দেবতা এপোলোর পবিত্র বৃক্ষ হচ্ছে লরেল বৃক্ষ। লরেল কীভাবে এপোলোর কাছে পবিত্র হলো, সে সম্পর্কে রোমান লেখক ওভিদ আমাদেরকে এক প্রেমের গল্প বলেছেন। তাই এই গল্পের দেব-দেবীদের নাম সব রোমান। এই গল্পের মূল নারী চরিত্রে যিনি ছিলেন, তার নাম ছিল ডাফনি। বলা হয়ে থাকে, ডাফনি ছিলেন দেবতা এপোলোর প্রথম প্রেমিকা।
ডাফনি ছিলেন নদী দেবতা পিনিউসের কন্যা। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা এক নারী শিকারি। দেবী ডায়ানার (গ্রীক- আর্টেমিস) মতোই তিনি প্রেম ও বিয়ে প্রথাকে ঘৃণা করতেন। যত সুদর্শন তরুণ তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, তিনি তাদের সবাইকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পিনিউস খুব কষ্ট পেতেন এতে।
জিজ্ঞাসা করতেন, তিনি কি কখনো নাতী-নাতনীদের চেহারা দেখতে পারবেন না? ডাফনি মৃদু হাসতেন, হারিয়ে যেতেন গভীর অরণ্যে, যেখানে খুঁজে ফিরতেন প্রশান্তি আর অবাধ স্বাধীনতা। হারিয়ে যাওয়ার আগে বলে যেতেন, “আমাকে ডায়ানার (আর্টেমিস) মতো থাকতে দাও”।
প্রাচীন অলিম্পিক খেলার প্রচলন-কারী হিসেবে পেলোপসের নাম বলা হয়ে থাকে। পেলোপসের স্ত্রীর নাম ছিলো হিপ্পোডামিয়া, যার বাবা ছিলেন পিসার রাজা ওনোমাউস। ওনোমাউসের এক ছেলে ছিলো- লিউসিপ্পাস।
একবার এই লিউসিপ্পাস ডাফনির প্রেমে পড়লেন। কিন্তু তিনি জানতেন, ডাফনি পুরুষদের পছন্দ করেন না, তাই লিউসিপ্পাস ঠিক করলেন নারীর ছদ্মবেশে ডাফনির কাছে যাবেন। ডাফনিকে বললেন, তিনি ওনোমাউসের কন্যা। ডাফনি তার বন্ধুত্বের আহবান মেনে নিলেন এবং তার সাথে শিকার করতে লাগলেন। সেই থেকে বন্ধুত্বকে সতর্কতার সাথে গ্রহণ করতে লাগলেন গ্রীকরা, তারা মনে করতেন বন্ধুত্বের ছদ্মবেশেই ভালোবাসা আসে।
যা হোক, নারী ছদ্মরুপী লিউসিপ্পাসকে খুব পছন্দ করতে লাগলেন ডাফনি, সব সময় তার সাথেই থাকতেন।
কিন্তু একদিন ডাফনির অন্য সঙ্গীরাই লিউসিপ্পাসকে হত্যা করেছিলেন, সেটা ছিলো এপোলোরই ষড়যন্ত্রে। সে কথায় যাওয়ার আগে, জেনে নেওয়া ভালো এপোলো কীভাবে ডাফনির প্রেমে পড়েছিলেন।
এপোলো তখন পাইথন সাপকে হত্যা করেছিলেন। এই কারণে তিনি ছিলেন গর্বিত।
ঠিক এই সময়েই তার সাথে দেখা হলো কিউপিডের (গ্রীক- এরোস, প্রেমের দেবতা, দেবী আফ্রোদিতির পুত্র), অহংকার বশেই কিউপিডের তীর ধনুক নিয়ে অবজ্ঞা করলেন এপোলো। কিউপিড এপোলোর এই অবজ্ঞা ভালোভাবে নিতে পারলেন না।
কিউপিড দুই ধরনের তীর ছুড়তেন। সোনালী তীর যার বুকে বিদ্ধ করতেন, তিনি ভালোবাসায় মত্ত হতেন আর যার বুকে সীসার তীর বিদ্ধ করতেন, তিনি ভালোবাসা থেকে শত হাত দূরে থাকতেন। কিউপিড প্যারন্যাসাস পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সোনালী তীর ছুড়লেন এপোলোর হৃদয় লক্ষ্য করে আর সীসার তীর ছুড়লেন ডাফনির হৃদয় লক্ষ্য করে।
সেই থেকে এপোলো ভালোবাসায় মত্ত হয়ে উঠলেন আর ডাফনি ভালোবাসা থেকে দূরে সরে রইলেন। কিউপিডের তীরের এমনই প্রবল ক্ষমতা, জিউসের পুত্রেরও সাধ্য ছিলো না সেই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করা।
ঠিক তখনই তিনি দেখলেন লিউসিপ্পাসের সাথে ডাফনির মেলামেশা। প্রবল ঈর্ষায় এপোলো ডাফনির মনকে উতলা করে দিলেন নদীতে গোসল করার জন্য। ডাফনি তার সাথীদের নিয়ে পশ্চিম আর্কাডিয়ার লাডন নদীতে শরীরের সমস্ত পোশাক খুলে জলকেলি করতে নামলেন।
ডাফনির সব সাথীরাও পোশাক খুললেও, সবাই বুঝতে পারলেন লিউসিপ্পাস নগ্ন হতে রাজী হচ্ছিলেন না। অন্যরা যখন জোর করে তার পোশাক খুলতে গেলেন, লিউসিপ্পাসের সত্যটি বেরিয়ে এলো। রাগে ক্ষোভে তারা তাদের বর্শা দিয়ে হত্যা করলেন লিউসিপ্পাসকে।
এরপর একদিন ডাফনি একা একা শিকার করছিলেন। তখন তার পোশাক ছিলো হাঁটু পর্যন্ত, বাহু ছিলো নগ্ন, চুলগুলো ছিলো আলুথালু, বন্য এবং অবিন্যস্ত।
এপোলো এভাবেই একা পেয়ে গেলেন ডাফনিকে। তিনি ভালোবাসায় জর্জরিত হয়ে ডাফনির পিছনে দৌড়াতে শুরু করলেন। ডাফনিও চমকে উঠে পালাতে লাগলেন। পিছন থেকে এপোলো বলতে লাগলেন, “ভয় পেয়ো না তুমি। আমি এপোলো, ডেলফির অধীশ্বর।
আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি থেমে যাও”। এপোলোর কথা শুনে ডাফনি আরো ভয় পেয়ে গেলেন। আরো দ্রুত দৌড়াতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এপোলো হলে তিনি কিছুতেই রেহাই পাবেন না। তবুও প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরেই দৌড়াতে লাগলেন।
খুব দ্রুতই দৌড়াচ্ছিলেন তিনি, এপোলোরও কষ্ট হচ্ছিলো খুব। তবুও একসময় প্রায়ই ধরে ফেললেন। সেই মুহূর্তে ডাফনি তার বাবা নদীর দেবতা পিনিউসকে স্মরণ করে চিৎকার করতে লাগলেন, “বাঁচাও বাবা, বাঁচাও বাবা”। এই কথা বলার পরেই হঠাৎ করেই কী যেনো হয়ে গেলো। ডাফনি অবসন্ন হয়ে পড়লেন, তার পা দুটি মনে হলো মাটির সাথে দেবে যাচ্ছে।
তার শরীর থেকে পাতা গজাচ্ছে, গাছের বাকল গজাচ্ছে। আর এভাবেই ডাফনি রূপান্তরিত হলেন অদ্ভুত সুন্দর লরেল বৃক্ষে।
এপোলো এবং ডাফনি (শিল্পীঃ এন্টোনিও দেল পোল্লাইওলো,১৪৭০-৮০ সাল)
ডাফনির এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় এপোলো খুব কষ্ট পেলেন, হতাশ হলেন। তিনি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “আমি তোমাকে পেলাম না, ডাফনি! কিন্তু তুমি হবে আমার পবিত্র বৃক্ষ। আমার সমস্ত পূজারী বীররা তোমার পাতা দিয়ে বানানো মুকুট মাথায় পরবে।
আমার সব বিজয়েরই ভাগীদার থাকবে তুমি। যেখানেই গান হবে, গল্প হবে, সেখানেই মানুষ একসাথে উচ্চারণ করবে আমার আর তোমার নাম- এপোলো আর লরেলের নাম”। আর সেই থেকেই লরেল এপোলোর পবিত্র বৃক্ষ।
এপোলো যে শুধু ডাফনিকেই পাননি, এমন নয়। আরো কয়েকজন নারীকে ভালোবাসলেও তাদের তিনি আপন করে পান নি।
এমনকি কেউ কেউতো অত্যন্ত সুদর্শন দেবতা হওয়া সত্ত্বেও এপোলোর ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদেরই একজন হচ্ছেন মারপেসসা।
গ্রীসের ইটোলিয়ানের প্রিন্সেস ছিলেন মারপেসসা। তার বাবার নাম ছিলো ইভেনোস এবং মা ছিলেন এলসিপ্পে। মারপেসসার আরেকটি পরিচয় ছিলো, তিনি ছিলেন যুদ্ধ দেবতা এরেসের নাতনি।
মারপেসসা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী এক যুবতী। ইভেনোস তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি চাইতেন যোগ্য কোনো রাজপুত্রের সাথে যেনো তার মেয়ের বিয়ে হয়।
কিন্তু মারপেসসা কোনো রাজপুত্রের প্রেমে পড়লেন না। তিনি ভালোবাসলেন ইডাসকে।
ইডাস ছিলেন একজন বীর। তিনি ছিলেন জ্যাসনের সঙ্গীদের একজন, যারা স্বর্ণ-লোমের মেষের চামড়া উদ্ধারে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন ক্যালিডোনিয়ার বন্য শূকর অভিযানেও। কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রকৃতপক্ষে ইডাস ছিলেন দেবতা পসাইডনের সন্তান। সে যাই হোক, ইভেনোস তার মেয়ের এই ভালোবাসায় রাজী ছিলেন না। এমনকি ইডাস যখন ইভেনোসের কাছে মারপেসসাকে চাইলেন, ইভেনোস তখন একরকম অপমানই করলেন।
একদিন বাগানে মারপেসসা একাকী বসে ইডাসের কথা বিষণ্ণ মনে ভাবছিলেন। সূর্যের দেবতা এপোলো প্রতিদিনকার মতো তার চ্যারিয়ট চালিয়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন মারপেসসাকে। দেখেই অভিভূত হয়ে পড়লেন। প্রেমের দেবতা এরোসের সোনালী তীর যেন এপোলোর বুকে এসে বিঁধলো।
তিনি ইভেনোসের কাছে এসে মারপেসসাকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। ইভেনোস খুব খুশি হলেন। তিনি এইরকম কাউকেই চাচ্ছিলেন তার অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ের বর হিসেবে। খুশি মনে তিনি এপোলোর প্রস্তাবের কথা মারপেসসাকে বলতে গেলেন। ইভেনোসের কথা শুনে মারপেসসা আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
বলে উঠলেন, “এপোলোর প্রস্তাবের কথা শুনে ইডাস খুব খুশি হবে এই ভেবে যে, সে ভুল কাউকে পছন্দ করেনি!” মারপেসসার উত্তর শুনে ইভেনোস খুব রাগান্বিত হলেন।
বাগানে মারপেসসা একাকী বিষন্নমনে বসে আছেন
এদিকে ইডাস অন্য এক ফন্দি করতে লাগলেন। তিনি গেলেন পসাইডনের কাছে। পসাইডনকে অনুরোধ করলেন তার ডানাযুক্ত চ্যারিয়টটি তাকে কিছু সময়ের জন্য দেওয়ার। পসাইডন ইডাসের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না।
সেই ডানাযুক্ত চ্যারিয়টে চড়ে ইডাস এসে মারপেসসাকে তুলে নিয়ে রওয়ানা দিলেন- নিজের শহর মেসসেনিয়ার উদ্দেশ্যে।
খুব দ্রুতই ইভেনোস বুঝতে পারলেন – ইডাস তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনিও তার চ্যারিয়টে চড়ে সঙ্গে সঙ্গে ইডাসের পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলেন। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিলো ইভেনোস খুব সহজেই ইডাসকে ধরে ফেলবেন। ইডাস বুঝতে পারলেন লাইকোরমাস নদীর তীরে দ্রুত না যাওয়া পর্যন্ত তার রক্ষা নেই।
তিনি আরো দ্রুত চ্যারিয়ট চালাতে লাগলেন। একসময় লাইকোরমাস নদীর তীরে এসে ইডাস তার ডানাযুক্ত চ্যারিয়টটিকে নদীর উপর দিয়ে চালনা করতে লাগলেন। ততক্ষণে ইভেনোস নদীর তীরে এসে গেছেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন এবার আর তার পক্ষে ইডাসকে তাড়া করা সম্ভব নয়। লজ্জায়, অপমানে আর হতাশায় ইভেনোস তার তলোয়ার দিয়ে ঘোড়াগুলোকে হত্যা করলেন, আর তিনি গিয়ে পড়লেন নদীর মধ্যে। একসময় নদীর গভীরে তিনি তলিয়ে গেলেন।
সেই থেকে লাইকোরমাস নদীকে ডাকা হতে লাগলো ইভেনোসের নামে।
ইডাস বিজয়ীর ভাব নিয়ে এবার ধীরে ধীরে যেতে লাগলেন। কিন্তু সহসাই বুঝতে পারলেন ইভেনোসের চেয়েও বড় বিপদ তার পিছনে ধেয়ে আসছেন। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং দেবতা এপোলো। আবার ছুটতে লাগলেন ইডাস, কিন্তু এপোলোর বিরুদ্ধে পেরে উঠা খুব কষ্টকর ব্যাপার।
একসময় এপোলো ধরে ফেললেন ইডাসকে। ঠিক এই সময়েই দেবরাজ জিউস হস্তক্ষেপ করলেন। তিনি এপোলো আর ইডাসের যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে সরাসরি মারপেসসাকেই জিজ্ঞেস করলেন, বর হিসেবে তিনি কাকে চান? মানব ইডাসকে, না কি দেবতা এপোলোকে?
প্রথমে এপোলোই কথা বললেন। আর্তনাদের স্বরে বলে উঠলেন, “মারপেসসা- তুমিই আমার ভালোবাসা- তুমিই আমার আকাঙ্খা! যখন থেকেই আমি তোমাকে দেখেছি- তুমি ছাড়া আর কিছুই জানি না, বুঝি না- বুঝতেও চাই না! আমি দেবতা- অজর- অমর। সাধ্যের বাইরে আমার কিছু নেই।
যাই চাইবে, তাই এনে দিবো তোমার পায়ে- যশ, খ্যাতি, সম্মান, ক্ষমতা আর অনেক অনেক উপঢৌকন! আমরা দুজনে মিলে পৃথিবীতে সর্বক্ষণ বসন্তের পরশ বুলিয়ে দিবো। আমি তোমাকে যা দিতে পারবো, তা কখনো কোনো মরণশীল দিতে পারবেনা। তোমার শরীরের মিষ্ট গন্ধ, তোমার মোহনীয় কেশরাজি, তোমার চন্দ্রমুখ, তোমার সুমিষ্ট কন্ঠ আমাকে উতলা করে দিয়েছে, আমাকে আত্মহারা করে ফেলেছে। তুমি আমার কাছেই আসো- মারপেসসা- তুমিই আমার ভালোবাসা- তুমিই আমার আকাঙ্খা!”
এপোলো মারপেসসাকে প্রেম নিবেদন করছেন (শিল্পী-জন ফ্ল্যাক্সম্যান, ১৭৯০-৯৪ সাল)
এমনভাবে এপোলো তার কথা শেষ করলেন- মুহূর্তেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেলো। এপোলোর শেষ কথাগুলো যেনো প্রতিধ্বনি হয়ে সহস্রবার ফিরে আসতে লাগলো-‘মারপেসসা- তুমিই আমার ভালোবাসা- তুমিই আমার আকাঙ্খা!’ ইডাস যেনো হতবুদ্ধি হয়ে এপোলোর সামনে নতজানু হয়ে রইলেন।
আর মারপেসসার হৃদয় যেনো টানাপোড়নে রিক্ত শূণ্য হয়ে যাচ্ছিলো। তার কানে শুধু বেজেই যাচ্ছিলো এপোলোর শেষ কথাগুলো, অন্যদিকে তার মরণশীল প্রেমিক যেনো নিশ্চল, ফ্যাকাসে হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এপোলোর সামনে!
অবশেষে ইডাস কথা বলতে পারলেন, “দেবতার এই কথার পরে আমি আর কি চাইতে পারি? আর কিইবা দেবার জন্য তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি? তবুও এটি যেহেতু প্রবল ভালোবাসার নারীর ব্যাপার, একেবারে চুপ থাকার চেয়ে কিছু কথা বলাই যেতে পারে। আমি তোমাকে ভালোবাসি- শুধুমাত্র তোমার শরীরে পৃথিবীর সব মিষ্ট গন্ধের ঘ্রাণ পাই বলে নয়, যাতে মনে হয় রক্তবসনা ঘড়া থেকে গ্লাসে শরাব নিয়ে উদ্বেলভাবে পান করছি। কিংবা এই জন্য নয় যে, তোমাকে দেবতা প্রেমিক তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো ঘিরে আছে, অথবা তোমার মোহনীয় কেশরাজির জন্যও নয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি- তোমার সেই চন্দ্রমুখের জন্য নয়, যে চন্দ্রমুখের জন্য আমি কোনো শহরও আক্রমণ করে বসতে পারি, কিংবা যা দেখে আমি এক অদ্ভুত তন্দ্রায় আবিষ্ট হয়ে পড়ি।
আমি তোমাকে ভালোবাসি- তোমার সেই অসাধারণ সুমিষ্ট কন্ঠের জন্য নয়, যেটা শুনে আমি মাতাল হাওয়ায় উদ্বেলিত হয়ে পড়ি, গভীর সাগরের অতলে তলিয়ে যেতে পারি। কারণ আমি জানি –তোমার এই মিষ্ট গন্ধের শরীর, মোহনীয় কেশরাজি, চন্দ্রমুখ কিংবা সুমিষ্ট কন্ঠ- কিছুই আজীবন থাকবে না, এক সময় তা ক্ষয়ে যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে এই নশ্বর পৃথিবীর মতোই। তবুও আমি তোমাকে ভালোবাসি- সেই দিনের জন্য, যেদিন তোমার পাশে তোমার হাত ধরে চুপ করে বসে থেকে নিজেকে আর তোমাকে অনুভব করতে পারবো, বুঝতে পারবো ভালোবাসা মানে শুধু শরীর নয়, ভালোবাসা মানে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য্য নয়, ভালোবাসা মানে দুটি মনের, দুটি আত্মার আত্মিক মিলন!”- এরপর ইডাস চুপ হয়ে রইলেন, রইলেন মাথা নত করে। সময় যেনো তখন নিশ্চল হয়ে গিয়েছিলো- এক মানবী, এক মানব আর এক দেবতার জন্য!
অবশেষে কথা বলতে পারলেন মারপেসসা, মনে হলো অনেক দূরে যেনো হারিয়ে গিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে ফিরে আসছেন বাস্তবতায়। মারপেসসা বলতে লাগলেন, “হে স্বর্গীয় দেবতা, আপনার ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করেছে।
আপনার আকুলতা আমাকে বিচলিত করেছে। আমি জানি আপনি আমাকে সবকিছুই দিতে পারবেন- যশ, খ্যাতি, সম্মান, ক্ষমতা আর অনেক অনেক উপঢৌকন। কিন্তু আমি এমন একজনের ভালোবাসা চাই, যার সাথে আমি জমিতে কাজ করতে পারবো, যে ঘরে আমার কাজ দেখে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকবে, যে আমার সন্তানদের নিয়ে হাসিমুখে খেলা করবে, যে আমার রুপহীন সময়েও আমার হাত ধরে বসে থাকবে, সবচেয়ে বড় কথা- যার সাথেই আমি এই নশ্বর পৃথিবীর ধূলায় মিশে যেতে পারবো”।
এরপর ধীরে কিন্তু দৃপ্ত পায়ে মারপেসসা এগিয়ে গেলেন ইডাসের দিকে। ইডাসের হাত ধরে মায়াময় কন্ঠে বললেন, “তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না তোমার আবাসে? আমি তোমাকেই ভালোবাসি ইডাস- তুমিই আমার ভালোবাসা- তুমিই আমার আকাঙ্খা!”
(অনেক অনেক অনেক দিন আবার লিখতে বসলাম- সেই গ্রীক মিথলজি নিয়েই।
চরম ব্যস্ততার জন্য এতদিন এই সিরিজটি লিখতে না পারার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ভালো থাকুন সবাই। )
এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ
সৃষ্টিতত্ত্বঃ
পর্ব-১: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন
পর্ব-২: টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম
পর্ব-৩: প্রথম টাইটান যুদ্ধ এবং জিউসের উত্থান
পর্ব-৪: মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান
পর্ব-৫: প্রমিথিউসের শাস্তি এবং আইও
পর্ব-৬: আবার যুদ্ধ- জায়ান্ট এবং টাইফোয়িয়াস
পর্ব-৭: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন
দেবতাদের গল্পঃ
পর্ব-৮: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম
পর্ব-৯: এথেনার গল্পকথা-প্রথম পর্ব
পর্ব-১০: এথেনার গল্পকথা- দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব
পর্ব-১১: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ আফ্রোদিতি, হেফাস্টাস এবং অ্যারিসের ত্রিমুখী প্রেমকাহিনি
পর্ব-১২: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ অ্যাডোনিসের সাথে অমর প্রেমকাহিনী
পর্ব-১৩: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
পর্ব-২০: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ লেমনসের নারী এবং অন্যান্য
পর্ব-২১: লেটোঃ এপোলো এবং আর্টেমিসের মায়ের কাহিনী
পর্ব-২২: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ একটাওনের মন্দভাগ্য
পর্ব-২৩: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ এলোয়াডি, আলফিউস ও আরেথুসা এবং ক্যালিষ্টোর কাহিনী
পর্ব-২৪: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ অরিয়ন
পর্ব-২৫: এপোলোর গল্পকথাঃ ডেলফির মন্দির
পর্ব-২৬: এপোলোর গল্পকথাঃ মোর বীণা বাজে.........
পর্ব-২৭: এপোলোর গল্পকথাঃ আমাদের রাজার গাধার কানের সোনালী স্পর্শ
ভালোবাসার গল্পঃ
পর্ব-১৪: পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া
পর্ব-১৫: পিরামাস এবং থিসবি
পর্ব-১৬: হিরো এবং লিয়েন্ডার
পর্ব-১৭: বোসিস এবং ফিলোমোন
পর্ব-১৮: কিউপিড এবং সাইকী- প্রথম পর্ব
পর্ব-১৯: কিউপিড এবং সাইকী- শেষ পর্ব
লেখকঃ
এস এম নিয়াজ মাওলা
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।