আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার দুষ্প্রাপ্যতায় রাজধানীসহ দেশজুড়ে চিকিৎসার নামে নানা ভণ্ডামির একচ্ছত্র দাপট চলছে। হারবাল, কবিরাজি, ইউনানির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অলিগলি, বাসাবাড়িতেও গজিয়ে উঠেছে অজস্র প্রতিষ্ঠান। তারা স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতার সুযোগে রীতিমতো প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে। ভুয়া ডাক্তার-কবিরাজ মিলছে অহরহ। এর বাইরে পীর-ফকির, ওঝা-বদ্যি, পানিপড়া, তেলপড়া, ঝাড়-ফুঁকের দৌরাত্দ্য তো আছেই।
হারবাল, ইউনানি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নামেও আসলের চেয়ে ভেজালের দৌরাত্দ্যই বেশি। ভুয়া ডাক্তারের আধিপত্যের পাশাপাশি অবাধে প্রচার-প্রচারণা চলছে চটকদার বিজ্ঞাপনের। অশ্লীল, রগরগে ভাষায় প্রস্তুত করা লিফলেট, পোস্টারে রাস্তাঘাট, বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশন সয়লাব থাকছে।
রাজধানীর রাস্তা-ফুটপাত, মোড়, বাজার, ট্রেন স্টেশন, লঞ্চ ও বাস টার্মিনালসহ দেড় শতাধিক স্থায়ী স্পট রয়েছে ওষুধ ফেরিওয়ালাদের। যেখানে-সেখানে বসছে পাখির ঠোঁটে ভাগ্য গণনার আসর, সাপুড়েদের তাবিজ বিক্রির মহড়া।
কঙ্কাল আর শেকড়-বাঁকড় নিয়ে আদি অকৃত্রিম গলায় কিংবা টু-ইন-ওয়ানের বর্ণনা দিয়ে চলছেন বিচিত্র সব ক্যানভাসার। তাদের ভাষায়, নিজ হাতে প্রস্তুতকৃত ওষুধ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির 'অব্যর্থ মহৌষধ'। বেআইনিভাবে ফেরি করে বিক্রি করা তথাকথিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ব্যবহারে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে তা আরও জটিল হচ্ছে। কথার তুবড়ি ছুটিয়ে লোকদের বশ করার ফাঁদ পাতছেন ঝাড়-ফুঁক কবিরাজরা। চানখাঁরপুলের সুরুজ মিয়া বলেন, ১৯৬১ সাল থেকে ঝাড়-ফুঁক করছেন তিনি।
একপর্যায়ে তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে এক ইরানি ব্যক্তির কাছে চিকিৎসা পদ্ধতিটি শিখেছেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সুরুজ মিয়ার আস্তানা থেকে হাঁপানি, জন্ডিস ও আমাশয়ের ওষুধ দেওয়া হয়। রোগীদের কমলা-কলা ইত্যাদি পড়া দেন, সঙ্গে দেন তাবিজ-কবচ। তবে সুরুজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে আশপাশের লোকজনের অভিযোগের অন্ত নেই। প্রতি রাতে নেশা ভাঙ্ সেবন করে, মাতলামির মাধ্যমে সামাজিক পরিবেশ নষ্টেরও অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
চানখাঁরপুলের অদূরেই ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল-সংলগ্ন রাস্তার পাশেই পসরা নিয়ে বসেছেন নোয়াখালীর আবদুর রব। বয়স ২৫। পরনে সাদা আলখেল্লা। মাথায় সাদা হাজি রুমাল। মুখে অল্প দাড়ি ও গোঁফ।
গায়ের রং শ্যামলা। টেবিলের ওপর লাল-নীল কালিতে ছাপা তাবিজ নিয়ে বসে আছেন তিনি। ফিনফিনে পাতলা ফোল্ডিং পেপারের তাবিজগুলো জিন-ভূত, আছর-নজর, বালা-মসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষকে দিয়ে থাকেন আবদুর রব।
হেকিম তুফানের চিল্লাফাল্লা : মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের সামনে হেকিম তুফান মিয়ার জমিয়ে তোলা আসরটি দিন দিন জমজমাট হয়ে উঠছে। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকেই হেকিম তুফান মিয়াকে ঘিরে বাড়তে থাকে ভিড়।
তার অদ্ভুত সব কথাবার্তা শুনে কেউ হাততালি দেয়, আবার কেউ পড়ে যায় গভীর চিন্তায়। কম কথা নয়, সব ধরনের যৌন রোগসহ এইডসের ভয়াবহ বর্ণনা তুলে ধরেন তুফান মিয়া। এসবের সমাধানও আছে তার কাছেই। বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি আর চিল্লাফাল্লায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন তিনি। হাতের ইশারায় সহযোগীদের বাদ্যযন্ত্র বাজানোও বন্ধ করেন তুফান মিয়া।
এরপর আদি অকৃত্রিম গলায় প্রথমে নিজের এবং পরক্ষণেই তার তৈরি করা ওষুধের গুণাগুণ তুলে ধরেন। পাশাপাশি আসামের গহিন বনে একযুগ সাধনার মাধ্যমে 'হেকিম-কবিরাজ' হওয়ার কাহিনী প্রচারেও ভুল হয় না তার। সেসব শুনে অনেকের মনেই আস্থা সৃষ্টি হয়। আর এ সুযোগটি নিয়েই ওষুধ, গাছন্ত, মালিশের তেল বিক্রি শুরু করে দেন তুফান মিয়া। এভাবেই সর্বরোগের মহৌষধ বিক্রির নামে মহানগরজুড়ে চলছে সীমাহীন প্রতারণা।
ক্যানভাসাররা গলা চড়িয়েই বলেন, যেসব রোগ সারাতে বড় বড় ডাক্তার ব্যর্থ হয়েছেন, কিংবা দেশ-বিদেশের বিখ্যাত হাসপাতাল থেকে রোগী হতাশ হয়ে ফিরেছে, স্বল্পমূল্যের এ ওষুধ সেবনে সেসব রোগ নিরাময়ের গ্যারান্টি ১০০ ভাগ। কোনো রোগী এ-জাতীয় প্রচারণায় অবিশ্বাস করলে সে ক্ষেত্রে ক্যানভাসাররা নিজস্ব ছাপানো প্যাডে 'চুক্তিপত্র' করতেও দ্বিধা করেন না। ইদানীং তারা সংঘবদ্ধভাবেও শুরু করেছেন প্রতারণা। অভিজাত মার্কেটে অফিস সাজিয়ে বসে দালালদের মাধ্যমে রোগী ধরে তথাকথিত 'মহৌষধী চিকিৎসা' শুরু করেন। অপর গ্রুপ প্রাইভেট কার নিয়ে ছুটে যায় জনবহুল স্পটে।
সেখানে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে অত্যন্ত কৌশলী বক্তব্য উপস্থাপন করে চালায় ওষুধের বেচাকেনা। তারা কিডনি, এইডস এবং বিনা অপারেশনেই অশর্্ব-ভগন্দরসহ নানা জটিল রোগ নিরাময়ের পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ওষুধ বিক্রির সময় হাতে হাতে তারা নিজস্ব প্রচারপত্রও বিলি করে থাকে। উদ্ভট সব কথাবার্তায় ভরপুর লিফলেটগুলো পড়লে নিজে নিজেই পেতে হয় লজ্জা। এসব ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, ওষুধ ফেরিওয়ালাদের বৈধ রেজিস্ট্রেশন বলতে কিছু নেই।
তাবিজ-কবজে অসাধ্য সাধন : সাত থেকে একুশ দিনের মধ্যে সব ধরনের রোগ নিরাময়, অবাধ্য স্ত্রী বশীকরণ, দীর্ঘস্থায়ী যৌন মিলনের ক্ষমতা সৃষ্টি, প্রেম-ভালোবাসা সার্থক করাসহ হরেক গুণাগুণের প্রচার চালিয়ে 'তাবিজ-কবজ' বিক্রির হিড়িক লক্ষ করা যায়। বিশেষ ধরনের বেশভুষায় একশ্রেণীর লোক ধর্মীয় নানা বুলি আউড়িয়ে সব কাজের ক্ষমতা-সংবলিত(!) তথাকথিত তাবিজ বিক্রি করে থাকেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেট, কোর্ট চত্বর, সদরঘাটসহ বিভিন্ন রুটের লঞ্চ ও চলন্ত বাসের মধ্যেই তাবিজ বিক্রেতাদের বিচরণ। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এসব ভ্রাম্যমাণ প্রতারকের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা একান্ত জরুরি।
জিনহুজুরের আতঙ্ক : আল্লাহর কালাম আর নানা সাধনায় জিন বশ করার দাবি জানিয়েও একশ্রেণীর মানুষ বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে।
রাজধানীর উত্তরার ফায়দাবাদ এলাকায় এমন জিনহুজুরের আস্তানা গড়ে তুলেছেন হাফেজ আবদুল জলিল। অনেক চেষ্টার পর মধ্যরাতে জিনহুজুরের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব হয়।
অষ্টধাতুর আংটি : জটিল রোগ নিরাময়ের দাবি তুলে রাজধানীজুড়ে চলছে অষ্টধাতুর আংটির রমরমা ব্যবসা। ইস্টার্ন ও মোতালেব প্লাজায় অষ্টধাতুর আংটি বেচাকেনার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ছোরহাব গাজিপুরী জানান, এ আংটির কারণে জাদু, টোনা, বাণ, কুফরি কালাম থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
অর্শ, গেজ কিংবা মহিলাদের গোপনীয় নানা জটিল রোগের অব্যর্থ সমাধান হিসেবে অষ্টধাতুর আংটি নাকি খুবই উপকারী। ছোরহাব গাজিপুরীর লিফলেটে দেখা যায়, আল্লাহর রহমত আছে বলেই কম টাকায় এসব আংটি বাজারে ছাড়া গেছে।
২১ ও ৪১ টাকায় বিক্রি করা ছোরহাব গাজিপুরীর কথিত অষ্টধাতুর আংটিতে স্বর্ণ, রুপা, পিতলসহ আট রকম পদার্থ থাকে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু অষ্টধাতুর আংটির সাহায্যে রোগ নিরাময় লাভের কোনো যৌক্তিকতা মেলেনি। তবু ধুমছে চলছে কেনাবেচা।
পাথরে ভাগ্য ফেরানোসহ নানা রোগ নিরাময়ের ব্যবসাও এখন বেশ জমজমাট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।