আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরণফাঁদ তুরাগ এক্সপ্রেস

মরণফাঁদ তুরাগ এক্সপ্রেস। ছিনতাইকারীদের টার্গেটে এখন এই ট্রেনের যাত্রীরা। বগিতে ঢুকেই বাতি নিভিয়ে দেয় তারা। ধারালো আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে জিম্মি করে সর্বস্ব লুট করে। এরপর রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে হত্যার উদ্দেশ্যে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়।

ছিনতাইকারীদের হাতে এহেন নৃশংস ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে কমলাপুর টু গাজীপুরগামী তুরাগ এক্সপ্রেসে। গতকাল হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিনতাইকারীদের বর্বরতার বর্ণনা করছিলেন দুই প্রকৌশলী নয়ন ও রিপন। গত রোববার সকালে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছে তুরাগ এক্সপ্রেস থেকে ছিনতাইকারীরা তাদের ফেলে দেয়। পরে স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে নয়নকে রাজধানীর ট্রমা সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়।

এ ঘটনায় গতকাল রেলওয়ে থানায় মামলা হয়েছে। রেলওয়ে থানার ওসি আলাউদ্দিন বলেন, ছিনতাই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গাজীপুরের সন্ত্রাসী তুহিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নয়ন বলেন, ছিনতাইকারীরা ঢুকেছিল যাত্রীবেশে। বগিতে ঢুকেই একজন ট্রেনের লাইট নিভিয়ে দেয়। অন্যরা ধারালো অস্ত্র ধরে জিম্মি করে।

আকস্মিক এ ঘটনায় ভয় পেয়ে যাই। তাদের হাত-পা ধরে বলি- যা আছে সবই নিয়ে যাও। আমাদের ক্ষতি করো না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন আমাকে জাপটে ধরে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করতে থাকে।

এরপর মোটা রশি দিয়ে আমার গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয়। বেঁধে ফেলে হাত-পা। অন্য দুই ছিনতাইকারী প্রকৌশলী মাজারুল ইসলাম রিপনকে টেনে-হিঁচড়ে বগির অন্যপ্রান্তে নিয়ে যায়। তাকেও মারতে তাকে একই কায়দায়। এ সময় আমাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ সব কিছু নিয়ে নেয়।

তাদের অস্ত্রের ভয়ে কিছুই বলতে পারিনি। প্রাণ শুকিয়ে গিয়েছিল। নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে নিয়ে বাড়ির সবার কথা মনে করছিলাম। সবকিছুর বিনিময়ে প্রাণভিক্ষা চাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা কোন কথা শোনেনি।

রিপন বলেন, আমাদের বগিতে এক বৃদ্ধ ছিলেন। তাকেও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। একপর্যায়ে দুই বন্ধু অচেতন হয়ে পড়ি। ছিনতাইকারীরা মনে করেছিল আমরা মরে গেছি। ওদের মধ্য একজন বলে ওঠে, বড় ভাই- শালারা মনে হয় মরে গেছে।

এ কথা বলার পরপরই তারা প্রথমে আমাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর রিপনকে ফেলে দেয়। ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন নয়ন আরও বলেন, আল্লাহর রহমত থাকায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি। রেললাইনের ওপর অচেতন অবস্থায় কত ক্ষণ পড়েছিলাম মনে নেই। জেগে দেখি রেললাইনের পাশে শুয়ে আছি।

চেতনা ফিরে আসার পর অনেককে বলেছি, ভাই আমাদের ছিনতাইকারীরা মেরে ফেলে দিয়েছে। বাসায় একটা খবর দিন। কেউ সাহায্য করেনি। অবশেষে একজন সিএনজি চালক আমার বাসার ঠিকানায় পৌছে দেয়। তার ডান পা, ডান হাতের কনুই, কড়ে আঙুল ভেঙে গেছে।

থেঁতলে গেছে তার ডান কান। ইতিমধ্যে তার শরীরে ছোট দু’টি অপারেশন করা হয়েছে। নয়ন বর্তমানে ট্রমা সেন্টারের অর্থোপেডিক সার্জন প্রফেসর ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে আছেন। তার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী। পিতার নাম মো. আবুল কালাম।

তিনি শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। বর্তমান ঠিকানা ১০৫ শান্তিনগর। অন্যদিকে রিপন মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তার মাথায় মোট ১২টি সেলাই দেয়া হয়েছে। পা, ঘাড় ও ডান হাতের কনুইতে আঘাত পেয়েছেন।

বর্তমানে তিনি তার সবুজবাগ থানার আহমেদবাগের নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। পিতার নাম রফিকুল ইসলাম। রিপনের পিতা বাংলাদেশ রেলওয়ের কমলাপুর ট্রেন পরিচালক। তিনি বলেন, আমার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করেন।

কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস সেই রেলেই আমার প্রাণ যেতে বসেছিল। এদিকে গতকাল কমলাপুরে সরজমিনে ট্রেন থেকে যাত্রী ফেলে দিয়ে হত্যার অভিযোগও পাওয়া গেছে। সমপ্রতি চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে এক চিকিৎসককে হত্যা করলেও ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি রেলওয়ে থানা পুলিশ। গতকাল এমন অভিযোগ করেছেন আরেক প্রকৌশলী রেজাউর রহমান। তিনি অভিযোগ করেন, গত ১৯শে নভেম্বর সন্ধ্যায় আমার পিতা ডা. আজিজুর রহমান গাজীপুর ট্রেনের ছিনতাইকারীদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান।

গাজীপুর থেকে লোকাল ট্রেন তুরাগ এক্সপ্রেস যোগে তিনি ঢাকায় যাচ্ছিলেন। গাজীপুর ট্রেন স্টেশন থেকে দুই কি.মি. দূরে জয়দেবপুরের কাজীবাড়ী এলাকায় ট্রেনের বগিতে ৩ ছিনতাইকারী ডা. আজিজুর রহমানের টাকা, মোবাইল ফোনসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। এরপর ছিনতাইকারীরা তাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। স্থানীয় জনগণ গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৯শে নভেম্বর তার মৃত্যু হয়।

আজিজুর রহমান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (অব.) ডেপুটি ডিরেক্টর এবং বর্তমানে পলমল গার্মেন্টস-এর চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রেজাউর রহমান বলেন, বাবার হত্যার ঘটনা জানিয়েছিলাম রেলওয়ে থানার ওসিকে। তিনি মামলা নেননি। বলেছিলেন, দুষ্কৃতকারী চক্রকে সনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এক সপ্তাহের মধ্য এই চক্রের সদস্যরা ধরা পড়বে।

এরপর এক মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু পুলিশ ছিনতাইকারী চক্রকে সনাক্ত করতে পারেনি। এমনকি পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। ওদিকে ট্রেনের জানালা দিয়ে একের পর এক যাত্রী ফেলে দেয়ার ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যাত্রীরা বলেন, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যের জন্য রেলওয়ে থানা পুলিশ দায়ী। আহত দুই প্রকৌশলী আরও জানান, তারা একসঙ্গে গাজীপুরে একটি বাসায় থাকেন।

প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসেন। প্রতিদিন সকাল আটটায় গাজীপুর কর্মস্থলে যান। রোববার সকালে কমলাপুর থেকে লোকাল ট্রেন তুরাগযোগে কর্মস্থল গাজীপুরে যাচ্ছিলেন। নয়ন গাজীপুরের কাশিমপুর মণ্ডল গ্রুপে এবং রিপন ডিবিএল গ্রুপের মতিন স্পিনিং-এ ইন্টার্নি করছেন। সকালের ট্রেনে যাত্রী ছিল কম।

তাদের কামরাতে দুই বন্ধু ও অপর এক বৃদ্ধসহ মোট তিনজন যাত্রী ছিলেন। অন্ধকার থাকতে তাদের ট্রেন গাজীপুরের উদ্দেশ্যে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যায়। তেজগাঁ এলাকায় পৌঁছলে তিন যুবক ট্রেনের জানালা দিয়ে ওই বগিতে ঢুকে পড়ে। সুত্র ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।