মল্লিকা নদীর পারে রস কষ সিঙ্গারা বুলবুলি খেলছে। ওর সাথে আরো কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। মাঝে মাঝে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখছে। কোন ট্রলার আসে কিনা। যতদূর চোখ যায় নদীতে কেউ নেই।
প্রবল স্রোত নদীতে। তাই ছোট নৌকাগুলি মূল নদীতে না নেমে রঘুনার চরের অন্যদিকে খালে মাছ ধরছে। ট্রলার বা বড় নৌকা ছাড়া রঘুনার চরে এখন আসার উপায় নেই। শহরে যাওয়ারও উপায় নেই।
মেঘনা নদী এখন বেশ বড়।
বন্যার পানি ডুবিয়ে দিয়েছে দু’পারের অনেকখানি । আগে রঘুনার চর থেকে ওপারে মাটি গাছপালার একটা রেখা বুঝা যেতো। এখন বুঝা যাচ্ছেনা। বন্যার পানি নদীর এপার ওপারের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
মল্লিকার স্কুল বন্ধ।
মা ওকে বসিয়ে রেখেছে নদীর পারে। অনেক সময় সাহায্য নিয়ে শহর থেকে মানুষেরা আসে। সেসব ট্রলার আসলে মাকে খবর দিতে হবে। প্রায় দুপুর হয়ে আসছে। কেউ আসেনি।
গত কয়েক দিন ধরেই মল্লিকা নদীর পারে বসে থাকছে। এখনও কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি।
‘বইনা মায় ডাকে। ’ মল্লিকার বোন শিউলি ডাকছে।
‘কেল্লেইগা ?’
‘খাইতে ডাকে।
’
দু’বোন নাচতে নাচতে বাসায় গেলো। বাসা বলতে এখন তাবুর মতো করে রাখা দু’টি বাঁশের বেড়া। গ্রামের দু’পাশে ছিলো দুইটি জেলে পাড়া। বন্যার পানিতে দুইপাড়া-ই ডুবে গেছে। এখন দুই পাড়ার ত্রিশ চল্লিশটি পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের সবচেয়ে উঁচু জায়গা ছাতিম তলায়।
পানি আরো বাড়লে হয় তাদের গ্রাম ছাড়তে হবে। নইলে মাঁচা বেঁধে থাকতে হবে।
‘মল্লিকা খোড়াটা ল। ’ মাটির থালাটা নিয়ে মা’র দিকে এগিয়ে দিলো মল্লিকা। থালাতে হেচি শাক আর আলু সিদ্ধের একটা ঝোল ওকে খেতে দিলেন মা।
সাথে কয়েকটা টেংরা মাছ। গত তিন-চারদিন ধরে ওদের চাল শেষ। এ ঝোল খেয়েই আছে। প্রবল স্রোতের কারনে মাছ বেশি ধরা যাচ্ছে না। আবার যা ধরা যাচ্ছে তা শহরে নিয়ে বিক্রি করা যাচ্ছে না।
তাই মল্লিকার বাবা চাল কিনতে পারছেনা। অল্প কয়েকটা দিন হলো ভাত খেতে পারছেনা। কিন্তু মল্লিকার মনে হচ্ছে যেনো কত দিন ধরে ওরা ভাত খায় না।
‘মা আইজকা স্কুলে যাই ?’
‘স্কুলতো বন্দ, স্কুলে গিয়া কি করবি?’
‘এমনেই, ইট্টু দেইখ্খা আয়িগা। কবে খুলবো ’
‘নৌকা ছাড়া তো স্কুলে যাওন যাইতো না।
তর বাবায় নৌকা লইয়া গেছে। ’
‘সবিতায় নৌকা লইবো। আমি ওর লগে যামু। ’
‘না যাওন লাগদো না। নদীর পারে গিয়া বইয়া থাক।
’
মল্লিকা কিছু বললো না। মাথা নিচু করে রইলো।
খাবার শেষ করে দু’বোন আবার নদীর পারে যাচ্ছিলো। পথে দেখা হলো সবিতার সাথে। ‘ মল্লিকা চল।
নৌকা লইছি। ’
‘মায় নদীর পারে বইতে কইছে। ’
‘শিউলি কি করে। ওরে নদীর পারে বহায় রাখ। আজকা মঙ্গলবার।
আমগো আপায় আজকা আওনের কথা। চল গিয়া দেহি আইছে নি। ’
বেশ কয়েকদিন ধরে স্কুলে যায়না মল্লিকা । ওর এমনিতেই খুব যেতে ইচ্ছে করছে। সবিতার কথায় তাই রাজি হয়ে গেলো।
যদিও জানে মা শুনলে খুব রাগ করবে। অসুবিধা নেই, যেতে আর আসতে কতন আর লাগবে।
‘শিউলি যা, নদীর পারে গিয়া বইয়া থাক। কোন ট্রলার আইলে মারে দৌড়াইয়া গিয়া খবর দিবি। ’
শিউলি মাথা কাত করে বললো ‘আইচ্ছা।
’ এরপর এক দৌড়ে চলে গেলো নদীর পার। সবার সাথে খেলতে লেগে গেলো। নদীর দিকে তাকানোর তার সময় নেই।
সবিতা নৌকা চালাচ্ছে। সবিতা আর মল্লিকা একই কাসে পড়ে।
কাস ফোর-এ। রঘুনার চর আর নুনেরটেকের মাঝখানে একটা খাল। খালটাও এখন নদীর মতো বড় হয়ে গেছে। তবে স্্েরাত কম। সবিতা সেই অল্প স্রোত কেটে কেটে স্কুলের বাড়ান্দায় নিয়ে নৌকা থামালো।
স্কুলের ভেতরেও হাটু পানি। পানির নিচে ওদের স্কুলের মেঝেটা । সকাল বেলার রোদে চকচক করছে। স্কুলে কোন মানুষ নেই। পুরো স্কুলে পানি আর নদীর দিক থেকে আসা বাতাসের রাজত্ব।
বাড়ান্দার সাথেই ওদের কাসরুম। ওরা পানি ভেঙ্গে কাস রুমে ঢুকেছে। বেঞ্চগুলির কিছুটা অংশ পানির নিচে।
‘ আমগো স্কুলটা অহন মেঘনা নদীর বিতরে। ’
মল্লিকার কথায় হেসে উঠলো সবিতা।
‘হ ঠিক কইছস। আমরা পাতাল পুরির স্কুলে পড়ি। আয় ইট্টু পাতালপুরির কাসে বইয়া থাকি। ’
হাসতে হাসতে দু’জন পানিতে পা ডুবিয়ে কাসে বসলো। পা নাড়তে লাগলো।
‘আরে দেখ দেহি একটা রঙিন মাছ। ’ সবিতা দেখালো।
‘আরে এদিগেও দেহি একটা। ’
‘ঐযে দেখ পুরা একটা ঝাক। আগে কাসের দরজাটা বন্ধ কর।
যাতে যাইতে না পারে। এরপর কোচর পাইত্তা ধরতে অইবো। ’
মল্লিকা দৌড়ে গিয়ে কাসরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ওদের দৌড়াদৌড়িতে মাছের ঝাঁকটা এদিকেই এসেছিলো বের হওয়ার জন্য। কিন্তু বের হতে না পেরে এখন রুমের ভিতরে দৌড়াতে লাগলো।
জামার কোচর ডুবিয়ে বেশ কয়েকটা মাছ ধরে ফেললো মল্লিকা। রাখলো সবিতার কোচরে। আবারো কোচর ডুবালো। এবারো কয়েকটা মাছ উঠে এসেছে। মাছগুলি নিস্তার পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করে শেষে কাসরুমের একেবারে শেষে বেঞ্চের নিচে গিয়ে লুকালো।
সেখানে কোচর ডুবানোর উপায় নেই।
মল্লিকা রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরলো। ততনে সবিতার কোচরে বেশ কিছু মাছ জমে গেছে। মাছগুলির রঙ সোনালী। পিঠের দিকে একটা নীলচে দাগ।
‘কত সুন্দর মাছ দেখছস। ’ মল্লিকা বললো।
‘হ, এমন মাছ অনেক দিন পর দেখলাম। ’
‘চল, নৌকার নিচে রাইখ্খা দেই। নাইলে মইরা যাইতে পারে।
’
নৌকা পাটাতনের উপর অল্প পানি জমেছে। মাছগুলি সেখানে রেখে দিলো ওরা। নৌকার দুলুনীতে পানিটা ডিঙ্গি নৌকার এক কোন থেকে আরেক কোনে যায়। পানির সাথে সাথে মাছগুলিও নৌকার এক কোন থেকে আরেক কোনে ঘুরতে লাগলো।
‘সবিতা চল যাইগা।
শিউলি জানি কি করতাছে। ’
‘আইচ্ছা চল। ’
খালে নৌকা বেয়ে বাড়িতে চললো ওরা। সবিতা ভালো বাইতে পারে। তাই ও-ই বাইছে।
স্রোতের মধ্যে মল্লিকা ঠিকমতো বাইতে পারেনা। বাইতে গেলে স্রোতে নৌকা অন্য দিকে চলে যায়।
গ্রামে নৌকা ভীড়তেই বুঝতে পারলো ট্রলার এসেছে। গ্রামের লোকজন দৌড়ে সব নদীর পারে যাচ্ছে। নৌকা কোনরকমে পারে ভীড়িয়ে ওরাও দৌড় দিলো।
গ্রামের সবাই চলে এসেছে নদীর পারে। পুরুষ নারী শিশু সবাই। অনেকে পেয়েছে একটা পুটলি। পুটলিতে কি দিচ্ছে তা দেখার সময় নেই। মল্লিকার মা পুটলি সংগ্রাহের চেষ্টা করছে।
কিন্তু পারছেনা। সে অন্য অনেকের মতোই পুটলি সংগ্রহের জন্য চিৎকার করছে।
ট্রলার থেকে যিনি দিচ্ছিলেন তিনি বললেন, ‘এখানে আর না। মাঝি ট্রলার ফিরান। অন্যগ্রামে চলেন।
এখানে পঞ্চাশ প্যাকেট দিয়েছি। ’
অনেকেই চিৎকার করতে লাগলো ‘আমরা পাই নাই। আমরা পাই নাই। ’
কিন্তু ট্রলারের লোকজন কারো কথা শুনলো না। তারা ট্রলার ফেরাতে লাগলো।
সাহায্যের প্যাকেটের জন্য অনেকেই নেমে পড়লো নদীতে। তাদের সাথে নদীতে নামলো মল্লিকাও।
‘আপনারা কেউ নদীতে নামবেননা। আর দেয়া হবেনা। ’ ট্রলার থেকে বলতে লাগলো লোকটি।
কিন্তু সাহায্যের আশায় পানিতে নেমে হাটতে লাগলো বেশ কয়েকজন। নদীর নিচে মাটি ক্রমেই ঢালু হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে পানিতে। ডুবে যাচ্ছে শরির। বড়রা গলা পর্যন্ত পানিতে চলে এলো।
মল্লিকার জন্য তখন অনেক পানি। নদীতে ও সাঁতাড় দিয়েছে। গলা পানিতে অন্য সবাই থেমে গেলো। আর কেউ আসছে না। কিন্তু মল্লিকা থামছে না।
ও সাঁতড়ে চেষ্টা করছে ট্রলারটাকে ধরার। ট্রলারে উঠে পড়ার। বিপজ্জনক চেষ্টা। যেকোন সময় ট্রলারের ধাক্কায় ও আহত হয়ে নদীতে পড়ে যেতে পারে।
মল্লিকা থামছে না।
কিন্তু ট্রলারও থামছে না। আস্তে আস্তে ট্রলার এগোচ্ছে মূল নদীর দিকে। মল্লিকা বেশ কিছূদূর এসে পড়েছে। স্রোতের টান শুরু হয়েছে। আর কিছুদূর গেলে সাঁতার জানলেও কোন লাভ হবেনা।
স্রোত তাকে নিয়ে যাবে বহূদূর। একসময় ওর শরির নিস্তেজ হয়ে আসবে। ও আর ভেসে থাকতে পারবে না। নদীতে ডুবে যাবে। দু’একদিন পর ওর লাশ ভেসে উঠবে নদীতে।
এখানে নয়। ওদের গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। অন্য কোন গ্রামে। কিংবা গ্রামে না। নদীতে।
গভীর নদীতে। যেখান থেকে দু’পারের কোন গ্রাম দেখা যায়না।
‘ট্রলার থামাও, ট্রলার থামাও। আরে আরে মেয়েটা করছে কি। মরে যাবে তো।
’
লোকটার উদ্বিগ্ন চিৎকারে ট্রলার থামলো।
ট্রলারের সবাই এসে দাড়ালো ট্রলারের পেছনটাতে। মেয়েটা নদীতে অনেকখানি চলে এসেছে। ‘মা তুমি তো মরে যাবে। এতদূর এসেছো কেনো।
স্রোত তো তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে। চলে যাও। ’ ট্রলারের লোকটি বললো।
‘আমারে একটা পোটলা দেন। ’
লোকটা নিজেই দৌড় দিলো ট্রলারের ভেতরে যেখানে সাহায্যের চাল-ডালের পোটলাগুলি রাখা আছে।
একটি প্যাকেট নিয়ে এসে উপুড় হয়ে পৌছে দিলো মল্লিকার হাতে।
এক হাতে সাহায্যের পোটলাটি নিয়ে আস্তে আস্তে স্রোত কেটে গ্রামের দিকে যেতে থাকলো মল্লিকা। ও তীরে পৌছার পরে ট্রলার ছাড়তে বললেন লোকটি।
মল্লিকার জামাটি বড়ই গাছে। শুকাচ্ছে।
ও মা’র একটা ছেড়া শাড়ী শরিরে জড়িয়ে রেখেছে। ওর একটাই জামা।
মাটির চুলার পাশে বসে আছে মল্লিকা। পাশে ওর বোন শিউলি, ওর বাবা। ওর মা মাটির থালায় সবাইকে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন।
আহা কি সুগন্ধ। ভাতের থালাটা হাতে নিয়ে ভাপ নিলো মল্লিকা। কি সুন্দর ভাতগুলি। যেন থালাটাতে শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে। #
শরীফ উদ্দিন সবুজ, নারায়ণগঞ্জ।
২৪-১২-২০১২।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।