১।
সন্ধ্যের দিকে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করেন কামরুল হাসান। সকালে থেকে চলছে এই কবিতা পাঠের আসর। ফয়েজ আহমেদ তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। বুঝতে পারেন পটুয়া মহা ক্লান্ত।
একটি কাজেই পটুয়ার কখনো ক্লান্তি আসে না, আঁকা আঁকি। আশেপাশে যা কাগজ পাচ্ছেন পটুয়া সকাল থেকে সেখানে নানা আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছেন। এখন কবি রবীন্দ্র গোপের ডায়েরীতে চলছে পটুয়ার আঁকা আঁকি। কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি করে হঠাৎ মনে হল পটুয়া কিছু একটাতে মন বসিয়েছেন। পটুয়ার মাঝে কেমন যেন একটা ঘোর লাগা ভাব।
সারাদিন ধরে এত কবিতা শুনলেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না কি কবিতা শুনলেন। মাথার মধ্যে শুধু মোহাম্মদ রফিকের চারটি লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে -
সব শালাকবি হবে, পিপীলিকা গোঁ ধরেছে উড়বেই, বন থেকে দাঁতাল শুওর, রাজ আসনে বসবেই।
পটুয়া দ্রুত হাতে স্কেচ করে যান। এক টানে লম্বা একটা সাপ এঁকে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এবারে কি একটা দাঁতাল শুয়োর আঁকবেন? নাকি হিংস্র শ্বাপদ? সবচেয়ে ভালো হয় মনে হয় শেয়াল।
একটা বেহায়া কিন্তু হিংস্র মুখ আঁকতে হবে। মাথায় বারেবারে ইয়াহিয়ার মুখটা ভেসে আসে। কিন্তু এই মুখটা ইয়াহিয়া থেকে আলাদা। কিন্তু আসলেই কি অত আলাদা? পটুয়া আপন মনেই বিড়বিড় করেন, বিশ্ববেহায়া, বিশ্ববেহায়া। ঘোরের মাঝে বেশ কিছু সময় কেটে যায়।
গোপের ডায়েরী ছাড়াও তার চারপাশে একগাদা খাতা কাগজ ছড়ানো। একটা খাতার পেছনে আঁকা লাল সবুজ পতাকার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। লাল বৃত্তটা মাপের চেয়ে একটু ছোট মনে হতে থাকে তার। তাকে অবাক করে দিয়ে একসময় লাল বৃত্তটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ঘোর লাগা চোখে পটুয়া দেখতে পান লাল বৃত্তটা বড় হতে হতে আকাশ ছুঁয়েছে।
২।
সেলিনা পারভীন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব। '
শাড়িটা বদলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরা রাজী হলনা।
গায়ে ঘরে পরার সাদাসিধে সাদা শাড়ি-ব্লাউজ। তিনি বরাবরই শীত-কাতুরে। শাড়ীর সাথে গায়ে সাদা স্কার্ফ, পায়ে সাদা জুতা ও মোজা। এমন অদ্ভুত পোশাকেই রওনা দিলেন। দুদিন পরে রায়ের বাজারের মাটির ঢিবিটার পাশে কে যেন খুঁজে পায় সাদা মোজা পরা একটি মেয়ের লাশ, আরও অনেক লাশের সাথে।
চোখ বাঁধা, মুখ ও নাকের কোনও আকৃতি নেই, কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা। মুখ দেখে চেনার উপায় নেই। চেনা গেল সাদা মোজা দেখে।
৩।
মেজর প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করে ফারুককে বলতে বলে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ফারুক শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে চিৎকার করে, জয় বাংলা।
তার সামনে রডে বাধা লাল সবুজ পতাকা। মাস কয়েক আগে এই লাল সবুজ পতাকাটাই একটু একটু করে উঠে গিয়েছিল পিরোজপুর শহীদ মিনারের মাথায়। ওমর ফারুক তার পাশে দাঁড়ানো দলের কর্মীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কি মিয়া কি বুঝলা? এইটা তো সবে শুরু।
মার্চের দুই তারিখে বটতলার সভায় পতাকাটা প্রথম সচক্ষে দেখেন ফারুক। সাথে সাথে সাদা কাগজে এঁকে ফেলেন শিবনারায়ণ এর ডিজাইনটা। পিরোজপুর ফিরে এসেই দিনরাত এক করে শুরু হয় সেই পতাকা বানানো। শহীদ মিনার আসলেই শুরু ছিল। এর পর পুলিশ সুপারের অফিস থেকে শুরু করে সব স্কুল কলেজে পতাকা উঠানো শুরু হয়।
শেষ পতাকা উত্তোলন হয় ফারুকের শরীরে। পতাকা সহই পুরো রডটা ফারুকের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দেখে আশেপাশের কয়েকজন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে যায়। ফারুক কিছুই অনুভব করেন না।
৪।
শিবনারায়ণ কুমিল্লার শাসনগাছায় হন্যে হয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন। টায়ারে আগুন দেয়ার কাজটা শুনতে যত সহজ মনে হয়,আদতে অত সহজ না। আর তা ছাড়া কর্মীরা একেকজন সব আবেগে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। পারলে একেকজন নিজের গায়েই আগুন লাগিয়ে দেয়। ঢাকায় কি হচ্ছে এই বিষয়ে কারো স্পষ্ট ধারণা নেই।
শুধু ভাসা ভাসা নানা খবর আসে কানে। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে ঢাকার চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলেন। ঢাকায় যা হবার হোক। আপাতত এখানে ব্যারিকেড দেয়ার কাজটা করে যেতে হবে। কে জানে সামনে কি অপেক্ষা করছে।
তিনি চেঁচিয়ে কয়েকজনকে দুটি টায়ার আরও ডানে সরাতে বললেন।
সতীশচন্দ্র বিড়বিড় করে বলেন, একটু জল দ্যান। একটু জল।
উত্তরে কিছু গালিগালাজ ভেসে আসে। কিছু উর্দুতে, কিছু ভাঙা বাংলায়।
চিৎকার করে কে যেন বারবার শিবনারায়ণ এর খোঁজ চায়।
সতীশচন্দ্রের কাছে জন্ম মৃত্যু ব্যথা সবই তুচ্ছ মনে হয়। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। শুনেছিলেন মানুষ নাকি জল না খেয়ে বেশ কয়দিন নাকি বেঁচে থাকতে পারে। তাকে ধরে এনেছে একটা পূর্ণ দিনও তো হয়নি।
এক একটি ঘণ্টা তার কাছে এক এক বছরের সমান দীর্ঘ মনে হয়। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে শেষবারের মত চিৎকার করেন, একটু জল দ্যান। একটু জল।
উত্তরে গুলির শব্দ শুনতে পান। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কোন ব্যথার অনুভূতিও জাগেনা শরীরে।
বিড়বিড় করে বলেন, ও শিবু , শিবুরে।
৫।
রাবেয়া খাতুন ড্রেন পরিস্কার করতে করতে চোখের কোন দিয়ে একের পর এক জিপ আর ট্রাক ঢুকতে দেখেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। সেখান থেকে প্রথমে মিলিটারি নামে। তারপর একের পর এক বিভিন্ন বয়েসি মেয়েরা নামে।
কেউ একটু বয়স্ক, কেউ তরুণী, কেউ কিশোরী, কেউ বালিকা। কাউকে নিয়ে যাওয়া হয় হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর তলার রুমে, কাউকে ব্যারাকের ভেতর। এত মেয়ের জায়গা হয়না। বাকিদের দাড় করানো হয় ব্যারাকের বারান্দায়। অনেক হাতেই তখনও স্কুল কলেজের বই খাতা।
কেউ কেউ অঝোরে কাঁদে, কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এরপর শুরু হয় উৎসব! ব্যারাকের বারান্দায় জমা হয় শাড়ি, কামিজ, ছোট্ট ছোট্ট ফ্রক। রাবেয়া খাতুন কোন দিকে না তাকিয়ে পরিস্কার ড্রেন আরও পরিস্কার করতে থাকেন। দিন যায়। অনেক মেয়েকে নগ্ন করে ঝুলিয়ে রাখা হয় ব্যারাকের বারান্দায়।
ওভাবেই খাওয়া, ওভাবেই ঘুম, ওভাবেই বাথরুম। মাঝেমাঝে একেকটা জায়গাটা খালি হয়ে যায়। রক্তাক্ত একটা দেহ ডাস্টবিনে চলে যায়, সেখানে ঝুলতে আসে নতুন আরেকজন। রাবেয়া খাতুন প্রতিদিন মলমুত্র পরিস্কার করে যান। রাবেয়া খাতুন প্রতিদিন রক্তভেজা ড্রেন পরিস্কার করে যান।
ঝুলতে ঝুলতে কিশোরী একটা মেয়ে একদিন ফিসফিস করে একটা জামা চায়। খেতে চায়না, ঘুমাতে চায়না, মুক্তি চায়না। শুধু একটা জামা পরতে চায়। রাবেয়া খাতুন এক মনে শুধু ড্রেন পরিস্কার করে যান।
৬।
জয়নুল আবেদিন এর পাশে শুয়ে ঘুমান পটুয়া। তার স্বপ্নে ঘুরেফিরে আসে ইয়াহিয়া আর বিশ্ববেহায়া। সবচেয়ে বেশী আসে লাল সবুজ একটা পতাকা। ঘুমের মাঝে তিনি হিসেব করেন বৃত্তটা আরেকটু বড় হলে কি ভালো হতো? সবুজটা আরেকটু গাঢ় হলে বুঝি মন্দ হতো না। ঘুমায় শিবুর বাপ সতীশচন্দ্র দুচোখে শিবুর পতাকার স্বপ্ন নিয়ে।
তার পতাকায় লালের ভেতর একটা সোনালি মানচিত্রও থাকে।
মাঝে মাঝে অপ্রাসঙ্গিক সব দুঃস্বপ্নও আসে। ঢাকা স্টেডিয়াম লোকে লোকারণ্য। পাকিস্তানের খেলা চলে। মাঝেমাঝেই পুরো স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়ে।
পটুয়া বিড়বিড় করেন, বেহায়া, বিশ্ববেহায়া। চার বছরের এক ছোট শিশু বাবার কোলে বসে হাততালি দেয়, গালে চাঁদ তারা পতাকা আঁকা। হালকা সবুজ পতাকা। পটুয়া ঘুমের মাঝে মাথা নাড়েন, না না, গাঢ় সবুজ, গাঢ় সবুজ।
সতীশচন্দ্র অসহায় ভাবে ডাকেন, ও শিবু শিবুরে।
ওমর ফারুক তার ফুটো হয়ে যাওয়া খুলিতে হাত দিয়ে খুঁজে ফিরেন লাল সবুজ পতাকা।
ঘুমায় সেলিনা পারভীনের সাদা মোজা, ছিঁড়ে যাওয়া ব্লাউজ। ঘুমের মাঝেই তারা বারেবারে কেঁপে ওঠে। তাদের ঘুমেও হানা দেয় অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন।
- বড়ে ভাই আপকা জার্সি চাহিয়ে
ভাঙা ভাঙা উর্দুতে কাতর আবেদন জানায় বাঙ্গালী ছেলেটি।
- আব শার্ট মুঝে কাহা মিলেঙ্গে
একটু বিরক্ত ও বিব্রত হলেও মুখে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি মাখিয়ে বলে পাকিস্তানী।
- ম্যানেজ কারনা ইয়ার, ম্যানেজ কারনা। পাকিস্তানমে ইয়ে জার্সি বহুত সারে মিলেঙ্গে, বাংলাদেশ মে নেহি।
একজনের জামা অন্যের গায়ে আসে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে।
এত চমৎকার একটি স্বপ্নেও শিউরে উঠে সেলিনা পারভীনের ছোট্ট সাদা মোজা। শিউরে উঠেন সেলিনা পারভীন । বিড়বিড় করে শুধু ডাকেন, সুমন, ও সুমন।
শিউরে উঠে কিশোরীকে খোঁজে কিশোরীর ছোট্ট ফ্রক। রাবেয়া খাতুন দেখেও না দেখার ভান করেন।
কোন দিকে না তাকিয়ে পরিস্কার ড্রেন আরও পরিস্কার করতে থাকেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।