জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ বিরল ঘটনা। সম্প্রতি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওই ‘অসাধ্য’ সাধন করেছে তারা। যদিও প্রথম দিকে ছাত্রলীগের এই আন্দোলন ছাত্রদের পক্ষে ছিল না। ‘শিবির রগ কাটে, ছাত্রলীগ কবজি কাটে, মাথা কাটে’—জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিমের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ওই আন্দোলন শুরু করে। হাজি সেলিমের দখলে থাকা তিব্বত হল উদ্ধার আন্দোলনের মাধ্যমে তারা তাঁকে জব্দ করতে চেয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সাধারণ ছাত্রদের চাপে ওই আন্দোলনকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল আন্দোলনে রূপ দিতে বাধ্য হয়। ওই আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগ দেওয়ার ফলে আন্দোলন আর শুধু ছাত্রলীগ বা ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের আন্দোলনে রূপ নেয়।
হল আন্দোলনের প্রথম থেকেই নানা ষড়যন্ত্র আমরা লক্ষ করেছি। সরকারপন্থী শিক্ষক সংগঠনের কতিপয় নেতা আন্দোলনে তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না অজুহাত তুলে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
ছাত্রলীগের একটি অংশের হাজি সেলিমের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটতে চাওয়ার অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারপন্থী শিক্ষকদের নেতৃত্বাধীন শিক্ষক সমিতি ও সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। শিক্ষক সমিতির অভিযোগ, সদ্যবিদায়ী ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা সৈয়দ আলমকে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদকের সমর্থকেরা লাঞ্ছিত করেছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের অভিযোগ কতিপয় শিক্ষক হাজি সেলিমের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে হল উদ্ধার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে। বিষয়টি তদন্তাধীন।
তবে এ কথা না বললেই নয়, যিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং যারা লাঞ্ছিত করেছে, উভয় পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক। হল উদ্ধারের আন্দোলনে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীরা যে দলেরই কর্মী হোক না কেন, ওদের দলীয় পরিচয় মুখ্য নয়। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের বিচার সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। কিন্তু শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ তুলে শিক্ষক সমিতির হল আন্দোলন স্থগিত ঘোষণাও গ্রহণযোগ্য নয়।
শিক্ষক সমিতি ওই আক্রমণকারীদের বাদ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে পারত। কিন্তু তারা সেই পথে না হেঁটে হঠাৎ করে সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আন্দোলন স্থগিত করেছে। আমরা আশা করি, শিক্ষক সমিতি অতি দ্রুত তাদের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারে জোরালো ভূমিকা রাখবে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার পরিপ্রেক্ষিতে হল আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়েছে। শিক্ষক লাঞ্ছনায় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগের কর্মীদের রক্ষা করা ‘হল উদ্ধার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ দায়িত্ব না হলেও ওই লাঞ্ছনাকারীদের পক্ষাবলম্বন করায় তারা একঘরে হয়ে পড়েছে।
তাই, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে লাঞ্ছনাকারীদের পক্ষ ত্যাগ করতে হবে। ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকও শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগে অভিযুক্ত। তাই এই আন্দোলনের সঙ্গে তাঁকেও যুক্ত করা ঠিক হবে না।
দুই
হল উদ্ধার শিক্ষক ও ছাত্রদের কাজ নয়। তাই, বর্তমান বাস্তবতায় কতিপয় দাবি উত্থাপন করছি।
প্রথমত, মূল ক্যাম্পাসের নিকটবর্তী স্থানে এর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস স্থাপন করতে হবে। রাজউকের ঝিলমিল প্রকল্প এর জন্য উপযুক্ত স্থান। সরকার উদ্যোগী হলেই ওই প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিকল্পিত একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ১২টি হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলে থাকা সম্পত্তি উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এখনই কার্যকর গ্রহণ করতে হবে, যার তিনটি বর্তমানে পুলিশের দখলে আছে। পাশাপাশি পুরান ঢাকা থেকে জজকোর্ট, ডিসি অফিস, পুলিশ সুপারের কার্যালয় অন্যত্র সরিয়ে ওই জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
তৃতীয় বিকল্পটি হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ২০১৫ সালে পরিত্যক্ত ঘোষিত হওয়ার পর ওই জায়গা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়ার বিষয়টি। যদিও ওই জায়গায় বঙ্গবন্ধু জাদুঘর নির্মিত হবে বলে শোনা যাচ্ছে। আমরা ওই জাদুঘর নির্মাণের বিরোধী নই। ওই জায়গায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাস’ স্থাপন করে জাদুঘর তদারকের দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণের প্রস্তাব করছি। একদা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এবং বর্তমানে রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকিতে পরিচালিত হওয়ার বিষয়টিই প্রমাণ করে, এই প্রস্তাব অবাস্তব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন স্কুল-কলেজগুলো নিয়েও সরকার নতুন করে ভাবতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমপরিমাণ জায়গা নিয়ে অবস্থিত প্রগোজ স্কুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করলে আপাতত জায়গার সংকট কিছুটা হলেও দূর হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউল্যাবের মতো ওই প্রগোজ স্কুলকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা অসম্ভব নয়। আধুনিক স্থাপত্য-নকশা প্রণেতার সহায়তায় আইইআরের পাশাপাশি অন্য বিভাগের জন্যও জায়গা বরাদ্দ কঠিন হবে না। ওখানে হল নির্মিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও রয়েছে।
বহু আগেই বর্তমান ক্যাম্পাসে বুয়েটের মতো বহুতল ভবন নির্মাণ করে কিছুটা হলেও সমস্যার সমাধান করা যেত। কিন্তু ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় উন্নীত হলেও কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাবেই সংকট এতটা ঘনীভূত হয়েছে।
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার: শিক্ষক, গবেষক ও রোভার স্কাউট লিডার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
salah.sakender@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।