১৭ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত লেখায় আমি বলেছিলাম, প্রথম দুই পর্যায়ের চেয়ে তৃতীয় পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা বাড়বে। আমার কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমি কোনো কৃতিত্ব দাবি করছি না। কারণ দেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগই এ আশঙ্কা ব্যক্ত করছিল। চতুর্থ পর্যায়েও ব্যাপারটা আরও বাড়বে।
আমি বলেছি, এখনো বলছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যে খুনোখুনি, পেশিশক্তির প্রয়োগ ও ভোট জালিয়াতি আবার ফিরে এসেছে তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই। প্রাথমিকভাবে সরকার এর সুফল পেয়েছে। মেরে কেটে যেভাবেই হোক এ নির্বাচনে বেশি সংখ্যক চেয়ারম্যান পদ তারা জিতে নিয়েছে। মনে করতেই পারি দ্বিগুণ উৎসাহে তারা চতুর্থবারও তা-ই করবে। চেষ্টা করবে যাতে সব মিলে চেয়ারম্যান তারাই বেশি হয়।
বলি হারি যাই সরকার পক্ষের প্রচারণার। সহিংসতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে তারা। বলছে, যত সহিংসতা তার রানী হচ্ছেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আমি রাজনীতিতে, রাজনীতিতে কেন, যে কোনো ক্ষেত্রে সহিংসতার বিরোধী। রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমি মহাÍা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলার অনুসারী।
বিরোধী দল বিএনপি সন্ত্রাস করলে আমি অবশ্যই তার বিরোধী। কিন্তু এবার উপজেলা নির্বাচনে যে সহিংসতা ফিরে এলো, তা কে আনল? দ্বিতীয় পর্যায়ে শ্রীপুরে যে হত্যাকাণ্ড হলো, তৃতীয় পর্যায়ে যে তিনজন নিহত হলো তার দায় কার?এ কথা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়, আজ উপজেলা পর্যায়ে যে সন্ত্রাসের চাষ হচ্ছে তার দায় সম্পূূর্ণভাবেই সরকারের। আমি এই লেখা লিখছি ১৭ মার্চ। আজকের পত্রিকাগুলো আমার সামনে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরÑ চট্টগ্রামের একটি ও নোয়াখালীর দুটি স্থান থেকে গতকাল সোমবার মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ছয়টি লাশ উদ্ধার হয়েছে।
তাদের অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই লাশগুলো অবশ্য সবই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদন অনুযায়ীÑ নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের তিনজন ছাত্রলীগের ও একজন যুবলীগের এবং হাতিয়ার তিনজন অজ্ঞাত। কিছু দিন ধরেই পত্রপত্রিকায় এ ধরনের গুম-খুনের খবর আসছে। সংসদ সদস্য এখন মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলায় অভিযুক্ত তিনজনের গ্রেফতার ও গুম হওয়া এবং পরবর্তীতে লাশ হয়ে যাওয়া এক হিমশীতল সহিংসতার কথা বলে আমাদের।
নদীর বক্ষে নৌকা দিয়ে যেতে যেতে সাধারণ মানুষ অথবা মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা দেখছে নদীতে ভাসছে লাশ। বাংলাদেশের জন্য এখন ওই কবিতার পঙ্ক্তি সত্য হয়ে গেছে; এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। যা আমার দেশ ছিল, সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা শান্তির নীড় সোনার বাংলা, সেই বাংলাদেশ চাই। মানুষ আছে, তারাও আবার সাধারণ মানুষ নন, তাদের অনেকেই নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী, এখনো সংসদ সদস্য, ক্রসফায়ারের পক্ষে বলেন। গত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দিকে সরকারের পক্ষের কাউকে কাউকে বলতে শুনেছিলাম, দেশে একটা ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
কি নিদারুণ নিষ্ঠুর রসিকতা। ওই তারাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পক্ষে ইনডেমনিটি আইনের বিপক্ষে বলতে গিয়ে বলতেন, একজন ডাকাতকেও বিনা বিচারে হত্যা করার অধিকার নেই। সেই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার আইন একটি বর্বর জঙ্গি আইন। তাহলে এখনকার ক্রসফায়ার কি? ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি মানে কি? এসব বক্তব্য, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কি সহিংস রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক নয়? এর সবই কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন নয়? আমি যে বললাম, কোনো কোনো পত্রিকা লিখছেÑ উপজেলা নির্বাচন আবারও উগ্র সহিংসতা ডেকে আনছে, তা কি ভুল?বর্তমান সহিংসতাকে আমি আরও বেশি করে রাজনৈতিক বলছি এ কারণে যে, ৫ জানুয়ারির আগে থেকে এ বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে আমাদের সামনে আসতে থাকে এবং সেটি ছিল রাজনৈতিক উদ্ভূত, রাজনৈতিক সঞ্জাত। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছিল।
তার সঙ্গে সহিংসতা যুক্ত হয়েছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সহিংসতা যুক্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। কিন্তু এবারের সহিংসতার একটি বিশেষ দিক এই যে, আন্দোলনকারী একটি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা চলছিল। বিষয়টিকে সরকার যথেষ্ট যোগ্যতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। এর ফলে দেশে সহিংসতা বাড়ছে এবং গণতন্ত্র উত্তরোত্তর বিপদে পড়ছে।
এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৫ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এক হলে, এক সুরে কথা বললেই বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নয়নের শিখরে যাওয়া সম্ভব। ’ খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে উনার এই বক্তব্য। এর আগের দিনের পত্রিকায় দেখেছিলাম, তিনি বলেছেন, নির্বাচন বর্জন করাকে তিনি সমর্থনযোগ্য মনে করেন না।
এই এক ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে। বিদেশি রাষ্ট্র, দাতাগোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতাদের পক্ষে-বিপক্ষে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মাহাথির মোহাম্মদকে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মনে করেন অনেকেই। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, এক সময়ের অনুন্নত মালয়েশিয়াকে উন্নত বিশ্বের তালিকায় নেওয়ার জন্য অসামান্য অবদান তার আছে। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের নির্বাচন এবং জাতীয় ঐক্য নিয়ে যে কথা বলেছেন তার বাস্তব প্রতিফলন কি তার নিজের দেশে আছে? ২২ বছর একটানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
তার শাসনের শেষ দিকে তার সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মাহাথির তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠান। তার নামে অশ্লীল অভিযোগ উত্থাপিত হয়। সারা বিশ্বে এমনকি নিজ দেশ মালয়েশিয়াতেও সমালোচিত হন তিনি। এমনিতেই বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের কথা বলে মালয়েশিয়া তার সমর্থক নয়।
সেখানে ভূমিপুত্র আছে। প্রকৃত পক্ষে ভূমির মালিক তারা। ভূমিপুত্র হিসেবে অসাধারণ সব সুযোগ-সুবিধা তাদের। যা অপরাপর সাধারণ নাগরিকদের নেই। তাছাড়া মাহাথির অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের প্রবক্তা নন, তিনি এক ধরনের প্যান ইসলামিজমের প্রচার করেন।
এতদসত্ত্বেও মালয়েশিয়ার গঠনে মাহাথিরকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। নিজে দেশে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করুন আর নাই করুন বাংলাদেশ সম্পর্কে যে জাতীয় ঐক্যের কথা তিনি বলেছেন তা একটি প্রয়োজনীয় কথা। এটাও সত্য যে, বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার দেশ। এ দেশের পক্ষে উন্নয়নের শীর্ষে ওঠা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ কি তা পারবে? মাহাথির যেভাবে বলছেন বাংলাদেশের মানুষ এক হলে, এক সুরে কথা বললে এটা সম্ভব।
সেই এক সুরে কথা বলা কি সম্ভব হবে?আমি সহিংসতা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই সহিংসতা বন্ধ হওয়ার কি কোনো লক্ষণ আছে? এই সহিংসতা বন্ধে আওয়ামী লীগ বিএনপি কি এক সুরে কথা বলতে পারবে? বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া আইনজীবীদের সংবর্ধনায় বলেছেন, তারা অবশ্যই রাজপথে নামবেন। দেশে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে দেশি-বিদেশিরা যাওবা ভাবতে শুরু করেছিলেন তারাও থমকে গেছেন। ঠিক তো, বিএনপি কি এই পাঁচ বছর নিশ্চল-নিশ্চুপ থাকবে। পাঁচ বছর পর যে নির্বাচন হবে তার জন্য অপেক্ষা করবে?সরকারি দলেরই কোনো কোনো নেতাকে বলতে শুনেছি, পাঁচ বছর পরেও এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।
কেয়ারটেকারের কবর হয়ে গেছে বাংলাদেশের মাটিতে। ওটা আর কখনো ফিরবে না। কেয়ারটেকার ফিরবে কি ফিরবে না সেই বিতর্ক আমি করছি না, তবে পাঁচ বছর পর নির্বাচন যদি এই ৫ জানুয়ারির মতো হয় তবে তো তারাই আবার ক্ষমতায় যাবেন। এ কথা আমিই বলছি না, বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারাই। বাংলাদেশে আরেকজন মাহাথিরের জš§ হতে হবে না।
তাকে তো মাহাথিরের মতো একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। না হলে মাহাথিরের কাছে যাবেন কীভাবে?লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য। ই-মেইল : mrmanna.bd@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।