কিন্তু যখনই তিনি নিজের সত্তার সন্ধান করেন, খুঁজে নিতে চান নিজস্ব সুখ, সম্মান, স্বাধীনতা সেই মুহূর্তে যেন মিথ্যে হয়ে যায় সব। শাশুড়ি ভুলে যান তার এতদিনের সেবা, সন্তানরা অস্বীকার করে স্নেহ,স্বামীর কাছে মূল্যহীন হয়ে যায় তার প্রেম, আত্মীয়স্বজনরাও বিস্মৃত হয় তার সৌজন্য।
যতক্ষণ নারী অছে সমাজ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া ছকের ভেতর ততক্ষণই তার মূল্য। একটু বেপথু হয়ে পড়লেই সে পরিত্যাজ্য। তার নিজের আপন সত্তা বলতে কি তাহলে কিছু নেই? এই প্রশ্ন নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘পরমা’।
অপর্ণা সেন পরিচালিত ও নাম ভূমিকায় রাখী অভিনীত এক অসাধারণ সৃষ্টি। নারীর আপন পরিচয় সন্ধানকারী চলচ্চিত্র।
কানু বিনা যেমন গীত নেই, তেমনি নারী ছাড়াও চলচ্চিত্র অতি বিরল। হলিউড, বলিউডই হোক আর হোক বাংলা ভাষায় নির্মিত ছবি। নারীকে কেমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে? চলচ্চিত্রে নারী হয়েছে পুরুষের প্রেমিকা, স্ত্রী, মা, বোন, মেয়ে অথবা যৌন আবেদনের প্রতীক।
সে হাস্যময়ী, লাস্যময়ী, প্রেমময়ী, স্নেহময়ী অথবা খলনায়কের সহযোগী হিসেবে ক্রুর ও খল। কখনও বিমাতা, শাশুড়ি, ননদ, ভাবী বা অন্য কোনো রূপে নির্যাতনকারী।
আবার অনেক সময় নারী হয়েছে নির্যাতনের শিকার, পুরুষের আশ্রয় প্রার্থী। কিন্তু সমাজ সংসার নির্ধারিত ল²ণরেখার বাইরে নারীর নিজস্ব পরিচয় কতখানি উঠে এসেছে রূপালি পর্দায়? হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে নারীর নিজস্ব ভুবন।
বলিউড পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতার ধারক একটি ইন্ডাস্ট্রি ।
এখানে নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রদর্শনের সামগ্রী বা ‘এক্সিবিট’। চলচ্চিত্রের পর্দায় নারী চরিত্রের মাধ্যমে এখানে মূলত প্রতিফলিত হয় পুরুষের কামনা-বাসনা। তুষার ঢাকা হিমশীতল পরিবেশেও তাই বলিউডি নারীকে দেখা যায় ফিনফিনে জর্জেট শাড়িতে নাচতে আর গাইতে। বলিউডি নায়িকাদের খেতাবও তাই ‘ড্রিম গার্ল’, ‘বেবি ডল’। তারা পুরুষের হাতের পুতুল।
তারা পুরুষের মন ভোলাতে নাচে, গায়। আইটেম সংয়ে তারা হয়ে ওঠে লাস্যময়ী। তারা তাই নিখুঁত ‘জিরো ফিগারের’ অধিকারী। সিনেমার পর্দায় তারা শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক যে পেশাতেই থাকুন না কেন তাদের পেশাগত নিজস্ব টানাপড়েন, চিন্তাভাবনা, সংগ্রাম খুব কমই প্রতিফলিত হয়। তাদের মনোজগতের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে একজন পুরুষ।
সে পুরুষ প্রেমিক, স্বামী, বাবা, ভাই যে কেউ হতে পারে। তারা সনাতন ধ্যানধারণার আধুনিক ধারক। তাদের শেষ আশ্রয় কোনো না কোনো পুরুষের কাছে। এহেন বলিউডেও নির্মিত হয়েছে এমন কিছু চলচ্চিত্র, যা সনাতন পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিপরীতে নারীকে চিত্রিত করেছে ভিন্নমাত্রায়, স্বকীয় দীপ্তিতে উজ্জ্বল করে।
এমনি একটি চলচ্চিত্র ‘লজ্জা’।
রাজকুমার সান্তোষী পরিচালিত এ সিনেমাটি বিকল্পধারার নয়। মূলধারার এ ছবিতে ছিলেন মাধুরী দীক্ষিত, মনীষা কৈরালা, রেখা, জ্যাকি শ্রফ, অনীল কাপুর। গল্পটি যদিও গতানুগতিক নয়। স্বামীর নির্যাতনে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন প্রবাসী মৈথিলী (মনীষা)। ভারতে এসে বিভিন্নস্থানে পালিয়ে বেড়ান তিনি।
পরিচয় হয় যাত্রাশিল্পী জানকীর (মাধুরী) সঙ্গে। আরও পরিচয় হয় ধাত্রী রামপিয়ারীর (রেখা) সঙ্গে। সমাজের সর্বস্তরেই নারী যে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এখানে। প্রতিটি প্রধান চরিত্রেরই নাম সীতার কোনো না কোনো নাম অনুসারে।
রাজকুমার সন্তোষীরই আরেকটি সিনেমা ‘দামিনী’।
মীনাক্ষী শেষাদ্রি, সানি দেওল ও ঋষি কাপুর অভিনীত এই সিনেমায় দেখা যায় কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী গৃহবধূ দামিনীকে (মীনাক্ষী) প্রভাবশালী শ্বশুর ও পরিবারের অন্য সদস্যরা পাগল প্রতিপন্ন করে। এবং শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে জয়ী হন দামিনী।
কল্পনা লাজমি পরিচালিত ও ডিম্পল কাবাডিয়া অভিনীত ‘রুদালি’ একটি অসাধারণ সিনেমা। রাজস্থানের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে ‘রুদালি’র কাহিনি। এই ছবির একটি অসাধারণ দিক হল, শত বঞ্চনা ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রান্তিক অবস্থানের নারী সঞ্চারির (ডিম্পল) চোখে কোনো অশ্রু নেই।
রাজস্থানের মরুভূমির মতোই এই নারীর জীবনে কোথাও কোনো আশার কোমলতা নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ অবলম্বনে অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘ইতি মৃণালিনী’ নারীবাদী চলচ্চিত্র। মেজবউ মৃণালিনী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। পারিবারিকভাবে নারীর উপর সংঘটিত বৈষম্য ও নির্যাতনগুলোকে চিহ্নিত করেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, মৃণাল সেনের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, প্রভাত রায়ের ‘শ্বেত পাথরের থালা’ নারীর জীবনযুদ্ধকে তুলে ধরা চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী হিসেবে প্রচুর নারী কাজ করলেও পরিচালক পেশায় নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় নগণ্য। ক্যামেরার পিছনে যখন থাকেন একজন নারী তখন নারীর জীবন একটু অন্যভাবেই উঠে আসে পর্দায়। যেমন অপর্ণা সেন, দীপা মেহতা বা কল্পনা লাজমির চলচ্চিত্রে উঠে আসা নারীর জীবন।
দীপা মেহতা পরিচালিত চলচ্চিত্রে নারীর জীবনযন্ত্রণার ইতিবৃত্ত উঠে আসে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। তার ত্রিলজি ‘আর্থ’ (পৃথিবী), ‘ওয়াটার’ (পানি) এবং ‘ফায়ার’ (আগুন) তিনটি চলচ্চিত্রই নারীর আন্তর্জীবনকেন্দ্রিক।
পর্দায় সমকামিতা দেখানোর জন্য ‘ফায়ার’ ব্যাপক সমালোচিত হয়। ‘ওয়াটার’ সিনেমায় উঠে এসেছে কাশির আশ্রমে নির্বাসিত বিধবা নারীর অমানবিক জীবন। আঠার ও উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি বিধবা নারীকে পাঠিয়ে দেওয়া হত পরিবার থেকে দূরে কাশিতে। সেখানে আশ্রমে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যেত অসংখ্য নারীর জীবন, জীবনের আশা, আকাক্সক্ষা, কামনা, বাসনা সবকিছুই। বাল্যবিধবা নারীর উপর চলত নিপীড়ন-- শারীরিক ও মানসিক।
‘আথ’ সিনেমার প্রেক্ষাপট ৪৭-এর দেশবিভাগ। সেখানে পোলিও আক্রান্ত এক কিশোরীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় সমাজকে।
‘আর্থ’ বলতেই মনে পড়ে গেল মহেশ ভাটের ‘আর্থ’ সিনেমাটির কথা। এই ‘আর্থ’ অবশ্য হিন্দি শব্দ থেকে। বিবাহিত জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা থেকে এই চলচ্চিত্রের কাহিনি গড়ে উঠেছে।
শাবানা আজমি, কুলভূষণ খারবান্দা এবং স্মিতা পাতিল অভিনীত চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে সুন্দর অংশ হল এর সমাপ্তি। পুরুষের প্রেম ছাড়াও নারীর জীবন সার্থক হতে পারে বা চলতে পারে সেটির উপলব্ধি অন্য ধরনের মুক্তির সন্ধান দেয় পূজাকে (শাবানা আজমি)। স্বামী ইন্দোর অন্য নারীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করায় ভেঙে পড়েছিল গৃহবধূ পূজা। পরবর্তীতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রাম তাকে দেয় আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে চিত্রাভিনেত্রী কবিতা (স্মিতা পাতিল) মনে করেছিল ইন্দোরের (কুলভূষণ খারবান্দা) ভালোবাসা তাকে দেবে নির্ভরতা।
কিন্তু এক পর্যায়ে কবিতা বুঝতে পারে যে পুরুষ তার বিবাহিত স্ত্রীকে অত সহজে ত্যাগ করতে পারে তার কাছে নির্ভরতা পাওয়ার আশা বৃথা।
আরেকটি নারীবাদী সিনেমা মহেশ মাঞ্জরেকার পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’। টাবু, শচিন খেড়েকার এবং মেহনিশ বেহল অভিনীত এই সিনেমার কাহিনিতেও পরমার মতো নারীর অস্তিত্ব সংকটকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সনাতন চিন্তাধারার অনুসারী শ্রীকান্ত পণ্ডিত (শচিন খেড়েকার) একজন ব্যস্ত মানুষ। স্ত্রী অদিতিকে (টাবু) তেমন সময় দিতে পারে না সে।
তবে সে ভালোবাসে অদিতিকে নিবেদিত স্ত্রী হিসেবে। একাকিত্বের যন্ত্রণায় অদিতি এক পর্যায়ে ক্ষণিকের ভালো লাগায় জড়িয়ে পড়ে অনিকেতের (মেহনিশ বেহল) সঙ্গে। এই ঘটনার পঁচিশ বছর পর একদিন শ্রীকান্ত আবিষ্কার করে স্ত্রীর সেই প্রেমের ইতিহাস। পঁচিশ বছর আগের সেই ক্ষণিক ভালো লাগার দোষে মিথ্যে হয়ে যায় স্ত্রী ও মা হিসেবে অদিতির সব আত্মত্যাগ। তবে শেষ পর্যন্ত ছেলের প্রেমিকা এসে দাঁড়ায় তার পাশে।
নারীর প্রতি সহানুভূতি নিয়ে যে অন্য নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে সেটাই উপসংহারের বক্তব্য।
বলিউডের মূলধারার চলচ্চিত্রে সুনীল দত্ত পরিচালিত নার্গিস অভিনীত ‘মাদার ইন্ডিয়া’, তটিনেনি রামা রাও পরিচালিত রেখা অভিনীত ‘জীবনধারা’, প্রকাশ ঝা পরিচালিত মাধুরী অভিনীত ‘মৃত্যুদণ্ড’, প্রীতি জিনতা অভিনীত ‘কেয়া কেহেনা’, মাধুর ভান্ডারকার পরিচালিত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত ‘ফ্যাশন’, মাধুর ভান্ডারকার পরিচালিত টাবু অভিনীত ‘চাঁদনি বার’, শেখর কাপুর পরিচালিত সীমা বিশ্বাস অভিনীত ‘ব্যান্ডিট কুইন’কে নারীবাদী সিনেমা বলা যায়।
২০০২ সালে গুরিন্দর চাঢা পরিচালিত ব্রিটিশ-জার্মান কমেডি ফিল্ম ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহাম’কে ঠিক নারীবাদী সিনেমা না বলা গেলেও এটি নিঃসন্দেহে নারীর কিছু অধিকারকে তুলে ধরেছে। লন্ডনে বসবাসরত একটি শিখ পরিবারের মেয়ে ফুটবলার হতে চাইলে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তার পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়।
সে ফুটবলার হওয়ার পথে পা বাড়ায়। নারীর নিজস্ব অভিরুচি অনুযায়ী যে কোনো পেশা বেছে নেওয়ার অধিকার প্রতিফলিত হয়েছে এতে।
আরেকটি ব্রিটিশ সিনেমা নারীর উপর সংঘটিত ভয়াবহ পারিবারিক নির্যাতনকে তুলে ধরেছে। সিনেমাটির নাম ‘প্রভোকড’। জগ মুনধ্রা পরিচালিত এ সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঐশ্বরিয়া রাই।
সিনেমায় দেখা যায় পাঞ্জাবি মেয়ে কিরণের (ঐশ্বরিয়া) বিয়ে হয় ব্রিটেন প্রবাসী ভারতীয় দীপকের (নবীন এনড্রুজ) সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে ব্রিটেনে চলে আসে কিরণ। তারপর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় দীপকের আসল চেহারা। দশ বছর ধরে স্বামীর হাতে ক্রমাগত শারীরিক মানসিক নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার কিরণ এক পর্যায়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে দীপককে হত্যা করতে বাধ্য হয়। সিনেমাটি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত।
হলিউডেও পুরুষ প্রধান্য রয়েছে বলাই বাহুল্য। এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে হলিউডি মুভিতে পুরুষ চরিত্রকে যতক্ষণ পর্দায় দেখা যায় নারীকে ততক্ষণ নয়। নির্মাতা হিসেবেও এখানে পুরুষেরই একচেটিয়া প্রাধান্য। এর মধ্যেও নারী নির্মাতারা কাজ করছেন। নারী পরিচালকের অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘ফ্রোজেন’ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বক্স অফিসে এবং অস্কারও পেয়েছে।
‘উইমেন ফিল্ম’ বলে হলিউডে চলচ্চিত্রের যে ধারা রয়েছে তার কথা এখানে বলা হচ্ছে না। কারণ এই ধরনের উইমেন ফিল্মের অনেকগুলোই আবার নারীকেন্দ্রিক হলেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই ধারক। ‘জেজেবেল’, ‘মাইল্ড রেড পিয়ার্স’ ইত্যাদি এ ধারার চলচ্চিত্র। এসব সিনেমায় নারীর যে আত্মত্যাগকে তুলে ধরা হয়, তা প্রকৃত পক্ষে সমাজের প্রার্থিত আত্মত্যাগ। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর কাছে যে আত্মত্যাগ প্রত্যাশা করে মূলত তাই এখানে তুলে ধরা হয়।
‘উইমেন ফিল্ম’-এ অনেক সময় দুই ধরনের নারীকে চিত্রায়িত করা হয়। একজন নম্ব, ভদ্র, সরল। আরেকজন চতুর, বেপরোয়া বা খল। ‘ভালো’ নারী শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় সব দুঃখকষ্ট সহ্য করে। আর ‘খারাপ’ নারী শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়।
তার মানে সেই চিরন্তন লিলিয়ান ও ইভের কাহিনি।
পুরাণের লিলিয়ান অ্যাডামের অধীনতা স্বীকার করেনি বলে সে হয় অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। আর পোষমানা ইভ বশ্যতা স্বীকার করেছিল বলে সে হয় পুরুষের চিরদিনের সঙ্গিনী। আবার অনেক সময় নারীর সিজোফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া বা অন্য কোনো মানসিক অসুখকে তুলে ধরে যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেগুলোকেও উইমেন ফিল্ম বলা হয়েছে। আবার কিছু সংখ্যক উইমেন ফিল্ম এ দেখানো হয়েছে গতানুগতিক জীবন থেকে পালিয়ে অন্য কোনো দেশে চলে যায় একজন নারী।
সেখানে রীতিনীতি থেকে মুক্ত হয়ে জীবন যাপন করে সে। যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরতেই হয়ে তার নিজের সমাজে।
তবে হলিউডেও নির্মিত হয়েছে নারীর জীবন যুদ্ধকে তুলে ধরা সিনেমা এবং অনেক সিনেমায় নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে।
এমনি একটি সিনেমা ‘অ্যাকিউসড’। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য জোডি ফস্টার অস্কার পেয়েছিলেন।
সিনেমায় গণধর্ষণের শিকার এক নারীর চরিত্রে রূপদান করেন জোডি ফস্টার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে ধর্ষণের শিকার নারীকেই পরোক্ষভাবে দায়ী করে এই অপরাধের জন্য তা সূ²ভাবে তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
আমেরিকার নারীবাদী সিনেমার মধ্যে ‘বিয়ন্ড বিলিফ’, ‘সিডো’, ‘দ্য লাইফ আই গট টু লিভ’, ‘পিস ভার্সেস পিস: ওমেন অন দ্য ফ্রন্টলাইন’, ‘রিগ্রেট টু ইনফর্ম’ কয়েকটি তথ্যচিত্র যা প্রত্যেকের দেখা প্রয়োজন। এই বিকল্পধারার চলচ্চিত্রগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নারীর উপর সংঘটিত বৈষম্য ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত আরেকটি বিকল্পধারার চলচ্চিত্র হলো ‘হোয়াইট রেইনবো’।
ধরন মান্দ্রায়ার পরিচালিত ও লিন্ডা মান্দ্রায়ার প্রযোজিত আমেরিকায় নির্মিত সিনেমাটিতে দেখানো হয় ভারতীয় বিধবাদের জীবন।
নারীর ভোটাধিকার আদায়ের যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আয়রন জড অ্যানজেলস’ সার্থকভাবে নারীর সংগ্রামকে তুলে ধরেছে।
২০০৪ সালে নির্মিত কাটজা ভন গার্নিয়ের পরিচালিত এ ছবিতে সাফ্রোজেট আন্দোলনকে তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশে মূলধারার সিনেমাজগৎ মূলত পুরুষ শাসিত। সত্তর ও আশির দশকে যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হয়েছে তার অধিকাংশতেই নারীকে মূলত চারভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
প্রথমত, প্রেমিকা নারী। যার নায়কের সঙ্গে প্রেম করা ছাড়া এবং ভিলেইন কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ‘বাঁচাও’ বলা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই। দ্বিতীয়ত, গৃহবধূ নারী। যিনি স্বামীর হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করলেও তাকে পা ধরে সালাম করেন কারণ স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত এবং পতি পরম দেবতা। এই নারী গৃহলক্ষ্মী।
তিনি যদি আইন বা চিকিৎসা বা শিক্ষকতা পেশাতেও থাকেন তাহলেও তার পেশাগত কোনো টানাপড়েন নেই। বরং স্বামী, সন্তান সংসার ও পরিবার তার ধ্যানজ্ঞান। আরেক নারীও গার্হস্থ্য। তবে তিনি অত্যাচারী। দজ্জাল বিমাতা, শাশুড়ি, ননদ, ভাবী বা এমনি কোনো সাংসারিক সম্বন্ধে আবদ্ধ এই নারী নায়ক নায়িকা বা অন্য চরিত্রদের উপর প্রবল নির্যাতন করে।
চতুর্থত এবং মূলত, এই নারী যৌন আবেদনের প্রতীক। সে নর্তকী, ভিলেইনের সহযোগী, ধর্ষণের শিকার বা অন্য কোনোরূপে পুরুষের অবদমিত বাসনার পরিতৃপ্তিকারী। সিনেমার পোস্টারে আবেদনময়ী এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌন অবয়বরূপে প্রদর্শনকরা হয়েছে নারীকে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অর্থায়নে নারীর উপর সংঘটিত বৈষম্য ও নির্যাতনকে কেন্দ্র করে অনেক তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। তবে এগুলোকে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে ধরা যায়।
মূলধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্রে নারীর অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে। এমনি একটি চলচ্চিত্র হল ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। তৃণমূলের শ্রমজীবী নারীর জীবন চিত্রায়িত হয়েছে ববিতা অভিনীত এই চলচ্চিত্রে।
প্রয়াত ডলি আনোয়ার অভিনীত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ (১৯৭৯) নারীবাদী চলচ্চিত্র। তৃণমূল পর্যায়ের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা তালাকপ্রাপ্ত জয়গুন (ডলি আনোয়ার) তার সন্তানদের নিয়ে জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত।
তার ছোট সন্তানকে আটকে রাখে স্বামী, যেহেতু সে ছেলে সন্তান। ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য জয়গুনের প্রচেষ্টা, বেদনা, আর্থিক অনটন-- নারীর জীবনের সংগ্রাম সেই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কষাঘাত এই ছবির বিষয়বস্তু। মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ বাংলাদেশের অন্যতম ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাংলাদেশের নারীর জীবনসংগ্রামকে রূপায়িত করা চলচ্চিত্রের মধ্যে মহসিন পরিচালিত ‘বাঁদী থেকে বেগম’, আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘সুন্দরী’, আলমগীর কবির পরিচালিত ‘সীমানা পেরিয়ে’ ও ‘সূর্যকন্যা’, আখতারুজ্জামান পরিচালিত ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতি’, সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড পরিচালিত ‘নাচোলের রানী’, বাদল খন্দকার পরিচালিত ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, নার্গিস আক্তার পরিচালিত ‘মেঘলা আকাশ’ অন্যতম।
১৯৭০ সাল থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক জন দুজন করে নারী পরিচালক এসেছেন।
রেবেকা, রোজী(সামাদ) আফসারী, সুচন্দা, নার্গিস আক্তার, সামিয়া জামান, জাহানারা নূরী, ক্যাথরিন মাসুদ,শামীম আখতারসহ বেশ কয়েকজন নারী বাংলাদেশে চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন বা করছেন। হয়তো আগামীতে তাদের হাতে বা অন্য কারও হাতে নির্মিত হবে নারীর অধিকারকে তুলে ধরা শিল্পসার্থক চলচ্চিত্র।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।