দিনের আলো ধরে রাখতে ঘড়ির সময় পাল্টানোর দরকারই পড়ে না আর। শহরের ভূমি থেকে দশ কিলোমিটার উঁচুতে এক বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে শক্তিশালী বাতি সাজানো। সূর্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করে প্রতি রাতে জলে ওঠে বাতিগুলো। তাতেই আলোকিত হয় পুরো শহর। শহরের মেয়র বাঘা বাঘা বৈজ্ঞানিক নিয়ে এক কমিটি গঠন করেছেন।
তারাই এই বাতিগুলো জ্বালানো বা নিভানোর সময় নির্ধারণ করে শহরের দিন-রাত ঠিক করেন। খুব আরামে আছে শহরের বাসিন্দারা। ছাতা-বর্ষাতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে হয় না। রোদ-বৃষ্টি, শীত-গরমও তেমনি এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এখন মানুষের বশে।
এমনি এক আলোকিত দিনেই সন্তান আদিব হাসানের জন্ম দিল শায়লা।
হাসপাতালে যাবার কথা ভাবাই বিপদজনক। আদিবের জন্ম তাই বাড়িতেই হয়েছে। কষ্ট হয়েছে খুব। পাশের ফ্লাটের ওমেগা দাদী না থাকলে কী যে হতো, বলা যায় না। ওমেগা দাদীর বয়েস নব্বুই।
একসময় হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করতেন। এখন বিশ্রামে। প্রতিদিনই “মৃত্যু মন্ত্রণালয়” থেকে শমনের অপেক্ষায় সময় কাটে তাঁর। দুবার আবেদন করেছিলেন। প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
আপিল করেও কোনো কাজ হয়নি। শহরের গাছপালার জন্যে কার্বন ডাই অক্সাইড ও মানুষের জন্যে অক্সিজেনের সুষম বণ্টন বজায় রাখার অকাট্য কারণ দেখিয়ে হাজারো শারীরিক কষ্টের মাঝেও তাঁর বেঁচে থাকার আদেশটি আজ অবধি বজায় রেখেছে কমিটি। এই শহরে আরও কিছু শিশুর জন্মের পরই হয়তো মরণের অনুমতি দেয়া হবে তাকে। আদিব হাসানের জন্ম এই শহরের জন্যে, শায়লাদের জন্যে বিপদজনক জেনেও সাহায্য করেছেন ওমেগা দাদী।
এভাবে পৃথিবীতে আসারই কোনো কথা ছিল না আদিবের।
মানব-মানবীর ভালোবাসার ফসল হিসেবে শিশুজন্মকে বিরানব্বুই বছর আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিজ্ঞান কমিটি। সেটি পুরোপুরি মেনেই শারীরিক ভালোবাসার আইন প্রণয়ন করে তারা। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। দৈহিক মিলনের আগে বাথটবে “মনসান্টো লাভ” নামে এক সোনালী বোতলের তরল পদার্থের পুরোটাই ঢেলে দিতে হয় পানিতে। সেখানেই শুদ্ধি-স্নান সেরে নিতে হয় মানব মানবীর।
এই শুদ্ধি-স্নানে রমনানন্দ বেড়ে উঠলেও প্রজননক্ষমতাকে সাময়িক ভাবে অচল করে দেয়া হয়।
বিজ্ঞান কমিটির অনুমোদনের পর বাবা-মা হবার জন্যে “মনসান্টো মেটারনিটিই” সরকারের একমাত্র অনুমোদিত স্থান। বাবা-মাকে আলাদা ঘরে ঢুকিয়ে দৈহিক মিলনের পর অত্যাধুনিক জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিংএ তৈরি কিছু ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেয়া হয় মায়ের জরায়ুতে। বাবা আর মাকে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে পরীক্ষা করে তাদের শারীরিক ও জীবনধারণের অভ্যাসগুলোকে পর্যালোচনা করেই একেবারেই আলাদা করেই তাদের জন্যেই তৈরি এই ব্যাকটেরিয়া। তাই এই ট্রান্সজেনিক শিশুর চরিত্রের বাইরে বাইরে বাবা-মায়ের চরিত্রের ছাপ থাকলেও বাইরের পৃথিবীতে কী ভাবে মানিয়ে চলতে হবে, সে ক্ষমতাও দিয়ে দেয়া হয় এই ব্যাকটেরিয়ার জেনেটিক মিলনে।
দশ বছর আগে এভাবেই জন্ম নেয় আদিব হাসানের বড়ো ভাই আজিব হাসান। বাবা-মার চেহারার সাথে মিল রেখে হাস্যোজ্বল চরিত্রের সুঠাম সুন্দর এক বালক আজিব হাসান। কথাবার্তায়, খেলাধুলায় ও পড়াশোনায় বাকী অন্যান্য ছেলেদের মতোই তুখোড়। যে স্কুলে যায় সে, সেখানে পড়াশোনায় সবাই প্রায় সমান নম্বর পেয়ে পাশ করে। স্কুলে সবার চাইতে ভালো না হতে পারার আফসোস থাকলেও ফুটবল খেলায় বারবার ড্র করে বেশ মন খারাপ করে আজিব।
বারবারই বলে, হার বা জিত, যে কোনো একটি না হলে মন খারাপ হয় তার। শায়লা আর হাসান বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাঝে মাঝে শান্ত করে। তবে একবার বেশ বাড়াবাড়ি হওয়ায় “মনসান্টো মাইন্ড” এর মনোবিদদের পরামর্শও নিতে হয়। তিনদিন তাদের তত্বাবধানে থাকে আজিব। ফিরে আসার পর খেলার ফলাফল নিয়ে অশান্ত হতে আর দেখা যায় না তাকে।
তবে বাবার অবর্তমানে মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করার নতুন এক অভ্যাস শুরু হয় তার। হাসানের সাথে এ নিয়ে কোনো কথা বলে ছেলের দুর্ব্যবহার নিজেই সহনীয় করার চেষ্টায় আছে শায়লা।
আজিব হাসানের জন্মের পাঁচ বছর পর একটি কন্যা সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় বারবারই শিশু মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে হাসান আর শায়লা। কিন্তু শহরে কন্যাসন্তান বেশি থাকায় সে আবেদন প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়। হয়তো সে ভাবনাতেই ডুবে থাকায় ভুলে কোনো এক রোমান্টিক সময়ে বাথটবে “মনসান্টো লাভ” এর বদলে হয়তো “মনসান্টো রিল্যাক্স” ঢালে শায়লা।
হাসানের মতো সাবধানী মানুষও কেন টের পেল না, সেটি আজ অবধি অজানা।
আদিবকে নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে দিন কাটায় শায়লা। প্রায় বছর সাতেক আগেও বাড়িতে বাড়িতে রেইড করে একশো তেত্রিশ জন ছেলে মেয়ে খুঁজে পেয়েছিল পুলিশ। এদের কারোরই ‘মনসান্টো মেটারনিটির” সার্টিফিকেট ছিল না। এই অভিযোগে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় “মনসান্টো ল্যাবে”।
হত্যা করার আগে নাকি বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা চালানো হয় তাদের উপর। এ নিয়ে শহরে নানা ধরণের গুজব চালু থাকলেও সরাসরি কথা বলার সাহস কারোরই হয়নি।
জন্মের সময় সাহায্য করলেও আদিব হাসানের জন্মের পর আর কোনো সাহায্য করতে পারলেন না ওমেগা দাদী। হঠাৎই মৃত্যু মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে গেলেন শায়লার কাছ থেকে। বিদায়ের সময় আদিবের গালে সস্নেহে একটি চুমু দেন।
তাতে খিলখিল করে হেসে ওঠে আদিব। এরা ছাড়া বিদায় আরও নেবার কেউ ছিলও না তার। তারপর হাসিমুখে হলেও চোখের কোনে ছোট্ট একটি জলের ফোটা মুছতে মুছতে মৃত্যু মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি।
স্কুল থেকে অনেকক্ষণ হয় ফিরেছে আজিব। এসেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
একবারও দেখা করে নি মায়ের সাথে। বিকেলের হালকা খাবারও খেতে আসেনি। আদিবকে কোলে নিয়ে আদিবের ঘরে টোকা দেয় শায়লা। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। আবার আরেকটু জোরেই টোকা দেয় শায়লা।
ভেতর থেকে বন্য ক্রুদ্ধ আওয়াজ শোনা যায়।
- কী হয়েছে? দরজা ধাক্কাচ্ছ কেন?
- একটু খোল বাবা। স্কুল থেকে ফিরেছিস। একটু খেয়ে নে।
- আমি এখন কিছু খাব না।
যাও! বিরক্ত করো না!
- তারপরও খোল দরজাটা। কথা আছে।
গজর গজর করতে করতে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলে আজিব। চোখ দুটো লাল। মায়ের কোলে আদিবকে দেখেই যেন রক্ত জমে ওঠে চোখে।
সেই সাথে গড়গড় শব্দ গলার স্বরে।
- একে নিয়ে আমার ঘরে ঢুকবে না একেবারেই। আমার ঘৃণা হয়।
- এতো তোর ভাই। এমন কথা বলছিস কেন?
- বাজে কথা বোলো না! এমন চেহারার একজন আমার ভাই হতে পারে না!
- কেন, ওর চেহারায় আবার কী হল।
ও তো তোরই মতো দেখতে।
বলে পরিবেশটা হালকা করার জন্যে হেসে উঠল শায়লা। কিন্তু এতে আজিবের রাগ না কমে বরং বেড়েই যায়।
- কী আজব বকছ। এই কুশ্রী চেহারা জন্তুটা আমার ভাই? তোমার সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছে।
- কেন, এর চেহারার মাঝে খারাপ কী দেখলি?
- ওর গায়ের রঙ আমার মতো ফর্সা নয়। নাকটা কেমন যেন থেবড়ে আছে। হাতের আঙ্গুলগুলো দেখেছ? কী বিশ্রী জানোয়ারের মতো দেখতে। ওকে ভাই হিসেবে মানার মতো নির্লজ্জ আমি নই।
- তারপরও ও তোরই ভাই।
- তুমি কিছুই জানো না। এ আমার ভাই নয়। “মনসান্টো মেটারনিটি বাইরে যাদের জন্ম”, তারা এই শহরের কারো ভাই বোন হতে পারে না। কালই আমাদের স্কুলে এই আইন পড়ানো হয়েছে। এরা বিভিন্ন রকম ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত।
এই শহরকে ধ্বংস করার জন্যে এটি কোনো এক মহল চক্রান্ত করেই এদের পাঠাচ্ছে। বলা হয়েছে, এমন কারো কোনো খোঁজ পেলে আমাদের স্কুলের মনসান্টো প্রতিনিধি জেমস পন্ড কে জানানোর।
- তুই কী জানিয়ে দিয়েছিস?
বলে ভয়ে রীতিমতো চীৎকার করে উঠেন শায়লা।
- যা করার, তাই করেছি। আজ সন্ধ্যাবেলাতেই একে এসে নিয়ে যাবে মনসান্টো র্যাবের দল।
আমরাও বাঁচব এই উপদ্রব থেকে। ওর আর তোমার প্যানপ্যানানি আর ভালো লাগে না!
- এটা কী করলি বাবা। নিজের ভাইকে তুলে দিলি ওদের হাতে?
বলেই আদিবকে আরও শক্ত করে বুকে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠে শায়লা। মনে হল, পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে আর সেই সাথে শহরটির একটি একটি করে ইমারত ভেঙ্গে পড়ছে তার উপর। কিন্তু সে দিকে কোনো নজরই দেয় না আজিব।
ঘরের ভেতর যতোটা ঢুকতে পেরেছে শায়লা, সেখান থেকে ঠেলে বের করে দিয়ে দড়াম করে বন্ধ দরজা করে দেয়।
আদিবকে বুকে নিয়ে নিজের ঘরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে শায়লা। মিথ্যে বলতে শেখে নি আজিব। সুতরাং আজ সন্ধ্যাবেলাতে যে “মনসান্টো র্যাব” আসবেই। তারপর আদিবকে নিয়ে কী করবে এরা, সে কথা গুজব বলা হলেও সত্য।
এই অত্যাচার থেকে বাঁচাতে হবে আদিবকে। পালিয়ে যাবে আদিবকে নিয়ে কোথাও? শহরের ভেতরে সবখানেই মনসান্টোর চর। দশ মিনিটের মাঝেই জেনে যাবে ওরা। শহরের বাইরে বাঁচার কোনো পরিবেশ নেই। ভয়ঙ্কর সব জন্তু জানোয়ার আর গাছপালায় ভরে আছে পৃথিবী।
মাঝে মাঝে শহরেও হানা দেয় প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেঙ্গে। মাটি সেখানে বিষাক্ত, বাতাসে অক্সিজেন নেই। কোথায় পালাবে? ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে আদর করে বিছানায় শুইয়ে দিল শায়লা। মায়ের কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হেসে উঠলো আদিব। বুকের ভেতর নিচ্ছিদ্র যন্ত্রণা নিয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল শায়লা।
একটি চুমু দিল ছেলের গালে। তারপর হাসানের বড়ো শোবার বালিশটা চেপে ধরল ছেলের মুখের উপরে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।