আমি। কেউ না। তবে মাঝে মাঝে আমার দুষ্ট মনটা কানে কানে এসে বলে, তুমি মহাকালের উচ্ছল সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো এক কচুরিপনা । কালের ঊর্মিমালার সাথে সাথে নাচা ছাড়া তোমার আর কোন কাজই নেই.....
এক
“স্বপ্ন সবাই দেখে। স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করেনা এমন মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
..........” দিদি আরও কত কিছুই না বলে চলেছেন অশ্রুভেজা কন্ঠে। কিন্তু আমি আছি আমার চিন্তাই বিভোর। কিভাবে স্কুল থেকে শিক্ষা সফরে যাওয়ার টাকা জোগাড় করা যায়? আমি ভয়ে ভয়ে বল্লাম। মেঝদি, এসব পরে শুনব। তুমি আমাকে পাঁচশ টাকা দিতে পারবে? শিক্ষাসফরে যাব।
দিদি মুখ কালো করে বল্লেন- আমি তোর কাছে কারণ জানতে চেয়েছি? যা, ওখান থেকে আমার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে আয়। দিদি আমার হাতে চকচকে একটা পাঁচশ টাকার নোট গুজে দিলেন। আমি টাকা পেয়ে ভুঁ দৌড়ে বেরিয়ে আসতে আসতে কানে বাঁজছে। দিদি বলছেন, “নিজের খেয়াল রাখিস। সাবধানে চলিস।
বাজে খরচ করিস না। ..... ” এসব বড়তোতো কথা। এগুলো বড়দের একান্ত সম্পত্তি তাই বড়তোতো বল্লাম।
আমার এই একটাই দিদি, যে আমার সকল আবদার বিনা বাক্যব্যয়ে পূরণ করে। কখনও বলেনি কেন? এরকম করলি কেন? এসব কর্তৃত্বমূলক প্রশ্ন।
সবসময় শুধু একটা কথা বলতো। ভাল থাকিস। মায়ের আশাটা পূরণ করবিতো? আমি হ্যাঁ বলে চলে আসতাম। আজ তার চিরচেনা বাক্যটা আমাকে কেন বলেনি বুঝলাম না? এই দুইটা কথাতে হয়তো আমার জীবন পরিচালনার নির্দেশিকা নিহিত। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও আদর করে ‘মেঝদি’ বলি।
সেও আমাকে আদর করে ছোট বলে। মাঝে মাঝে খোকাবাবু। সে সবসময় মাকে বলে, তোমার ছেলেদের মধ্যে দেখিও ছোটই তোমার সব দুঃখ র্দূদশা ভাগিয়ে দিবে। এনে দিবে সুখের প্রহর। মাও সাহস করে মাথা নাড়ে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, হয়তোবা?
দিদি এখন অনার্স করছে। ৩য় বর্ষে। অত্যন্ত মেধাবী। পাশ করার পর বাবা ছাড়া সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর কথা ভাবছিলো। বাবা নারাজ থাকাতে দিদিও আর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি ভাল করে নেয়নি।
তাই ভর্তিও হওয়া হলো না। পরে সবাই দিদিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কলেজে অনার্স শেষ করতে বললো। দিদিও মেনে নিল। শহরে এসে ভাল কলেজে ভর্তি হল ঠিক কিন্তু থাকার কোন ব্যবস্থা হয়নি। কারণ মা-বাবা গ্রামে।
আমরা ভাইরা বড় আপুর বাসায় থেকে পড়া-লেখা করি। একজনের উপর আর কত ভার চাপানো যায়। তাই মেঝদির ওখানে থাকা চলবে না। এমনটাই বলেছে বাবা। বড় আপু আমাদের জন্য যার পর নায় কষ্ট করেন।
মা সবসময় কলতেন, যদি তোমরা শরীরের চামড়া দিয়ে শিশিরের জুতা বানিয়ে দাও, তবু তাঁর ঋণ শুধ হবে না। আমরাও একথা খাড়া পায়ে মেনে নিই। শিশির আমাদের বড় দিদি। আপুর স্কুলে কোন অনুষ্টানে কোন নাস্তা দিলে তা তিনি না খেয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। তাঁর মেয়েদের পর্যন্ত আমাদের সাথে ভাগ করে দিতেন।
একা কখনও তাঁর ছেলেদের নিয়ে খেতেন না। অনেকবার এ ঘটনা ঘটেছে।
অনেক কষ্টে মা-বাবা মেঝদির জন্য একটা স্কুলে চাকরি ঠিক করেছেন। দিদি স্কুলের হোস্টেলে থাকবে। হোস্টেলে যাওয়ার সময় দিদি আমাকে বার বার করে বলে গেলেন, বড় আপু যা বলে তা শুনবি।
ঠিকমতো পড়াশুনা করবি। যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবি। নিজের খেয়াল রাখিস। এই প্রথমবার শুধু দিদি আমাকে কর্ততৃত্বমূলক কথাগুলো বলেছিলেন। আমি অন্য দিকে ফিরে নিরবে কাঁদছিলাম।
দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আরে বোকা কাঁদছিস কেন? আমি কি তোদের ছেড়ে ভিন গ্রহে পাড়ি জমাচ্ছি? বরং তোর নিঃশ্বাস দূরত্বেইতো যাচ্ছি। আমি কিছুই বল্লাম না।
স্কুলে টাকা জমা দিয়ে পথে নামতেই এতসব ভাবনা মাথায় এসে জট পাখিয়েছে। আজ প্রথম আমি হাঁটতে হাঁটতে এতো ভাবলাম। খুব ভাল লাগছে।
আপন মনে হাঁটছি। দূর থেকে সাকিবের আওয়াজ শুনে এগুলাম। হাত মিলিয়ে একসাথে মাঠে বসেছি। সাকিব বল্ল- তোর জন্যে একটা চিরকুট আছে।
-কে দিল?
-খুল্লে দেখতে পাবি।
- নাম বল্লে কী অসুবিধেটা হবে শুনি?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে ছোট একটা কাগজ হাতে দিয়ে বল্ল, নে খুলে দেখ। আমি যাচ্ছি।
হাতে নিয়ে আর খুলতে ইচ্ছে করছে না । ভাবছি। এখানে না।
বাসায় গিয়েই বরং খুলি। পকেটে পুরে বাসায় চলে আসলাম। বিভিন্ন সিনেমা কিম্বা উপন্যাসের নায়কেরা এরকম অকস্মাৎ চিঠি টাইপ কিছু পেলে আয়েশ করে ঢং করে পড়ে। আমার কেন জানি ওভাবে পড়তে ইচ্ছে করছে। রাত যখন একটু ঘন হবে।
ভরা পূর্ণিমা হওয়ার কথা আজ। তখনই পড়বো।
নিস্তব্ধ রজনী। চারপাশে পিন পতন নীরবতা। জানালা খুলে দিলাম।
এক ঝাপটা মুক্ত হিমেল হাওয়া এসে আমার মুখে ঝাপিয়ে পড়ল। মনের গহীনে শির শির করে উঠল। দরাজ আকাশের বুকে প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম মেনে উঠেছে চাঁদ। চাদের মৃদু আলোতে ‘চিরকুট’ খুললাম। দেখতে সুন্দর লাগছে জো¯œার রুপালী আলোতে।
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা...
হিমেল,
তুমি শিক্ষা-সফরে অবশ্যি যাবে। কারণ তুমি না গেলে আমিও যাব না। আমাকে অন্তত এই সুন্দর একটা আনন্দ- ভেলাতে উঠতে দাও। তোমার যাওয়া হলেই শুধু সম্ভব। আমি তোমার জন্যে কাল সকালে স্কুলের সামনে কৃষ্ণচূড়ার নীচে অপেক্ষা করব।
ভালবাসা রইলো।
ইতি
মিশু
মিশু নামটা পড়ার সাথে সাথে মন অতি সুন্দর একটা মেয়ের ছবি এনে দিয়েছে সামনে। দেখতে দেখতে ওর সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়ে গেছি। বোঝতেই পারিনি ব্যাপারটা। ওর পূরা নাম মিশারা।
আমি একবার দুষ্টুমি করে মিশু বলেছিলাম। তখন থেকে সবাই ওকে এই নামে ডাকে। স্যার-ম্যাডাম সবাই। মিশুর তো আনন্দের সীমা নেই। আমার দেওয়া নাম পেয়ে সে মহা খুশী।
ক্ষুধার্ত ফকির কিছু খেতে পেলে যেমনটা খুশি হয়। ওর কথা মনে পড়তেই ভাবনার ডানায় ভর করে কিছু পুরানো স্মৃতি মনের আকাশে হাসি-খুশি মনোভাব নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বুকসেল্পের তলানি থেকে ঘেটে ঘেটে একটা ডাইরি বের করলাম। আমার রোজনামচা। ধুলো মুছে আবার জানালার পাশে বসলাম।
একটা একটা করে পাতা উল্টালাম। এই এক একটা পাতা আমার পূরনো দিনের আনন্দ-বেদনার সাক্ষী। মিশুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হওয়ার কথাটা খুঁজে বের করলাম। এখানে প্রতিকী নামে নোট করেছি (তাসপি)। অনেকেই আমার ডাইরি পড়ে।
যাতে কেউ সন্দেহ না করে। গরগর করে আমি পড়ে গেলাম....
হয়তো আমারো ট্রাম দূর্ঘটনায় মৃত্যু হবে....
আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি একবৎসর পূর্ণ হয়েছে কয়েকদিন হচ্ছে। আজ আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বিবরণী অনুষ্টান। খুব টেনশন। আমার না; আমার সব বন্ধুদের।
ওদের কপালে এ চিন্তার চাপ খুব সুচারুরূপে ফুটে উঠেছে। কারণ আর মিনিট কয়েক পরে ঘোষিত হবে স্কুল সেরা আর প্রতি ক্লাসের ক্যপ্টেনদের নাম। কার ললাট চুম্বন করবে এমনতর সৌভাগ্য? কে হবে শিক্ষকদের চোখের মনি? সবার মাথায় ছুটছে এসব চিন্তা। ভাগ্যের জোরে তার নামও যদি উঠে আসে এ তালিকায়...! সবচেয়ে বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে তাসপিকে। অষ্টম শ্রেণীর ক্যপ্টেন ছিল।
সেভেনের বার্ষিকে স্কুল সেরা আর ক্যপ্টেন নির্বাচিত হয়েছিল। কোন দূর্ভাগ্য ছুঁয়ে দিবেনাতো ওকে? দূর আকাশে চোখ তোলে বার বার এই জিজ্ঞাসাই হয়তো করছে প্রভুর কাছে। ওর সব ভাবনার মূলে হয়তো আমি। আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে এরকমই মনে হচ্ছে। মনে মনে হয়তো বলছে, বেটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
পুরো বছরটাই সবাই তাকে মাথায় তুলে নেচেছে। এখনও সবাই আামার কথায় বলাবলি করছে। সবার ধারনা আমি এবার এ মেয়েকে মাটিতে নামিয়ে দেব। এটাও তাকে কম কষ্ট দিচ্ছেনা। এই বছরের সংস্কৃতি - অঙ্গনে আমার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি।
যতটা ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছি সবটাতে প্রথম। অপ্রতিদন্ধি এক নায়ক। তাই বলে লেখা পড়ায়ও কি খুব ভালো হবে ? বুঝতে পারিনা নিজেকে কি মনে করে ও। কোন মেয়ের সাথেই কথা বলে না। জোর করে বলালে ভাল আছি বলে ইতি টেনে দেয়।
এসব হাবিজাবিও হয়তো ভাবছে। মেয়েদের স্বভাবই এরকম। সব বেকাজের কাজী। কেপটেন হবে কি হবে না এই দ্বিধার চাপটা তার মুখে খুব সুচারুপে পড়েছে। সূর্য মাতার উপর দিব্যি উত্তপ্ত কিরণ ছড়াচ্ছে।
এরকম গরমে মানুষ কি আর হেলায় দাড়িয়ে আছে? কারো মাতার উপর ছাতা, কারো মাতার উপর শোভা পাচ্ছে কিছু বই। এক আমি খালি মাতায় খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে আছি। গরম লাগছে ঠিক কিন্তু গরম থেকে রেহাই পাবার কোন চেষ্টায় করছি না। একটাই চিন্তা মাথায় ভোঁ ভোঁ করছে। রেজাল্টটা হচ্ছে কেমন ? আচমকা পেছন থেকে একজন এসে বলল, ক্যান আই হেলফ ইউ ? পেছনে ফিরে দেখি তাসপি মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে।
ওকে সহ্য করার মতো পরিস্থিতি এটা নয়। নো থ্যাংকস বলে ঘাড় ফিরিয়ে নিলাম। ততক্ষনে প্রধান শিক্ষক এসে রেজাল্টের সামারি উপস্থাপন করছিল।
“ক্লাস টেন দেয়ার নো চেইনজ, বাট ক্লাস নাইন হেভ এ চেইনজ। দ্যা চেইনজ ইজ দ্যাট মোঃ হিমেল বিকেইম ফাস্ট।
” রিপোর্টটা আমাকে আনন্দের অতিশয্যে পৌঁছে দেয়। আনন্দে কান্না চলে আসে। একটু দূরে লক্ষ্য করছি তাসপি ওড়নার আচল দিয়ে অশ্রুজল মুচছে। ইচ্ছা থাকলেও ওকে শান্তনা দিতে যায়নি। বন্ধুদের সাথে কথা বলে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম।
পথি মধ্যে ও এসে কংগ্রেজুলেশন জানাল। হাসি মুখে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসছি। চলে আসার সময়ে ও অনুরোধ করলো যাতে কাল খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে আসি। কারণ জানতে চাইলে বলল আগামিকাল জানাবে। রবিবার খুব ভোরে স্কুলের পথে রওনা দিই।
স্কুলে পৌছতে খুব বেশি সময় লাগেনি। চারপাশে নিরবতা ভর করে আছে। মাঝে মাঝে হিমেল বাতাস হৃদয়ে শান্তির পয়গাম দিয়ে যাচ্ছে। স্কুল মাঠে সবুজের সমারোহ। এই পরিবেশ আমার খুবি ভালো লাগে।
মাথার উপর কৃষ্ণচূড়ায় থরে থরে ফোটে থাকা লাল টুকটুকে ফুল গুলোও মনে এক সুতীক্ষœ সুখের সুড়সুড়ি দেয়। হঠাৎ মনে হলো ফুল গুলো ছিড়ে যদি সবুজের উপর বৃত্তাকারে সাজিয়ে দিই তাহলে খুব সুন্দর একটা লাল সবুজের পতাকা তৈরী হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমি গাছে উঠতে পারি না। একবার উঠতে গিয়ে পা ভেঙ্গে দু’মাস মেডিকেলে ছিলাম। স্কুলের ভেতর একটা ছেলেকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে ওকে ডাকলাম।
গাছ বাইতে জানে কিনা জানতে চাইলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। পাঁচ টাকার লোভ দেখিয়ে গাছ থেকে সব কৃষ্ণচূড়া ফুল পাড়িয়ে নিলাম। ফুল গুলো নিয়ে মনের মতো করে পতাকা বানাতে ব্যস্ত। পেছন থেকে এসে তাসপি ঝাকুনি দিয়ে বলল, হাই, হাওয়ার ইউ ? উঠতে উঠতে বললাম এতক্ষণ ভালই ছিলাম। মনের মতো করে একটা পতাকা বানাতে চেয়েছিলাম সেটাই বানচাল করে দিলে।
তোমরা মেয়েরা সব ভালো কাজের পেছনে লাগো কেন ? এসেছি তোমার সাথে কথা বলার জন্য। তুমি কি বলছ কথা না বলে তোমার ক্যালেগ্রাফি দেখে দেখে ক্লাস টাইম নিয়ে আসবো? যাক একটা কথা মানতে হবে তুমি খুব ভালোই আর্টও করো। আমি মূখ নিচু করে বললাম, সরি জীবনে প্রথম কিছু একটা আকঁতে নিলাম আর তাতে ভালো হয়ে গেলাম! আসলে মা বলে কি আমার আকুঁনি দেখলে কোনো মানুষই আর জীবনে কিছু আকঁতে চাইবে না। কারণ আমার ক্যালেগ্রাফি দেখে সবার আকাঁর প্রতি অরুচি জন্মাবে। ও বলল রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, কাউকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, সে যদি ঐ বিষয়ে জানার পরও অজ্ঞতা প্রকাশ করে তাহলে সে নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে।
বুঝতে পারছি ও আমাকে হাদিস দিয়ে হেনস্তা করতে চেষ্টা করছে। এসব বিষয়ে আমিও চেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। দেখ, হাদিস শুধু পড়লে হয় না; এর মর্মার্থও জানতে হয়, যা উদঘাটন করা খুবি দূরুহ। তুমি যে হাদিসটার কথা বলেছ বাস্তবে রাসূল(সা ওখানে বুঝাতে চেয়েছেন, যদি কেউ তোমার কাছ থেকে তার অজানা বিষয়ে জানতে চায় যাতে সে পরবর্তী সময়ে সে অনুসারে চলতে পারে। আর ঐ ব্যাপারে তুমি জান অথচ তুমি তার কাছ থেকে তা গোপন করেছো যাতে সে পরবর্তীতে উপকৃত হতে না পারে বা ও তোমার কাছ থেকে বেশি যাতে না জানে।
তাহলে তুমি জাহান্নামি হবে। তুমি চিন্তা করে দেখ তোমার করা প্রশ্নের সাথে এর কোন সম্পৃক্ততা আছে কিনা। তুমি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছো। আর রাসূল বলেছেন যোগ্যতা নিয়ে যাতে কখনো বড়াই না করি। আমার উত্তর শুনে তাসপি কিছুটা ভটকে গেছে।
আচ্ছা তুমি কি যেন বলবে? একটু তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয়। আচ্ছা হিমেল তুমি কি সত্যিই আমার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলে ? এখানে মিথ্যা হবার কি আছে। আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম। আচ্ছা তুমি কি আমাকে বন্ধু ভাব? অনিচ্ছা সত্যেও আমি ওর এরুপ উদ্ভট প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলে দিলাম। ও বলল, চল কোথাও বসে গল্প করি।
বলেছি সময় নেই। কোন ইমপর্টেন্ট কথা থাকলে বল। তাসপি আবার বেহুদা কথা বলা শুরু করেছে। হিমেল, আমি বরাবরি খেয়াল করেছি তুমি অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় অনেকটা ভিন্ন। একেবারে বেরসিক।
কোন মেয়েকেই সহ্য করতে পারনা। এর পিছনে বাংলা সিনেমার মতো কোন বিরহ প্রেমিকের বিষাক্ত ট্রাজেডি আছে কি? অত্যন্ত সুচারুভাবে আমার মনের কথা বের করতে চেষ্টা করছে মেয়েটা। সাত পাঁঁচ ভেবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ভেবেছিলাম এই উত্তর পেয়ে ও আমার সাথে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে বসবে। আর আমিও বিরাট এক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাব।
কিন্তু আমার আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে ও দ্ধিগুণ উৎসাহে জানতে চাইল। প্লিজ ট্রাজেডিটা বল। সত্যি আমি তোমার জন্য দুঃখিত। ঘটনাটা তোমাকে বলতে পারছিনা। ওটার কথা মনে পড়লে আমার লেখা পড়ার ছন্দ পতন ঘটবে।
আশা করি আমার এই ক্ষতিটা তুমি করবে না।
-ঠিক আছে; তুমি কি এখন কাউকে পছন্দ কর? ও সুধালো।
ওর আরেকটি অদ্ভুদ প্রশ্নের অবতারণায় আমি আরেকটু হতচকিয়ে উঠলাম। অদ্ভুদ মেয়েতো! লজ্জা শরমের বলাই নেই। আমি জানতে চাইলাম তুমি কি বুঝাতে চায়ছ ? ও বলল, ক্লাসের এত ভালো ছেলে জলের মত স্বচ্ছ কথা না বুঝার কোনো মানে হয় ? সত্যি আমি কিছু বুঝতে পারিনি।
একটু খুলে বলবে ? আমার অনুরোধের ঢেকি গিলে বলল, আমি বলতে চাইছি যে, তুমি এখন এই স্কুলের কাউকে ভালো তালো বাস কিনা ? দেখ, আমি অন্যকে এসব থেকে বিরত থাকতে বলি। নিজেও এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। -আচ্ছা বলতো, তুমি কি কখনো ট্রাকের ডিজেল বক্স থেকে একশত হাত দূরে থাকার কথা ভাব ? - নাতো ভুলেও কখনো ভাবিনি।
-কি আশ্চর্য! ট্রাকের ডিজেল বক্সে লিখা থাকে “একশ হাত দূরে থাকুন”। ওটা থেকে দূরে থাকার কথা ভাবই না।
অথচ দেখ আমাদের কপালে আর পিঠে কোথাও লিখা নাই একহাত দূরে থাক। আর সেই আমাদের কাছ থেকে তুমি হাজার মাইল দূরে থাক ?
-আমার মনে হয় বর্তমান যুগের মেয়ে গুলো ট্রাকের ডিজেল বক্স থেকে হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর এবং ধংসাত্মক।
-কেন ? ও গলায় প্রতিবাদের সূর বেঁধেছে ।
-বর্তমান যুগের মেয়েরা ছেলেদের সাথে ভালবাসার নামে ছলনা করে। ওরা ভালবাসতে জানেনা জানে শুধু প্রতারণা করতে।
এখন নারিদের বালক বন্ধুর অভাব নেই। যার হাতে টাকা আছে তার সাথেই প্রণয়ত্ব গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভালবাসা যে দু’টি মনের মিলন এই সুভোধটা তাদের কাছ থেকে একেবারে হারিয়ে গেছে। আজ একজনের সাথেতো কাল অন্য জনের হাত ধরে পুরাতন বন্ধুকে পৃষ্ট প্রদর্শন করে ঢুকে পড়ে কোন দামী রেস্তোরায়। তাদের লজ্জা শরম বলতে কিছুই আর বাকি নাই।
এটাই হাল যামানার প্রেমের মহাত্ম। তবুও আমি নারি জাতিকে সম্মান করি। কারণ এটা আমার মায়ের জাতি; আমার বোনেরাও নারি জাতির অন্যতম সদস্যা। তাই আমি এ ব্যাপারে আলোচনায় বসতে চায় না। বসলে নিশ্চিত আমার মুখ ফসকে অপ্রিয় সত্য গুলো বেরিয়ে পড়বে।
যা শুনলে আমার মায়ের, বোনের খারাপ লাগবে। শুধু শুধু তুমি কেন আমার মস্তিস্ক ঘেটে এসব মন্তব্য বের করে আনলে? তাসপি আমার কাছে অপমানিত হয়ে কাল নাগিনীর মত ফুসতে ফুসতে বলল, সব মেয়েতো আর খারাপ নয়; যেভাবে সব ছেলেরা ভালো নয়। তাহলে কেন তুমি পুরো নারি জাতির উপর দোষটা ছাপিয়ে দিচ্ছ ?
-একটা বুক সেল্পে সাধারণত সবগুলো বই থাকে না। কম বেশি খাতা ও থাকে। কেন ওটাকে আমরা বুক সেল্প বলি ?
-সাধারণত ওখানে বই বেশি থাকে।
তাই বুক সেল্প বলে। ওর সাদা মাটা উত্তর। ও হয়তো বুঝতে পারেনি ওর দেওয়া উত্তরেই লুকিয়ে আছে তার করা প্রশ্নের উত্তর। তবু আমি বিশ্লেষণ করলাম, বর্তমান যুগে বেশিরভাগ মেয়ে খারাপ। তাই দোষটা সবার উপর চাপিয়েছে।
ও আমতা আমতা করে বলল, দেখো হিমেল জীবনানন্দ দাশ। যিনি তোমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। তিনি নারীকে লক্ষী ভেবেছিলেন। তিনি নিশ্চয় তোমার চেয়ে কম বুঝতেন না।
-তুমি সে কালের কথা বলছ কেন ? আমি এ কালের কথা বলছি।
এ যুগটা তোমাদের মনের পরিবর্তন করে দিয়েছে। তবুও আরেকটা কথা মনে রেখ, জীবনানন্দ নারীদের লক্ষী ভেবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিলেন। তুমি হয়তো জান তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছিলেন। অকাল মৃত্যু ছিল। বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে ঝড়ে পড়েছিলো জ্বলজ্বলে এক তারকা।
প্রত্যক্ষভাবে যদিও আমরা ট্রাম দুর্ঘটনাকে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্ণিত করি। অবশ্য এর পরোক্ষ একটা কারণ আছে। বনলতা সেনের কথা কি মনে আছে ? জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা। সেই বনলতা সেন ছিল তার মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ। তিনি বনলতা সেন নামের একটা মেয়েকে খুবি ভালোবাসতেন।
তার সাথে বনলতা সেনের দেখা হয়েছিল মুটে দুই কি তিনবার। অথচ তিনি মূহুর্তের জন্যেও তাকে ভূলতে পারেননি। তার সার্বক্ষণিক কল্পনা জুড়ে বিচরণ করতো বনলতা সেন। তিনি রাস্তায় হাটা চলার সময়ও ভাবতেন বনলতা সেনের রুপ মাধুর্য্য। এই উদাসীনতায় ট্রাম দুর্ঘটনার মূল কারণ।
আমাদের মজলিস থেকে ঝলসিত এই নক্ষত্র হারিয়ে যাবার অন্তরালে আছে একটি নারীকে না পাবার বিষাক্ত যন্ত্রনা। তাঁর জীবন থেকে আমি এই মহা সত্যটা অর্জন করেছি বলে তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি।
-কেন তুমি উদোর পিন্ডি বূধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছো ?
-তুমি ভুল বুঝছ। আমি কিন্তু গাধার বোঝা গাধাকে আর উটের বোঝা উটকে বইতে দিয়েছি। হেসে হেসে বললাম, আরেকটা ছোট্ট কাজ করেছি।
কারণ বন্টনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সুপ্রচেষ্টা করেছি। আমি উঠে চলে আসছিলাম। তাসপি হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে ... । আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আবারো তোমার জন্যে দুঃখিত। এর ফলে হয়তো আমাকেও ট্রাম দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়তে হবে ...
ডায়রিটা আস্তে আস্তে বন্ধ করলাম।
কিছুক্ষণ চোখ বোজে কিছু একটা ভাবতে চাইলাম। কোন ফায়দা হচ্ছে না। চোখ মেলে দেখি সব কিছু জাপসা দেখাচ্ছে। চাদেঁর চারপাশ থেকে নিউরনের মতো অনেক প্রবৃদ্ধি বেরিয়েছে। এক চিরচেনা আকর্ষণে চোখের পাতারা পরস্পরকে কাছে টানছে।
আমিও হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে ...
দুই
ঘুম থেকে উঠছি ১০টা বাজে। ওদিকে ৮টা থেকে মিশু আমার জন্যে স্কুলে অপেক্ষা করছে। কিছুই করার নেই। আমি একটু অন্যরকম। আজ মিশুর জন্মদিন।
ওকে উইশও করা হলো না। যাক, আগেতো স্কুলে যাই। দ্রুত প্রস্তুতি সেরে ভুঁ দৌড় দিলাম। স্কুলের সামনে এসে থমকে গেলাম। ভেবে লাভ নেই।
এটাই হওয়ার ছিল। বেচারি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওদিকে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ওর কাছে এসে বললাম, দুঃখিত আসলে বড় আপু একটা কাজে...
কেঁদে কেঁদে বলল, তোমার আর মিথ্যে বলতে হবে না। ।
মেয়েটি অভিমানে কাঁদছে। ভালই হলো ওকে কাঁদিয়ে। না হলে একটা মেয়ে কাঁদলে যে তার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায় এই চরম সত্যটা অজানা থেকে যেত। বাহ মিশু, তোমাকে কাঁদলেতো মোনালিসার চেয়েও দারুন লাগে।
-ইয়ার্কি করিও না।
জন্মদিনে উইশতো করলে না। একটা উপহার অন্তত দাও।
-শুভ জন্মদিন। উইশতো করলাম। উপহারতো পেয়েই গেছো।
-মানে ?
-তোমাকে একটু কষ্ট দিলাম। সবাই বন্ধুর জন্মদিনে বন্ধুকে আনন্দ দেয়। আমি সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম তাই তোমাকে দেরীতে এসে একমুটো কষ্ট দিলাম। ও নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লাসে চল। আমিও বললাম, চলা যাক।
সাগর ছুটতে ছুটতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর বলছে, হিমেল নে। তুই একটা হুমায়ুন আহমেদের বই কিনতে টাকা দিয়েছিলিস না। আমি সাগরের মুখ চেপে ধরে একপাশে নিয়ে এলাম।
চুপ শালা, তোকে কি বলেছিলাম ? মিশুর সামনে আমাকে এটা দিতে না করেছিলাম তো? ও তাড়াতাড়ি কানে ধরে বলল, সরি। যাক, কি আর করা যায়?
সাগর।
এ আমার সবচেয়ে হাবলা বন্ধু। কিন্তু প্রচুর বই পড়ে। অনেক অনেক বই পড়েও যে হাবলাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় সেটা ওকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। খুব সরল মনের মানুষ। তুমি ওর চৌদ্দ গুষ্টিকে কবর থেকে তুলে এনে গালি দিলেও ও টু শব্দটি পযন্ত করবে না।
একবার স্কুলের বাইরে একটা গাছের পাতা সে লাফিয়ে ছিড়ছিলো। এলাকার একজন নেতাগুছের ছেলে ওকে ডেকে থাপ্পড় দিল। ও রিঅ্যাক্ট হিসাবে সরি বলে আসে। পরে আমরা কয়েকজন বন্ধু নেতা নামে কেতাটাকে স্কুলে ফন্দি এঁেট আনি। আমাদের স্কুলের বাথরুমে ঢুকিয়ে এমন কেলান কেলিয়েছি যে বাথরুমের জড় পদার্থ গুলোও ভয়ে কেঁপে উঠছিলো থর থর করে।
এই সাগরকে আমি গতকাল ফোনে বলেছিলাম হুমায়ুন আহমেদের “আজ হিমুর বিয়ে” ও নজরুলের “ব্যাথার দান” বই দুটি আনতে। মিশুর ব্যাগে ঢুকিয়ে দেবো ওর অজান্তে। শালা সব মাটি করে দিলো। ইচ্ছে করছে ওকেও কেতাটার মতো পেঁটাতে। কিন্তু কি করি হাজার হলেও বন্ধুতো।
বন্ধুরা মিলে একটা র্পাটি দিলো। র্পাটিতে সবাই অনেক মজা করেছি। মাইক্রোফোনে অনেকই অনেক কথা বলেছে। কোন কথা বলার মতো যোগ্যতা আমার ছিলনা। তাই আরেকবার মেঝদির কাছে হাত পাতলাম।
টাকা নিতে গেলে দিদি স্বপ্ন নিয়ে যে কথাগুলো আমাকে বলেছিলো তাই বললাম। সবার চোখে পানি চিফ চিফ করতে দেখে নিজের চোখেও জল এসে যায়। ছাগলে তিন নাম্বার বাচ্ছার মতো। এখন খুব ইচ্ছে করছে দিদির বাকি কথাগুলোও শুনতে। ইচ্ছে হলেও কী করব ? দিদি একবার খেই হারালো দ্বিতীয় বার আর কোন কথা বলে না।
নিজের উপর খুব রাগ হলো। মন খারাপ হয়ে গেলো। আর ক্লাস করতে মন চাইছেনা। বন্ধুরা মিলে কোথাও ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে। সবাইকে বললাম।
বলতেই বন্ধুরা রাজি হয়ে গেলো। সবাই মিলে ষোলশহর রেলষ্টেশনের পাশে মাতা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ে গেলাম। পাহাড়টাকে “মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়” বলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তি সেনাদের পদভারে প্রকম্পিত হত এই পাহাড়। পাহাড়ের চৌড়ায় উঠলে পুরো শহরটা চোখের সামনে ধরা দেয়।
এখানে ওখানে আগাছার মতো বেড়ে উঠেছে বস্তি, দালানকোটা। কঠিন পদার্থের অণুগুলোর অবস্থান যেমন এই শহরের জনবসতীর চিত্রটাও ঠিক তেমনি। ভেবেছিলাম এখানে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো ভাবতে চেষ্টা করব। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিময় চিহৃগুলোই ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে গেছে। মিশু গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে কাঁধে হাত রাখল হৃদয়ের গহীনে আনন্দ-অনুভুতি বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল।
পেছন ফিরে তাকাতেই মন ভালো হয়ে যায়। তার জাদুমাখা হাসি কী আর উপেক্ষা করা যায় ? ও মৃদুকন্ঠে জানতে চায়ল- মন খারাপ ? মুখে উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে জানালাম!
- একটা গান শুনবে? মন ভালো হয়ে যাবে।
- তোমাকে দেখেই মন ভাল হয়ে গেছে। তবুও যদি তোমার মর্জি হয় একটা গান করো।
-শুনো, বেদনা মধুর হয়, যদি তুমি দাও।
/ মুখের কথা হয় যে গান, তুমি যদি গাও। ...
তার সুরেলা কন্ঠ আমার মন ছুঁয়েছে আলতো করে। গভীর অনুভুতি সাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে ওর সুরেলা গানের আহবানে। অসম্ভব সুন্দর কন্ঠ বাতাস বয়ে নিয়ে গেছে পৃথিবীর রন্দ্রে রন্দ্রে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিঃসীম আকাশের বুকে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে মিশুকে নিয়ে...
তিন
বাসায় ফিরতে না ফিরতেই শুরু হলো বকাবকি।
বড়দের এই একটা বৈশিষ্ট থাকবেই। অন্য বৈশিষ্ট্যের ধার তারা ধারেনা। অথচ ছোটদের কারণে অকারণে বকাবকী করার ব্যাপারে তারা সিদ্ধ হস্ত বা বলা যায় এটা তাদের বাঁ হাতের ব্যাপার। স্কুল জীবনে প্রথম স্কুল পালালাম। জানতাম হেডস্যার বাসায় ফোন করবে।
সেই বদৌলতে বাসায় সবাই জানতে পারবে। স্কুল পালানোর মজাটা বোধহয় এখানেই। আমি ওদের যাবতীয় মন্তব্য এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিই। না হলে এমনি এমনিতো এতসব শব্দের ভীড় ঠেলে মোবাইল ফোনের আওয়াজ আমার কানের পর্দা কাঁপাচ্ছে না ? বড় ভাইয়ের বকা উপেক্ষা করে ফোন রিসিভ করলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মেঝদি বলছেন, কী খবর ছোট ?
-খুব একটা ভাল নয়।
আমার উপর শব্দ দুষণের ব্যবহারিক করা হচেছ।
-কেন ? কি করলি আবার ?
-আজ স্কুল পালিয়েছিলাম। তারই আক্কেল সেলামি দিতে হচ্ছে। তুমি ফোন করে বাঁচিয়েছ।
-আমি তোদের ওখানে আজ আসছি।
-সত্যি !
-এক সত্যি, দু সত্যি... তিন সত্যিটা নাই বলি। কারণ দূর্ঘঠনার খবরতো আর আমি জানিনা। ওটা বেচারার জন্যে তুলা থাক।
-ঠিক। তবে তাড়াতাড়ি চলে আসো।
নিরাসক্তভাবে ফোনে কথা বলছি দেখে বড়ভাই অপদার্থ, গোঁয়ার, বিয়াদব ইত্যাদি কমন গালি দিতে দিতে চলে গেলেন। আবারও মেঝদির বদৌলতে বেঁচে গেলাম। তাঁর প্রতি ঋনের হিসেব বেড়েই চলছে।
চারদিকে মেকি আলো ছড়িয়ে সূর্য ডুবে গেল। অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
আমি বই নিয়ে পড়তে বসলাম। মেঝদির আওয়াজ শুনে টেবিলের উপর বই রেখেই দৌড়ে মেঝদির কাছে চলে এলাম। মেঝদি আমার থুতনি ধরে আদুরে গলায় বল্লেন -
কীরে পড়ছিস তো ? নাকি বাড়ি মাথায় তুলে নিজেও নাচছিস আর অন্যদেরও নাচিয়ে চলছিস ?
-দিদি শেষ পর্যন্ত তুমিও ওই বড়দের দলে।
-না না, আমিতো তোর টীমে।
-থ্যাংক ইউ দিদি।
-কিছু খেতে দিবি নাকি সারাক্ষন বলিয়েই যাবি ?
-আমি ফ্রিজ থেকে নাস্তা বের করে খেতে দিয়ে বললাম। বড়দি তোমার জন্য বানিয়ে রেখেছে।
আমার ও মেঝদির মাঝে খুব ভাব ছিল। সময় পেলেই নিজেরা আড্ডায় মেতে উঠতাম। দিন-রাতের কোন হিসেব আমরা কষতাম না।
একবার রাতে দু’টায় মেঝদি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন ছাঁদে। কত কী যে গল্প করেছিলাম। দিদি সবসময় গল্প করার সময় ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে রাখবেনই। মিশুর ব্যাপারে মনে অনেক কথা জমে আছে। দিদিকে আজ বলতে ইচ্ছে করছে।
কিছু সাজেশন্সও দরকার। সময় দেখলাম। রাত একটা বেজে ৪৫ মিনিট। দরজা খুলে বেরুতেই দেখলাম দিদি ডাইনিং টেবিলে বসে কী যেন লিখছে। ল্যাম্পের আলোয় দিদিকে খুব খুব সুন্দর লাগছে।
তাঁর সাদা মুখের উপর ল্যাম্পের লালচে আলোর নাচানাচি তাঁর সৌন্দর্য্য আরও অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে মিশু হলে তাকেও কী এমনই সুন্দর দেখাত ? হয়তো বা দেখাত। আমাকে দেখে দিদি ইতস্তত ভাঙ্গিতে কলম রেখে ডাইরিটা বন্ধ করে দিল।
-কী লিখছিলে ?
-কিছুই না , এমনে আঁকিবুকি করছি।
-আমি আসাতে লুকালে কেন ?
-কই লুকালাম ? তোর সামনেইতো পড়ে আছে ...
ডাইরিটার দিকে তাকিয়ে খুবই অবাক হলাম।
এর মলাট দিদি নিজের মতো করে বানিয়েছেন বুঝাই যাচ্ছে। একটা মেয়ে বসে আছে। তার ছায়াই ডাইরির মলাটে আছে বাস্তব চিত্র নাই।
সে তার একহাতের উপর অন্য হাত দিয়ে কী যেন করছে ? মনে হয় কাটছে। কারণ হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত বিন্দু দিয়েই নিচের দিকে লেখা আছে “অসমাপ্ত কবিতা”।
-দিদি, আমি একটু দেখি ?
-এখন না, আমি যখন চাঁদের বুড়ী হব তখন পুরোটাই দেখিস।
-দিদির না মানে না। এতে নড়চড় হবে না। তাই আর জোরও করলাম না। তবে বাইনা ধরে বললাম।
-দিদি, আমাকে একটা ওরকম ডাইরি বানিয়ে দে না।
-এখন না, পরে একদিন এসে বানিয়ে দেব। কেমন ?
-ওকে।
-দিদি তোর সাথে কিছু কথা ছিল।
-বলে ফেল।
মিশু নামের একটা মেয়ে আমার সাথে সম্পর্ক করতে চাইছে। আমি কী করব বুঝতে পারছিনা ? মিশুর সাথে ঘঠে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার বক্তব্য শুনে দিদি মুখ টিপে টিপে হাসছেন। দিদির হাসি দেখে প্রথমবা আমার এত লজ্জ লাগছে। মুখ লাল হয়ে উঠছে।
আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছিলাম যাতে লজ্জাটা ফিকে হয়ে যায়। তখন দিদি আলতো হেঁসে বললেন- প্রেমের মরা জলে ডুবো না। আমি সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলাম। আজ নীল জোছনা হওয়ার কথা। পত্রিকায় পড়েছি।
কখনও দেখা হয়নি। আজ দেখতে হবে। জানালা খুলে দিলাম। হৃদয়ের গহীন থেকে একটি তৃপ্তির নিঃশ্বাস বেরুলো। দিদির মতো কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে।
স্কুলের রাফ খাতাটা বের করলাম। জানালার পাশে বসলাম। ভাবনারা কি পদ্যাকারে না গদ্যাকারে মালা গাঁথছে বুঝতে পারছিনা। ইচ্ছে হলো তাই পদ্যাকারেই সাজালাম। জানি এ পদ্যের মরিচ মসলাও হবে না।
তবুও কী আর করা ইচ্ছের জোর যে প্রবল থেকেও প্রবলতর। মনে হলো তাই নতুবা/ইচ্ছের প্রবল বকুনিতে/হেয়ালিপনার পশ্রয়ে কিম্বা/ ভাবনাদের অসম্ভব ঝাকুনিতে/ আজ পত্রিকা কিনলাম। /পত্রিকার এপিট ওপিট/ কলামও রিপোর্টের একুল/ওকুল সব পড়া হলো সঠিক/তবে আজ অতি নতুন/এক খবর পড়লাম।
আকাশের বুকে আজ/চাঁদ সাজিয়ে দিবে/নীল জোছনার পসরা/দেখবো তাহা কিসে/নগ্ন চোখে না দূরবীনে। /দেখছি আমি অবাক হয়ে / অতি সুন্দর এক পরী/নাচে তাহার করেছে/পাগল আখি আমার...
চার
আজ একদম ভাল লাগছেনা।
আমার ভাল লাগা-না লাগা, সুখ-দুঃখ শেয়ার করার মতো কোন মানুষ বাসায় নেই। যারা আছে সবাই হিটলার আর আমি তাদের জন্যে ইহুদী। কখনও হাসিমুখে গল্প করেনি। রুমে ডুকে টেবিল গুছাতে গিয়ে মেঝদির ডেস্কের চাবি পেলাম। আমার রুমে মেঝদির একটি ডেস্ক আছে।
ইচ্ছে হলো তার ডেস্ক খুলে কী আছে দেখবো। ভেতরে দেখি তার সেই ডাইরি। হাতে নিলাম পৃষ্টা খুলতেই চোখে পড়ল।
মন ভাল নেই। দুশ্চিন্তা,নৈরাশ্য চারপাশে ঘিরে ধরেছে।
এদের ফাঁকি দিয়ে বেরুবার জোঁ নেই। হৃদয়ের গহীনে কে যেন ছুরিকাঘাত হানছে বারংবার। বিন্দু বিন্দু করে গড়িয়ে পড়ছে রুধির। একেকটি রক্ত কণিকা যেন বের করে আনছে বুকের জমানো ব্যাথার অগনিত নুড়ি। আগে যে কোন ব্যাথায় অঝোরে কাঁদতাম।
এখন জঘন্য ব্যাথায়ও চোখের কোণে অশ্রু বিন্দুর দেখা মেলেনা। অযুত আঘাতে জর্জরিত নয়নে শুধু নিরব বেদনা। মাঝে মাঝে বিষন্ন মনে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে আত্মহননের প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু মায়াপুরীর মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ি প্রতিনিয়ত। ভাগ্যের উপর জীবনের ঘানি টানার ভার দিতে গিয়েও দিতে অপারগ।
শুধু দুর্বলরাই ভাগ্যের উপর সব কিছু ছেড়ে দেয়। আমি দুর্বল নই, নই অসহায়। প্রভু আমাকে অন্যসবার মতো সব কিছু দিয়েছে। সাহসিকতার জ্বলন্ত অঙ্গারের স্তুপ আমার মন। তাই ভাগ্যটা নিজেই গড়ে নিই নিজের আদলে...
পড়লাম কিন্তু বুঝলাম না।
আরো পৃষ্টা উল্টালাম। তার ডাইরিতে লেখা সবকিছুর শিরোনাম লাল রঙের। “বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা” নামের একটা লেখা পড়া শুরু করলাম।
মায়ের কোলে যখর ছিলাম তখন দুঃখ, কষ্ট বলতে কিছুই ছিলনা। অথচ মায়ের সামান্য বকুনি, দুষ্টুমির জন্য কয়েকটা চড় এগুলোকে চরম দুঃখ মনে করতাম।
বাস্তবে বায়ুর অথৈ সাগরে ডুবে থেকেও যেমন আমরা বায়ুর মর্যাদা উপলদ্ধি করতে পারিনা, তেমনি মায়ের ¯েœহের ডোরে থেকেও সেই ¯েœহকে আঁচ করতে পারতাম না। এখন তা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি।
এক রাতের ঘটনা। নৈ:শব্দের রাজত্ব চলছিলো পৃথিবীময়। আমি বেঘোর ঘুম।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠি। সামনে দাঁড়িয়ে মেঝদা রাগে দাঁড়সাপের মতো ফুঁসছে। আর মাকে বলছে-ওর মতো বোন আমার লাগবেনা। এরকম বোনদের কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলে কারও কোন ক্ষতি হবেনা। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।
একক্ষনে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমাকে টেনে চকি থেকে মাটিতে নামানে হয়েছে তা বুঝলাম। নামিয়েছে তপন তথা মেঝদা। আমার এক কি দেড় বছরের বড়। হাঁক ছেড়ে বলল
-আজ রাতে তুই কোন ছেলের সাথে দেখা করেছিস ?
-মানে ?
-মানে আবার কী? বলেই আমার গালে খুব জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
আমি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম। চোখ দিয়ে পানি এসে গেছে।
- আমি তো রুমে বসে পড়ছিলাম।
-মিথ্যে বলিস না। সত্যি করে বল।
-মিথ্যে বলছিনা। আপনি আমার ক্ল্যাসমিটদের জিজ্ঞেস করেন।
“আমি তুর চাকর নাকি?” বলে আমার তলপেটে প্রচন্ড বেগে লাথি মারল। আমি ছিটকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম। আমি হা করে মেঝদার দিকে তাকিয়ে আছি।
তাঁকে দেখতে হায়েনার মতো লাগছে। আমি অঝোরে কেঁেদ উঠলাম। মা দৌড়ে এসে আমাকে নিয়ে অন্য রুমে ঢুকে ভেতর থেকে নক করে দিলেন। মা আমাকে খাঁটে বাসিয়ে দিতেই ব্যাথায় শরীর শিরশির করে উঠল। বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছি।
যখন আমাকে মেরেছিল তখন আমার বয়স ১৮ ছুইঁ ছুঁই। বিয়ের বয়স। ঐ. ঝ. ঈ পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আজও আমি আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরাধের সত্যতা পাইনি। ক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।