আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের ক্রিকেটে একজন "জয়াবরধনে/সাঙ্গাকারা" না পাওয়ার নেপথ্য কারণ

সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে...

২০০৩ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কথা।

বাংলাদেশের জন্য সেটি ছিল বিভীষিকাময় এক বিশ্বকাপ। কুরবানির ঈদের ঠিক আগের দিন কানাডার কাছে হেরে ঈদটাই মাটি হয়ে গিয়েছিল। হয়তো এ কারণেও অনেকেই ভুলে যেতে চাইবেন সেই বিশ্বকাপকে। বিভীষিকাময় ছিল আরো একজনের জন্যও।



তিনি মাহেলা জয়াবরধনে।

সেই বিশ্বকাপের ৬ ম্যাচে খেলে তিনি করেছিলেন ১৯ রান! হ্যাঁ, পাঠক। অবাক হবার কিছুই নেই। ঘটনা সত্য। এবং আরো একটি সত্য হলো, তিনি এই মুহূর্তে শ্রীলংকার সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।



তাঁর সৌভাগ্য, তাঁর জন্ম বাংলাদেশে হয়নি। যদি তিনি এই দেশে জন্মাতেন, ৬ ম্যাচে ১৯ রান করার পর তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেত। তিনি আর জাতীয় দলে খেলতে পারতেন না। হয়তো আরো কয়েক বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতেন। টুকটাক রান করতেন।

হয়তো দুই/একটা সেঞ্চুরি করতেন। একসময় ভাবতেন, খেলে আর কি লাভ? আমাকে তো আর দলে নেওয়া হবে না। তারপর একসময় খেলা ছেড়ে দিয়ে কোন ব্যবসায় ঢুকে যেতেন।

কিন্তু তিনি জন্মেছিলেন শ্রীলংকায়। তাইতো বিশ্বকাপের মতো আসরে ওরকম জঘন্য পারফরম্যান্সের পরেও তাকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দলে নেওয়া হয়েছিল।

এবং তিনিও সেঞ্চুরি দিয়ে রাজকীয় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

আর সেই বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলে থাকা এহসানুল হক সিজান এর কথা কি আমাদের মনে আছে? হয়তো অনেকে নামই শোনেন নি। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে যিনি জায়গা পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ দলে। যাকে মনে করা হতো অন্যতম সেরা প্রতিভা। তিনি আজ কোথায়?

এতক্ষণ ধরে এই কথাগুলো বলার পিছনে কাজ করেছে অনেক আক্ষেপ, দুঃখবোধ।

আসন্ন এশিয়া কাপের দল ঘোষণা করা হয়ে গেছে। বাজে ফর্মের কারণে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বাদ পরেছেন। বিভিন্ন ফেসবুক পেজে, ব্লগে তার পিন্ডি চটকানো হচ্ছে। মুখে আসার অযোগ্য ভাষায় গালাগালি দেওয়া হচ্ছে। কতই না বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি আমরা! অবলীলায় ভুলে গেলাম বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত জয়ে তার ফিনিশিং টাচ দেওয়ার কথা, মাথা ঠান্ডা রেখে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে আসা অসাধারণ একেকটি ইনিংসের কথা।

অথবা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এনে দেওয়া মহামূল্যবান উইকেটগুলোর কথা। পাবলিকেরই বা কি দোষ! আমাদের কালচারই যে এটা। তা না হলে প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ কিভাবে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর প্রাক্কালে এই কথা বলেনঃ "দলে কেউই নিশ্চিত নয়। এটা আমরা সোহাগ গাজীকে ২য় টি-টোয়েন্টিতে ড্রপ করে বুঝিয়ে দিয়েছি। " কি ধরণের কথা রে বাবা!

লেখার শিরোনামে ফিরে যাচ্ছি।



আমরা হা-হুতাশ করি, আমাদের দলে একজন জয়াবরধনে নেই, সাঙ্গাকারা নেই। সাকিব, মুশফিক কেন তাদের মত খেলতে পারে না। সাকিব, মুশফিকের কথা বলার কারণ, এই মুহূর্তে তারাই দলের সিনিয়র খেলোয়াড়। অথচ তাদের বয়স ২৫/২৬! বিশ্ব ক্রিকেটে আর কোন দলের সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড়ের বয়স ২৫/২৬, এ ঘটনা নজিরবিহীন তো বটেই, অস্বাভাবিকও বটে। আমরা সারাজীবনই তরুণ দল।

কচি কাঁচার দল। এটাই আমাদের একটা কমপ্লিমেন্ট! আর আমাদের ক্রিকেটের নীতি-নির্ধারকেরাও মনে হয় এটা নিয়ে খুব পুলকিত বোধ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাকিব, মুশফিক, তামিম যত প্রতিভাবানই হোক না কেন, বয়স আর অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। তাদের মাথার উপর ছাতা হিসেবেও দলে কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় থাকা দরকার ছিল। যারা হতো অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ।

এতে ড্রেসিং রুমের পরিবেশও ভালো থাকতো। দলেও ভারসাম্য আসতো। সাকিবএরও ওইরকম ক্ষণিকের জন্য মাথা বিগড়ে যেত না।

প্রশ্ন হলো, অভিজ্ঞ খেলোয়াড় কোথায়?

বাংলাদেশের নির্বাচকদের দল নির্বাচনের প্রক্রিয়াগত ভুলের কারণেই আজ এই অবস্থা। তারা কি করেন, কোন একটি সিরিজে যদি কেউ একজন খারাপ খেলেন, তাকে দল থেকে বাদ দেন।

বেশ ভালো কথা। এই কাজ সব দেশের নির্বাচকেরাই করে থাকেন। পার্থক্য হচ্ছে, অন্যান্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড বাদ দেওয়া খেলোয়াড়দের উপর আরো কড়া নজর রাখে, তাদের বেশি বেশি খেলার সুযোগ করে দেয়, তাদের ফর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে। ভালো খেললে আবার দলে সুযোগ দেয়। আর আমরা কি করি? একজন খারাপ খেলছে, সে বাদ।

সে হয়ে যায় অস্পৃশ্য। সে আদৌ ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছে কিনা, রান করছে কিনা, কেউ আর খবর রাখে না। সে খেলোয়াড়কে মোটিভেট করার মত কোন কিছুই করা হয় না। এভাবে আস্তে আস্তে একেকজন প্রতিভাধর খেলোয়াড়কে আমরা হারিয়ে ফেলি।

আমাদের আর অভিজ্ঞ খেলোয়াড় পাওয়া হয় না।



হাবিবুল বাশার, আল শাহরিয়ার রোকন, মেহরাব হোসেন অপি, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, এহসানুল হক সিজান, অলক কাপালি, আফতাব আহমেদ, নাফিস ইকবাল, তুষার ইমরান, রাজিন সালেহ, ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স, শাহরিয়ার নাফিস, এনামুল হক জুনিয়র কিংবা হালের মেহরাব হোসেন জুনিয়র, শুভাগত হোম অথবা প্রতিবারই ২/১ টা ম্যাচ খেলিয়ে ২ বছরের জন্য বাদ দেওয়া ফরহাদ রেজা। এদের যদি পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হতো, এক সিরিজের পারফরম্যান্সে দল থেকে চিরতরে ছুঁড়ে ফেলা না হতো, আমাদের কি অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকতো না? হাবিবুল বাশার অনায়াসে আরো ২ বছর খেলতে পারতেন। তাকে আর বিবেচনা করা হয় নি। এক সিরিজে খারাপ খেলার কারণে। ফরহাদ রেজা ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন অভিষেক ওয়ানডেতে ৫০ রান করে।

তাকে দলে ২ বছর পরপর সুযোগ দেওয়া হয়। ২/১ টা ম্যাচ খেলিয়ে আবার বাদ দেওয়া হয়। তাকে কি লম্বা সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়া যেত না? কোন খেলোয়াড় যখন ভাবে যে এই ম্যাচ ভালো না খেললেই আমি ২ বছরের জন্য বাদ, সে কি পারফর্ম করতে পারবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব?

আমরা বলি, আমাদের জাতীয় লীগে 'পিকনিক ক্রিকেট' হয়। কেন এমন হয়? ভারতে রঞ্জি ট্রফিতে,ইংল্যান্ডের কাউন্টিতে সবাই জানবাজী রেখে খেলে, আর আমাদের দেশে পিকনিক হয়, কেন হয়? কারণ আর কিছুই না। মোটিভেশনের অভাব।

বাদ পড়া খেলোয়াড়েরাও জানেন, আমি তো আর সুযোগ পাবো না। ভালো খেলে লাভ কি! জাতীয় দলের প্রতিষ্ঠিত তারকারা তো বলতে গেলে লীগে খেলেনই না। শুধু যারা নতুন, তারা একটু সিরিয়াসলী খেলেন। প্রায়ই দেখি সেঞ্চুরি হচ্ছে মুড়িমুড়কির মতো, সমানে ৫/৭ উইকেট পাচ্ছেন বোলাররা। প্রশ্ন হলো, আদৌ কি মানসম্মত কোন ম্যাচ তারা খেলতে পারছেন? লীগের খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই যদি হয় বাদ পড়া খেলোয়াড়, তার ভিতর তো আর মোটিভেশন বলে কিছু থাকবে না।

তিনি ভালো ব্যাটও করবেন না, বলও করবেন না। সেঞ্চুরি হবে, উইকেটও পড়বে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। সেই খেলোয়াড়ই, যিনি সেঞ্চুরি হাকিয়ে জাতীয় দলে আসবেন, আন্তর্জাতিক ম্যাচে কিছুই করতে পারবেন না। চলে যাবেন দৃশ্যপটের বাইরে।



এই সিস্টেমের পরিবর্তন দরকার। আমরা চাই না, সারাজীবন ধরে বাংলাদেশ দল তরুণ দল, কচি-কাঁচার দল হয়ে থাকুক। তরুণ দল দিয়ে ওয়ানডে, টি-২০ খেলানো যায়, ম্যাচও জিতানো যায়। কিন্তু টেস্ট খেলতে হলে অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই। মানসিক পরিপক্কতা আসে বয়সের সাথে সাথেই।

সাঙ্গাকারার পরিপক্কতা আর আমাদের নাসিরের পরিপক্কতা কি এক হবে? সাঙ্গার বয়স ৩৭, নাসিরের ২২। অযথাই রাগারাগি না করে আমাদের এটা বুঝতে হবে। বুঝতে হবে নির্বাচকদেরও। আগে কি হয়েছে এটা ভুলে গিয়ে নতুন করে সবকিছু করার চিন্তা করতে হবে। যে দলটা বর্তমানে খেলছে, নিশ্চিত করতে হবে এই দলই যেন আগামী ১০ বছর খেলতে পারে।

হয়তো কিছু পরিবর্তন আসবেই। আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আগামী ১০ বছর পরের জাতীয় দলে যদি এই দলের অন্তত ৫ জনও থাকে, যদি সেই দলে সাকিব, তামিম, মুশফিক, নাসির থাকেন, আমরা কতটা ভয়ংকর দল হবো সেটা আশা করি সবাই বোঝেন। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে যেমন নির্বাচকদের, সেই সাথে আমাদেরও। কোন খেলোয়াড় খারাপ করলে রেন্ডিয়ার কালচার অনুযায়ী তাদের ধুয়ে ফেলার নীতি থেকে সরে আসতে হবে।

জাতীয় লীগের মানোন্নয়ন করতে হবে। খেলোয়াড়দের মনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, আমি যদি বাদও পরি, এই লীগে ভালো খেললেই আমি আবার দলে আসবো। খেলোয়াড়দের মধ্যে এই মোটিভেশন জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব নির্বাচকদের, দেশের ক্রিকেটের সকল নীতি-নির্ধারকদের।

এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ভালো খেলার অপেক্ষায় থাকলাম।


"আঁধার কাটবেই...আলো আসবেই...স্বপ্ন হাসবেই..."

















অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.