটি বর্ণের বিপরীতে আমাদের বাংলা ৫০টি বর্ণ তাদের নজর কাড়তে পারেনি। যদিও এই তাবত টিভি গোষ্ঠীর শতকরা একশ ভাগ দর্শক বাংলা ভাষাভাষী তবুও তারা কেউ কেউ তাদের অনুষ্ঠানের নামও বিকৃতভাবে ইংরেজিতেই লিখে থাকে। কখনো কখনো রুচিহীনভাবে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠানের নাম রাখা হয় সম্পূর্ণ ইংরেজিতে।
তাদের এসব অত্যাচার এতটাই মারাত্মক যে, এটি কোনো সুস্থ মানুষের জন্য হজম করা কঠিন। নিজের চুল ছিঁড়া ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। ওরা সর্বত্র প্রভাবশালী। রাষ্ট্র-ব্যবসা-অর্থনীতি-সমাজ-মিডিয়া সবখানেই এদের প্রচণ্ড- দাপট। আমি মনে করি, এটি আমাদের মাতৃভাষাকে, বাংলা ভাষাভাষীদেরকে ব্যঙ্গ করার শামিল।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম আমাদেরকে মুগ্ধ করে। এসব নাম থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাংলা ভাষা কতো মধুর। তবে ক্ষমতাধরদের কাছে এই মধুরতা কোনো মূল্য রাখে না। কারণ ইংরেজি আমাদের চারপাশকে এমনভাবে গিলে খেয়েছে যে, এখন দেশের উচ্চ পর্যায়ে আসীন ব্যক্তি থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত সকলের কাছেই ইংরেজির মর্যাদা বাংলার চাইতে বহুগুণ বেশি বলে প্রচার করা হয়।
দেশের খেটে খাওয়া দরিদ্র গ্রামীণ স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষজন ব্যতীত শিক্ষা, ব্যবসা, উচ্চ আদালতসহ সকল ক্ষেত্রেই ইংরেজির দাপট প্রসারিত হয়েছে। সারা জাতির প্রত্যাশা থাকার পরও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রবেশ করতে পারেনি। দেশের আইন বাংলায়, বিচারক বাঙালি, আইনজীবী বাঙালি, বিচারপ্রার্থী বাঙালি কিন্তু উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা নয়, ইংরেজি। দেশের ভেতরে বাঙালির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাষাও ইংরেজি। আবার এমনও হয় যে, আমরা সবাই বাঙালি, কিন্তু আমরা সভা-সমাবেশের, সেমিনার বা কর্মশালার ভাষা করে ফেলি ইংরেজি।
অবস্থা এমন যে, ইংরেজি না বললে জাতে ওঠা যায় না। এমনকি এটিও বলা হয় যে, ইংরেজি না জানলে কম্পিউটার চর্চা করা যায় না। কম্পিউটারের নামে সরকার বাংলাকে ইংরেজি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করছে। সরকারী বিলপত্র, ঘোষণা, ওয়েবসাইট ইত্যাদি বাংলার বদলে ইংরেজিতে হচ্ছে। এমনকি বিটিআরসি পর্যন্ত মোবাইল ফোনের ফরম সম্পূর্ণ ইংরেজিতে করেছে।
এক সময়ে আমাদের সরকারী ব্যাংকগুলো বাংলায় কাজ করতো। কম্পিউটারের নামে সেসব এখন ইংরেজিতে হচ্ছে। অথচ তারা জানে না যে, সারা দুনিয়ার সকল মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে না। বরং ইংরেজি মাতৃভাষা এমন লোক দুনিয়ার অর্ধেকও নয়। তবে ইংরেজির দুনিয়াজোড়া প্রচলন আছে বলে একে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার মর্যাদা দিতে হয়।
সকলের মতো প্রয়োজনে আমরা অবশ্যই ইংরেজি চর্চা করতে পারি বরং ইংরেজি জানাটা খুবই জরুরি। কিন্তু এজন্য বাংলা ভাষাকে বিসর্জন দিতে হবে এমন কথা কেউ কোনোদিন ভাবে না। এটি হচ্ছে গাড়ি চালাতে শেখার নামে হাঁটা ভুলে যাওয়ার মতো। ইংরেজি মাতৃভাষা নয়, বিশ্বের এমন সকল দেশ ইংরেজিকে দ্বিতীয় স্থানে রাখে। আমাদেরও সেই কাজটি করা উচিত।
কিন্তু আমরা একে প্রথম স্থান প্রদান করেছি।
সমাজে ও রাষ্ট্রে বাংলা প্রচলনের যে চাপটা স্বাধীনতার আগে ছিল সেটি এখন নেই। আমি স্মরণ করতে পারি, ষাটের দশক থেকে একাত্তর পর্যন্ত ফেব্রুয়ারি মাসে বহু দোকানদার তাদের ইংরেজি সাইনবোর্ড নামিয়ে রাখতেন বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন। এতে যে বাংলা ভাষার খুব উপকার হতো বা বাংলা ভাষা জাতে উঠতো সেটি বলা যাবে না। কিন্তু এর মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হতো যে, মাতৃভাষাকে মর্যাদা না দিলে মানুষ খারাপ ভাবে।
এখন সেখানে বাংলা সাইনবোর্ড খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে ইংরেজি এবং একমাত্র ইংরেজি ছাড়া বাঙালি জাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। স্বাধীনতা উত্তরকালে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেটি পর্যন্ত এখন কারো কারো দ্বারা সমালোচিত হচ্ছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে, ইংরেজি মাধ্যমে না পড়ানোর জন্যই নাকি আমরা অধঃপাতে যাচ্ছি। অথচ তারা এটি ভাবেন না যে, শিক্ষার অধঃপাতের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে না শেখাটা দায়ী নয়, বস্তুত সার্বিকভাবে শিক্ষার মান নেমে যাওয়াটাই দায়ী।
এই হতাশাজনক চিত্রটির পাশেও সাহসের, স্বপ্নের এবং আনন্দেরও অনেক দৃশ্যপট রয়েছে। যে কেউ ভালো করে তাকালে দেখতে পাবেন, স্বাধীনতার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বাংলা গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশ এটি সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষ বাংলা বেশি পড়ছে, বাংলা নিয়ে তার জড়তা নেই। নিজের মাকে যেমন আমরা আড়াল করতে চাই না তেমন করে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকেও আড়াল করতে চাই না।
এই সাধারণ মানুষই বাংলা ভাষা, বাঙালিত্ব ও বাংলাদেশের বড় শক্তি। এই শক্তি কোনোদিন পরাজিত হবে না। ফলে নানা কূটচক্রের পরেও বাংলা ভাষা পরাজিত হবে না। একুশে বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।