আত্মজীবনীতে জাতীয় প্রেসক্লাবকে দ্বিতীয় বাড়ি বলে উল্লেখ করেছিলেন সাংবাদিক এবিএম মূসা। তিনি বলেছিলেন, ‘হিসাব করে বলতে পারব না এই সেকেন্ড হোমে ৫১ বছরের কতখানি সময় কাটিয়েছি, আর কতখানি থেকেছি নিজের বাড়িতে কিংবা আপন দপ্তরে। ’ আজ সেই প্রেসক্লাবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদায় জানানো হয় প্রবীণ এই সাংবাদিককে। দ্বিতীয় জানাজা শেষে সেখান থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামের বাড়ির পথে।
ফেনীর মিজান ময়দানে বাদ মাগরিব প্রবীণ এই সাংবাদিকের তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
এরপর তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়ি ফুলগাজীর কুতুবপুরে নেওয়া হবে এবং পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবিএম মূসাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। সেখানে বাদ জোহর তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রেসক্লাবে প্রবীণ এই সাংবাদিককে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক কামাল লোহানী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন, ‘প্রথম আলো’র সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ূম, ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।
এবিএম মূসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এবিএম মূসার সঙ্গে আমার পরিচয় ৬২ বছরের।
আমি তাঁকে জেনেছি একজন সত্ ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে। সামরিক শাসনের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তিনি যেভাবে এ দেশের মানুষের অধিকারের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন, তা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ’
এবিএম মূসার একসময়ের সহকর্মী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এবিএম মূসার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি যুগের অবসান হলো। আমাদের সাংবাদিকতা আজ অনেক উন্নত হয়েছে। দক্ষ সাংবাদিকেরা এ পেশায় আসছেন।
এবিএম মূসার বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। এবিএম মূসা ছিলেন সাংবাদিকদের অভিভাবক এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রসৈনিকদের একজন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ’
এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এবিএম মূসা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের একজন সদস্য। সে কারণে জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে তাঁর জানাজা প্রাপ্য ছিল।
তা না হওয়ায় সরকারের দীনতা প্রকাশ পেয়েছে। ’
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বিভিন্ন সময়ে সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দিয়েছেন। এতে সরকার উপকৃত হয়েছে। ’
প্রবীণ এই সাংবাদিক গতকাল বুধবার বেলা সোয়া একটায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মারা যান।
এবিএম মূসা (৮৩) অনেক দিন ধরেই শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। সর্বশেষ ২৯ মার্চ তাঁকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত সোমবার মধ্যরাত থেকে তিনি কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসব্যবস্থায় (লাইফ সাপোর্ট) চিকিত্সাধীন ছিলেন। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গতকাল তাঁর লাইফসাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। এবিএম মূসার ছেলে নাসিম মূসা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে (মূসাকে) নিয়ে যেন কেউ ব্যবসা না করে এই অনুরোধ তিনি করে গেছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জাতীয় প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ক্লাবের আজীবন সদস্য এবিএম মূসা ১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর নানার বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছয় দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ-এ তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। ওই বছর তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদক, ক্রীড়া প্রতিবেদক ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় অবজারভার বন্ধ করে দেওয়া হলে এবিএম মূসা সংবাদ-এ যোগ দেন। অবজারভার চালু হলে ১৯৫৪ সালে আবার ফিরে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠাতেন। স্বাধীনতার পর এবিএম মূসা বিটিভির মহাব্যবস্থাপক ও মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এবিএম মূসা ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের (এসকাপ) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি কিছুদিন দৈনিক যুগান্তর-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসক্লাবের চারবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
একুশে পদকসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই সাংবাদিক।
আরও জানতে পড়ুন
আমার দ্বিতীয় বাড়ির কথা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।