ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১ দশমিক ৬২ লাখ কেজি স্বর্ণ আমদানি করা হতো। গত বছর এপ্রিলে আমদানিতে ১০ শতাংশ কর বৃদ্ধি পাওয়ায় নভেম্বরেই আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৯ হাজার ৩০০ কেজিতে। সে দেশের স্বর্ণের বিপুল চাহিদা মেটাতে চোরাকারবারিরা ঝুঁকে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালানে। গত এক বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আটক হওয়া প্রায় ২০ মণ স্বর্ণের গন্তব্য ছিল ভারত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের বর্তমান চাহিদার জোগান দিতে বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালানের হার বেড়েছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আকাশপথে উড়ে আসা স্বর্ণের চালান আবার বেরিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন স্বর্ণ চোরাচালানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ট্রানজিটে পরিণত হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান আগেও হতো। এখন বৃদ্ধি পেয়েছে শুধু ভারতের চাহিদা মেটাতেই।
কাস্টমস কর্মকর্তারা এও বলছেন, শুধু ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যেই নয়, দেশের স্বর্ণের চাহিদাও মেটানো হচ্ছে চোরাচালানের স্বর্ণ দিয়ে।
দেশীয় বাজারে প্রতি বছর স্বর্ণের চাহিদা ৪ থেকে ৫ টন হলেও গত পাঁচ বছর ১ রতি স্বর্ণও আমদানি করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির দাবি- মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশই দেশীয় উৎসের স্বর্ণ, যা প্রতি বছর হাতবদল হচ্ছে। বাকি স্বর্ণ আসছে ব্যাগেজ রুলে। শুল্ক বিভাগ বলছে, চাহিদার কিছু অংশ বৈধ পথে ব্যাগেজ রুলে আনা হচ্ছে। এর পরিমাণ কিছুতেই বছরে ২৫ মণের বেশি হবে না।
জানা গেছে, গত এক বছরে যে পরিমাণ স্বর্ণ চোরাচালান হয়েছে, তা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কাস্টমস সূত্র জানায়, শুধু এক বছরেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক দুটি বিমানবন্দর শাহজালাল ও শাহ আমানতে ধরা পড়েছে ২০ মণের বেশি স্বর্ণ। এ ছাড়া বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ধার করেছে চোরাচালানের আরও প্রায় ১ মণ স্বর্ণ। এসব স্বর্ণের গন্তব্য ছিল পাশের দেশ ভারত। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, বিমানবন্দরে যে পরিমাণ স্বর্ণ ধরা পড়ছে তা চোরাচালানের ১০ ভাগের ১ ভাগ।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মঈনুল খান বলেন, ভারতে গত এপ্রিলে স্বর্ণের ওপর হঠাৎ শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ৩ থেকে এক লাফে ১০ শতাংশ, যে কারণে বৈধ পথে আমদানি কমে গেছে ব্যাপক হারে। শুধু শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্যই বাঁকাপথে স্বর্ণ সংগ্রহ করছে সেখানকার জুয়েলার্স শিল্প কারখানাগুলো। মঈনুল খান আরও বলেন, স্বর্ণ শুধু কারখানায় ব্যবহারের জন্য চোরাচালান হচ্ছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা ও জঙ্গি অর্থায়নের জন্যও স্বর্ণ ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন ১ কোটি টাকা এক দেশ থেকে অন্য দেশে বহন করা যতটা কঠিন সমপরিমাণ স্বর্ণ বহন ততটা সহজ।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশের উক্ত দুটি বিমানবন্দর থেকে গত বছর এপ্রিলের পর থেকে ধরা পড়া বড় বড় চালানের গন্তব্য ছিল ভারত।
ধরা পড়া বেশ কয়েকজন বাহক পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, শাহজালাল থেকে বের করে সে স্বর্ণ সড়কপথে নেওয়া হয় যশোরের শার্শা এলাকার সীমান্তপথে। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে সড়কপথেই স্বর্ণ যাচ্ছে জয়পুর-রাজস্থান-মুম্বাইসহ অন্য এলাকায় অবস্থিত কারখানায়। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, ভারতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণ ও মণি-মুক্তা দিয়ে তৈরির অলঙ্কার শিল্প কারখানা। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল অবকাঠামো। এসব কারখানায় বছরে চাহিদা কমপক্ষে ১ হাজার টন স্বর্ণ।
তবে কর বেড়ে যাওয়ায় আমদানিও কমে গেছে। এতে শিল্প কারখানাগুলো চরম সংকটে পড়ে। আমদানিপ্রবাহ একেবারে কমে যায়। বৈধভাবে আমদানি করে আনা স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো বেছে নেয় বাঁকাপথ। শুধু কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমদানিকারকরা আমিরাত থেকে চোরাপথে স্বর্ণ আনার জন্য বেছে নেন বাংলাদেশকে।
তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, দুবাই থেকে অনায়াসে স্বর্ণ কিনে তা ঢাকা হয়ে ভারতে নেওয়া যথেষ্ট সহজসাধ্য। ভারতের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) মতে প্রতিদিন ৭০০ কেজি স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে সে দেশে যাচ্ছে। অতীতেও চোরাচালানের মাধ্যমে সে দেশে স্বর্ণ গেলেও গত এক বছরে তা ৩ গুণ বেড়েছে বলে সংস্থা মত প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ হয়ে সে দেশে স্বর্ণ যাচ্ছে বলে তারা জানিয়েছে। ভারতের চেম্বার অব কমার্সের মতে ১ কেজি স্বর্ণ অবৈধ পথে দেশে নিয়ে গেলে ১ লাখ টাকা সাশ্রয় হয় ব্যবসায়ীদের।
তিন মাসে ১৮ বড় চালান : বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের তদন্ত করতে গিয়ে একজন শুল্ক কর্মকর্তা মাত্র তিন মাসে ১৮টি বড় ধরনের স্বর্ণের চালানের তথ্য পান। ওই কর্মকর্তা জানান, দুবাই থেকে আকাশপথে বাংলাদেশের বিমানবন্দর হয়ে চালান ভারতে নেওয়ার জন্য প্রথমেই গড়ে তোলা হয় একটি সিন্ডিকেট। উড়োজাহাজের পাইলট, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, ক্লিনার, নিরাপত্তা বিভাগ, সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী, কাস্টমসসহ বেশকিছু সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত হয় ওই সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমঝোতার পর স্বর্ণের চালান আসে ঢাকায়। ওই কর্মকর্তা জানান, গত বছর মে মাসেই এমন একটি সিন্ডিকেটের সহায়তায় বিমানের একটি এয়ারবাসের টয়লেটে করে স্বর্ণের চালান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়।
এখানে বিমানে চেকআপ করার সময় ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়াররা স্বর্ণের চালানটি একটি ময়লার গাড়িতে করে ৭ নম্বর গেট দিয়ে বের করে নেন। তারপর সেই স্বর্ণ নিয়ে যাওয়া হয় গাবতলীতে। একটি বাসে তিনজন যাত্রী বেনাপোল যান। সেখান থেকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান তারা। সূত্রমতে, এ পদ্ধতিতে দুবাই থেকে প্রায় ১৮টি চালান আনা হয় গত বছর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে।
এর মধ্যে একটি মাত্র বড় চালান (১২৪ কেজি স্বর্ণ) ধরা পড়ে গত জুনে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল উদ্ধার করা সবচেয়ে বড় চালান। বাকি সব চালান ভারতে চলে যায়।
চোরাচালানই উৎস! : শুল্ক বিভাগ থেকে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশে আকাশপথে ১ রতি স্বর্ণও আমদানি করা হয়নি।
তাহলে বাজারের চাহিদা মোতাবেক এ ৫ টন স্বর্ণ আসছে কোন পথে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ আনা হচ্ছে বৈধ পথে। বাকি দুই ভাগ স্বর্ণই আনা হচ্ছে চোরাচালানের মাধ্যমে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. দিলীপ জানান, স্বর্ণ সংগ্রহের দুটো উৎস রয়েছে। একটি হলো বিমানবন্দর দিয়ে আসা যাত্রীদের ব্যাগেজ।
অন্যটি হলো দেশি স্বর্ণের হাতবদল। যেমন পুরনো স্বর্ণ কিনে তা গলিয়ে বাজারে বেচাকেনা করা। তাঁতীবাজারে এমন কমপক্ষে ৫০টি ফ্যাক্টরি রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাগেজ রুলে একজন যাত্রী বিনা শুল্কে ২০০ গ্রাম (প্রায় সাড়ে ১৮ ভরি) স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারেন। প্রতিদিনই এ রুলে যাত্রীরা স্বর্ণ আনছেন।
সে স্বর্ণই তারা বাজারে জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। এটাই স্বর্ণ সংগ্রহের প্রধান উৎস। রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত বছর কিছুতেই ১০০ মণ স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার ব্যাগেজ রুলে আসেনি। তাহলে বাজারের চাহিদার স্বর্ণ কোথা থেকে আনা হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে দিলীপ বলেন, ব্যাগেজ রুল ও হাতবদল ছাড়াও কিছু স্বর্ণ হয়তো প্রবাসীরা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনছেন। সেগুলোও তো মার্কেটেই বিক্রি করা হচ্ছে।
তা তো হিসাবের বাইরে। তবে স্বর্ণ আমদানি নীতি বেশ কঠিন। একে যদি আরও সহজ করা হতো তাহলে চোরাচালানে কেউ এত আগ্রহী হতেন না। পুলিশ, বিমান, শুল্ক বিভাগ, গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, দেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জুয়েলার্স ব্যবসায়ী এর সুবিধাভোগী। তারাই এসব চালানের হোতা।
তবে ভারতের শীর্ষ অলঙ্কার তৈরির কারখানার মালিকরা বাংলাদেশের সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই এসব স্বর্ণ আনছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।