‘বলেছিলে- ঝুম বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি মনের অস্থিরতা কমে যায়। বলেছিলে- শহর থেকে দূরে, নিরব জনপদের বুক চিরে বয়ে চলা যৌবনা কোন নদীর বুকে ব্রীজের উপর ছাতা মাথায় একাকী দাঁড়িয়ে যদি রিমঝিম বৃষ্টির ছন্দের সাথে বয়ে চলা নদীর মিতালী দেখা যায়, হৃদয়ে জমাট সকল বেদনা বহতা নদীর স্রোতের সাথে মিশে চলে যায় কোন এক দূর অলকায়। আমার কিশোরী মন তোমার এসব জাদুকরী কথার মোহে কতটা আবিষ্ট হতো তা কি তুমি বুঝতে? কেন এসব মিথ্যে শুনিয়ে ছিলে আমায়? কেন? যেদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- সোনা, আকাশ এত নীল কেন? সেদিনও মিথ্যে বলেছিলে। বলেছিলে- মানুষের মনের কষ্টগুলো ধার নিতে নিতে আকাশ এমন নীল হয়েছে। আরো জানতে চেয়েছিলাম, আকাশ কি কখনো ধার করা কষ্টগুলো ফেরৎ দিয়ে দেয়? তুমি বলেছিলে- না।
দেয় না। ফেরৎ দিলে তো আর আকাশ নীল থাকতো না! তা হয়ে যেত অন্য কোন রঙের। কেন এভাবে মিথ্যে বলেছিলে আমায়? আকাশ কেন তবে আমার কষ্টগুলো ফেরৎ দিয়ে দিল ..?’
প্রায় একবছর পর নদীর অভিযোগ মাখা চিঠিটা আমার হাতে এলো আজ। এক ছটফটানো ভালোবাসার অপমৃত্যুর স্মৃতির দহনে নষ্টালজিক হয়ে উঠি আমি। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে দেখি তিনশ’টা দিন।
শিউরে উঠি আমি! তিনশ’টা দিন! কি অসম্ভব ব্যাপার! অথচ কি নিদারুণ অমানবিকতায় সম্ভব হয়ে গেল! কথা ছিল এক মাস পর আবার দেখা হবে। কিন্তু হয়নি। সে দেখা আজো হয়নি!
অথচ, এখনো আমার খুব ইচ্ছে করে ওকে দেখতে। খুব। খু-উ-ব।
মরুভুমির মরিচীকার ধাঁধাঁয় কান্ত পথিকের যেমন স্বচ্ছতোয়া ঝিরিঝিরি বয়ে চলা নহরের জলপানের অপার তৃষ্ণা জাগে বুকে, ঠিক সে রকম। এক নিদারুণ নিঃসঙ্গতা আমাকে পেয়ে বসে। পুরাতন চিঠিগুলো বড়ো বেশী আপন হয়ে উঠে। একটা সময় খুব চিঠি লিখতাম ওকে। খুব।
মনের কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারতাম কেবল চিঠিতেই। চিঠির পরতে পরতে জড়ানো থাকতো বিন্দু বিন্দু ভালোলাগার অভিব্যক্তি। সিন্ধুসম ভালোবাসার কথকতা। স্বপ্নবাজ হৃদয়ে স্বপ্নমাখা কথার ফুলঝুরি। বিশাল আকাশ, অথৈ সাগর, ঝুম বৃষ্টি, বুনো কাশফুলের বিপুল বিথার, কিছুই বাদ যেত না।
নদীও আমাকে চিঠি লিখতো বেশ। ছন্দময় আর স্বপ্নময় ওর এক একটি চিঠি ছিল আমার কাছে বসন্তের বাতাস। হাসনাহেনার মাতাল গন্ধ। আর জোছনা স্নাত মায়াবী রাতের আহ্বানের মত। আমি কেবলই মুগ্ধ হতাম ওর রূপের নকশার মতো তন্বী ফর্সা হাতের নিপুণ বুননে গাঁথা চিঠিতে শব্দের কারুকাজ দেখে।
মাত্র হাইস্কুলের গন্ডি পেরুনো এক কিশোরী কিভাবে এত সুন্দর শব্দশৈলী নির্মাণ করতো আমি বুঝতে পারতাম না। শুধু মুগ্ধ হতাম। আবিষ্ট হতাম। আর অপার ভালোলাগায় ডুবে যেতাম ওর ভাবনায়।
এক ঝুপুস বৃষ্টির বিকেলে ও এসেছিলো আমার ছোঁয়ায়।
অভিসারে। একাকি। চুপিসারে। সেদিন মাতালের মত ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আর পরম বিস্ময়ে আবিস্কার করলাম স্বর্গের সুখ এসে জড়ো হতে লাগল আমার হৃদয়ের আঙ্গিনায়।
এ সুখের বর্ণনা দেয়ার মত ভাষা আমার নেই। এ যে কেবলই উপলব্দী করার বিষয়। সেদিনই প্রথম কোন মেয়েকে এভাবে স্পর্শ করা। দু’হাতে ওর মুখটা উঁচু করি ধরি। ভীরু কম্পমান ওর চোখের পাপড়িতে ফুঁ দিই।
বেশ চমকে উঠেছিলাম আমি। তবে চমকানোটা নদী টের পেল না। বুকের ভেতর কাঁপুনিটা দ্রুতলয়ে ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো। ও বললো একটা কথা বলি? আমি স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম- বলো। ও বলল- তোমার জন্য এত কষ্ট হয় কেন আমার ..?! কথাটা বলে ও চোখ দু’টি নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে।
আমি কি জবাব দেব বুঝতে পারি না। শুধু চুমু এঁকে দেই ওর গভীর দু’চোখের পাতায়। ও কেঁপে কেঁপে ওঠে। পরম মমতায় আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি না এ কান্না কিসের।
ভয়ের, না ভালোলাগার! কান্না থামলে ওর মায়াবী মুুখটা উঁচু করে ধরি। অশ্র“ধোয়া চোখে ভয় মিশ্রিত লজ্জায় আভা ওকে যেন স্বর্গের কোন অপ্সরীর রূপ দান করে। ওর সাগর চোখে চোখ রেখে বলি- চাঁদ চেহারা তোমার প্রিয়া, আঁখি দুটি গড়া বিজলী দিয়া। ঐ চোখের চাহনিতে, সাধ হয় মরে যেতে! ও আবারো কান্না শুরু করে। পরম ভালোবাসায় বিগলিত আমি ওকে বুকে চেপে রাখি কিছুক্খণ।
যাওয়ার সময় ও বললো- আগামী মাসে দেখা হবে। এর মধ্যে চিঠিতে যোগাযোগ হবে। সম্ভব হলে ফোনেও।
সেদিন থেকে আমি ভুলে গেলাম নাওয়া খাওয়া। ভুলে গেলাম নিদ।
মনের গহীনে শুরু হল উথাল পাথাল স্বপ্নের কারুকাজ। স্নিগ্ধ সকাল, কান্ত দুপুর, একাকি বিকেল, রক্তিম গোধুলী, নিকষ আঁধার কিংবা নীল জোছনা , কোন কিছুই আমাকে ওর ভাবনা থেকে দূরে রাখতে পারেনি। কেবলই আক্রান্ত হই ওর ভাবনায়। কি যে হারালাম! কি যে হারালাম! এমন অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সারাণ। আমি আকাশকে বলি- তোমার চেয়ে আমার প্রিয়া অনেক উদার! সাগরকে বলি- তোমার চেয়ে আমার প্রিয়ার বুকে অনেক বেশী প্রশান্তি! ঝর্ণাকে বলি- আমার প্রেয়সী তোমার চাইতে অনেক অনেক লাস্যি! তোমার ছন্দের চেয়ে আমার সোনাবউ’র হাসি আরো বেশী ছন্দময়! সকালের সতেজ গোলাপের কানে কানে বলি, তোমার সুগন্ধির চেয়ে আমার মানসীর গায়ের ঘ্রাণ বহু বেশী সুরভিত! অনেক বেশী মাতাল করা!
অবিশ্বাস্য এক ভালোলাগার ঘোরে আমি ওকে আকাশের অপার নীলে নীলাম্বরী সাজাই।
হৃদয়ের তুলিতে আঁকি স্বপ্নালোকের দেবী সাজিয়ে। স্বপ্ন বুনি বহতা নদীর বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে চলা গাঙচিলের ডানায়। স্বপ্ন আঁকি সবুজ বাদাড়ের গা ঘেঁষে নেচে নেচে যাওয়া প্রজাপতির রঙিন পাখায়। আর রাতের আকাশে তারার খুনসুটি দেখে বলি- আমার প্রিয়া যখন অভিসারে আসবে, চাঁদ যদি লুকিয়ে যায় আমার প্রিয়ার রূপ দেখে, তোমরা তখন জ্বলজ্বল করে মিটিমিটি আলো দিয়ে ওকে বরণ করতে ভুলো না যেন! কার্পণ্য যেন হয় না কোথাও! বাতাসকে বলি- আমার মানসীকে বরণ করে নিতে স্বর্গের জানালা হয়ে মর্তে এসো তোমরা। পাখ পাখালির দলকে বলিÑ তোমরা যেন গাইতে ভুলোনা সখির আগমনে!
কিন্তু না, সে আসেনি! পলাতক স্বপ্নের যন্ত্রণায় ডুবিয়ে গেছে আমাকে।
কেড়ে নিয়ে গেছে আমার এক আকাশ নীল জোছনা। সাগর ভেবে আমার নদী ছুটে গেছে মোটা পকেটওয়ালা এক টাকার কুমীরের কাছে। শুধু আমি পড়ে রইলাম একা, শুন্য বালুচরে ঘেরা এক মৌনমুখর পৃথিবীর আঁধারে...!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।