সহজ আলোয় দেখা...
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো গুলোর অন্যতম সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে স্যান্ডস-এর ক্যাসিনোটি। এখানে আসার পরে এটার কথা বহুবার শুনেছি। কোন এক সন্ধ্যায় মেরিনা বে স্যান্ডস-এর নদীর পারে হাঁটতে হাঁটতে, হাওয়া খেতে খেতে এই জগদ্বিখ্যাত ও কুখ্যাত ক্যাসিনো দেখার কৌতুহল জাগে।
ক্যাসিনো বললেই সিন সিটি লাস ভেগাসের কথা মনে আসে সবার আগে। কিন্তু টিভি-সিনেমায় দেখা লাস ভেগাসের ক্যাসিনোর তুলনায় সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোগুলো অনেক ভদ্র প্রকৃতির।
কয়েকটা ফ্লোর নিয়ে, কয়েক লক্ষ বর্গফুটের বিশেষভাবে ডিজাইন করা এই ক্যাসিনোতে আছে শত শত ভিডিও গেম সদৃশ ক্যাসিনো স্লট, আছে পোকার, ব্ল্যাক জ্যাক, রোলেট, ক্র্যাপ্স সহ নানা রকম বিচিত্র খেলা।
খেলার চাইতেও আমার কৌতুহল ছিল খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া দেখা।
চাইনীজদের মধ্যে জুয়া খুবই জনপ্রিয়। যেটার নজির দেখা গেল ক্যাসিনোতে। বালক থেকে বৃদ্ধ, সব বয়েসী চাইনীজদের চোখে পড়লো।
দেখা মিলল আমাদের দেশী ভাইদেরও। একজনকে "বাংলাদেশ থেকে?" বাংলায় জিজ্ঞেস করতেই হাসি একান থেকে ও কান করে ফেলল।
এবারই প্রথম এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বোঝা গেল এবারই এখানে তার প্রথম আসা নয়, এবং আগের অভিজ্ঞতাগুলো খুব সুখকর ছিল না।
এখানে জুয়া খেলতে আসা বাংলাদেশীদের প্রায় সবাই খুব অল্প বেতনে চাকুরি করে।
দেশ থেকে জায়গা-জমি বিক্রি করে, ধার-কর্য করে বিদেশে এসেছে ভালো উপার্জনের আশায়। শুনেছি এদের অনেকেই এখানে ক্যাসিনো খেলতে এসে লোভে পড়ে সারা মাসের বেতন খুইয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফেরে।
ক্র্যাপ্স নামের একটা গেমের সামনে ভীড় বেশী দেখা গেলো। বড় একটা টেবিলের ওপর অনেক গুলো ঘর থাকে। জুয়াড়ীরা পছন্দ মতো ঘরে বাজি ধরবে।
তিনটা লুডুর ডাইস টেবিলের ওপর ছুঁড়ে মারা হবে। যারা যারা বাজি ধরেছে সবাই রুদ্ধ শ্বাসে তাকিয়ে থাকে। তারপর ডাইসগুলোতে যে যে সংখ্যা উঠবে, সে অনুযায়ী কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলে উঠবে। বাজির টাকার কেউ দ্বিগুন, কেউ চারগুন ফিরে পাচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বেশিরভাগ বাজিকরের।
একজনকে দেখলাম একসাথে দুই টেবিলে খেলছে ক্রমাগত।
প্রতিবার দান ফেলার আগে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গেমের স্কোর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছে। ছোট ছোট দান গুলোতে হেরে যাচ্ছে। বড় দান গুলোতে হেরে যাবার পরিমাণ কম, হয় জিতছে, নয়ত টাই হচ্ছে।
আর একজনকে দেখা গেল, খুবই অস্থির ভাবে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরছে। অন্যান্যরা যেখানে ১০, ২৫ বা বড়জোর পঞ্চাশ ডলারের বাজি ধরছে, সে একেকবারে পাঁচশ থেকে হাজার ডলারের বাজি ধরছে।
খুবই অবাক ব্যাপার হলো বেশিরভাগ বাজিই জিতে যাচ্ছিল। লোকটার এই বার বার জিতে যাওয়ার ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করলাম। কি হতে পারে? জুয়াড়ীদের আকর্ষণ করার জন্যে সাজানো নাটক? প্রতিভাবান গণিতবিদ চোরের কারসাজি? নাকি কেবলই ভাগ্য? শেষের অংশটি কেন জানি মানতে পারলাম না। প্রবাবিলিটির থিওরির হিসেবে যেখানে ৯০% ক্ষেত্রেই অন্যান্যরা হারছে সেখানে একজনের ওপর "প্রোবাবিলিটি" দেবতার এতোখানি সুপ্রসন্নতা স্বাভাবিক না।
বয়স্ক একজন মহিলাকে দেখলাম, বাজির জন্যে কয়েন ফেলে পর মুহূর্তেই উঠিয়ে ফেলছে, খেলার জন্যে সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না শেষ পর্যন্ত।
খুবই মলিন পোশাকের এক বৃদ্ধ চাচাকে দেখা গেল চকচকে পাঁচটা পঞ্চাশ ডলারের নোট দিয়ে জুয়ার কয়েন কিনতে। হয়তবা তার কয়েক সপ্তাহের খাবারের খরচ নিয়ে এসেছে জুয়া খেলতে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে চাচার খেলা লক্ষ্য করলাম। তাঁর উৎসাহী চেহারা তাঁর পোশাকের মতোই মলিন হতে পাঁচ মিনিটেরও কম সময় লেগেছিলো।
সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনোর প্রচলন হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি।
কিন্তু এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরের অন্যসব সামাজিক সমস্যাগুলোকে ছাড়িয়ে ভয়াবহ প্রকট আকার ধারণ করেছে। লোভের পরিণতিতে হতাশা, বিষন্নতা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো ঘটনা অহরহই হচ্ছে। নিজেদের নাগরিকদের জুয়ার নেশা থেকে দূরে রাখার জন্যে ক্যাসিনোতে তাদের জন্যে ১০০ ডলার এন্ট্রি ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবু এ থেকে উদ্ভূত নানা সমস্যার কিনারা করা যাচ্ছে না। সিঙ্গাপুরের শত উন্নতির উদ্ভাসের ওপিঠে জুয়া একটা দগদগে সংযোজন।
এর ফাঁদে যে একবার পা দিয়েছে, তার ধংস অনিবার্য!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।