আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্যাটেলাইট ও স্যাটেলাইট কম্যুনিকেশন

স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা নাসা ২০১১ সালের ১০ ই জুন ডেলটা-২ রকেটের সাহায্যে এই কৃত্রিম উপগ্রহটি মহাকাশে উৎক্ষেপন করে। এই অসীম মহাবিশ্বে সূর্য এবং যে সকল মহাজাগতিক বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিন করে তাদের সকলকে নিয়ে যে জগৎ গঠিত তার নাম সৌরজগৎআর যে সকল মহাজাগতিক বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে তাদেরকে বলা হয় গ্রহ( Planet)। পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ আবার কতকগুলো জ্যোতিস্ক গ্রহগুলোকে প্রদক্ষিন করছে এদের নাম Satellite বা উপগ্রহ। চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ প্রায় ৩০ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিন করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের মনে কৌতূহল কি করে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।

এ প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন অভিকর্ষের দরুন চাঁদের উপর পৃথিবীর কেন্দ্রমুখী বল এর কারন। একটু সহজ ভাষায় বলি, অভিকর্ষ বল হল যে বলে পৃথিবী কোন বস্তুকে তার কেন্দ্রের দিকে টানে । যদি এই বলটা না থাকত, তাহলে চাঁদ মহাশূন্যে মিলিয়ে যেত। তাহলে চাঁদ অভিকর্ষ বলের কারনে পৃথিবীতে এসে আপতিত হচ্ছে না কেন ? কারন হল পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের প্রদক্ষিনের দরুন একটা কেন্দ্রবিমুখী বলের ( Centrifugal force) সৃষ্টি হয় যা সেই পৃথিবী কর্তৃক প্রযুক্ত কেন্দ্রমুখী বলের ( Centripetal force) সমান ও বিপরীত হওয়ায় চাঁদ সোজা না গিয়ে পৃথিবীর চারদিকে উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার পথে ঘুরছে। এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষ মহাশূন্যযান তৈরি করেছে যা নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে তাকে আর্টিফিসিয়াল স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ বলে।

এখন প্রশ্ন হল মহাশূন্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হয় কিভাবে ? মহাশূন্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করার জন্য দরকার উৎক্ষেপক মঞ্চ, স্যাটেলাইট ও একটি রকেট। স্যাটেলাইটটি বসানো হয় রকেটের নাকের ডগায় এবং জ্বালানি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসানো হয় রকেটের ভিতর। তবে উপগ্রহগুলোর উৎক্ষেপণের সময়ই পর্যাপ্ত জ্বালানি গ্রহণ করতে হয়। কিছু উপগ্রহ জ্বালানী হিসাবে সৌরশক্তি ব্যবহার করে কারন মহাকাশে রিফুয়েলিংয়ের কোন সুযোগ নেই। পরীক্ষার সাহায্যে দেখা গেছে কোন বস্তুকে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উপরে তুলে পৃথিবী পৃষ্ঠের সমান্তরালে এমনভাবে উৎক্ষেপ করতে হবে যেন বস্তুটি প্রতি সেকেন্ডে ১১.২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে।

তাহলে বস্তুটি আর পৃথিবীতে ফিরে না এসে চাঁদের মত পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকবে। যে ডিম্বাকার পথে বস্তুটি ঘুরতে থাকবে সেই পথকে বলা হয় অরবিট বা কক্ষপথ। কিন্তু কোন বস্তুকে এত উপরে তুলে উৎক্ষেপ করা সম্ভব নয় তাছাড়া বায়ুস্তরের সাথে সংঘর্ষে এত অধিক তাপ উৎপন্ন হবে যে উপগ্রহটি পুড়ে ভষ্মীভূত হবে। তাই একটি রকেটের সাহায্যে বস্তুটিকে এত উপরে তুলে উৎক্ষেপ করা হয় আর এসময় এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে স্পুটুনিক-পিএস রকেটের সাহায্যে স্পুটুনিক-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হন।

এরপর যুক্তরাস্ট্রসহ অন্যান্যরাস্ট্র পাঠাতে সক্ষম হয় । এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও অধিক দেশ থেকে কয়েকহাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপন করা হয়েছে তবে পৃথিবীর মাত্র ১০ টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ও নিজস্ব উৎক্ষেপনকেন্দ্র থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশগুলি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৫৭), যুক্তরাস্ট্র (১৯৫৮), ফ্রান্স(১৯৬৫), জাপান(১৯৭০),চীন(১৯৭০),যুক্তরাজ্য(১৯৭১),ভারত(১৯৮০), ইসরায়েল(১৯৮৮),ইউক্রেইন(১৯৯২) ও ইরান (২০০৯)। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন কক্ষপথ। মহাকাশে স্যাটেলাইটগুলো যে ডিম্বাকার পথে ঘুরতে থাকে সেই পথকে বলা হয় অরবিট বা কক্ষপথ।

ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনুসারে এই অরবিটকে তিনভাগে ভাগ করা যায় । ১. নিম্ন কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১২৪০ মাইল বা ২,০০০ কিলোমিটার ২. মধ্য কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২.০০০ কি.মি থেকে ৩৫,৭৮৬ কি.মি পর্যন্ত। ৩. উচ্চ কক্ষপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৫,৭৮৬ কি.মি. থেকে অসীম। প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট ডিজাইন করা হয় ফর অ্যা স্পেসিফিক টাস্ক। নির্দিষ্ট কাজের ভিত্তিতে স্যাটেলাইটগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।

ওয়েদার স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইট আবহাওয়া পর্যবেক্ষনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়া সংক্রান্ত ফটো ধারন করা হয়। যেমন TIROS, COSMOS এবং GEOS স্যাটেলাইট। কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট: কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট হল সিগন্যাল বা তথ্যের আদান প্রদান হয় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইটও এর অন্তর্ভূক্ত।

এই কম্যুনিকেশনকে স্পেস কম্যুনিকেশনও বলে। এই স্যাটেলাইটে একটি একটি অ্যান্টেনা সিস্টেম, একটি ট্রান্সমিটার তথা প্রেরক যন্ত্র, পাওয়ার সাপ্লাই ও রিসিভার তথা গ্রাহক যন্ত্র থাকে। এই সিস্টেমে আর্থ স্টেশন ট্রান্সমিটার থেকে মডুলেটেড মাইক্রোওয়েভ তথা সিগন্যাল+ উচ্চ কম্পাঙ্কের বহনকারী তরঙ্গ পাঠানো হয় স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট সেই মডুলেটেড ওয়েভকে বিবর্ধিত করে পৃথিবীতে স্থাপিত গ্রাহক স্টেশনে পাঠিয়ে দেয়। জিওস্টেশনারী অরবিটে জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইট।

এখন কোন স্যাটেলাইট যদি ৩৫,৭৮৬ কি.মি. উচ্চতায় স্থাপিত হয় তখন স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর সাথে সমবেগে আবর্তন করে অর্থাৎ স্যাটেলাইটটি এমনভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে যেন পৃথিবীর চারদিকে এক বার ঘুরতে তার ২৪ ঘন্টা সময় লাগে আর যেহেতু পৃথিবীরও নিজের চারদিকে একবার ঘুরতে ২৪ ঘন্টা সময় লাগে তাই পৃথিবীর সাপেক্ষে স্যাটেলাইটটিকে স্থির মনে হবে। তখন এই ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ভূ-স্থির উপগ্রহ আর এই কক্ষপথকে বলা হয় জিও স্টেশনারী অরবিট বা ভূ-স্থির কক্ষপথ। এই কক্ষপথ কম্যুনিকেশনের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী কিন্তু এই কক্ষপথেরও একটি অসুবিধা আছে তা হলো এই কক্ষপথে স্থাপিত একটি কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট সমগ্র পৃথিবীকে কভার করতে পারে না পৃথিবীর বক্রতার কারনে। সমগ্র পৃথিবীকে কভার করতে হলে এই কক্ষপথে তিনটি স্যাটেলাইট স্থাপন করতে হয়। যদি তিনটিই স্যাটেলাইট পরষ্পর থেকে ১২০ ডিগ্রি কোণে জিও স্টেশনারী অরবিটে অবস্থান তাহলে একই সাথে সমগ্র পৃথিবীকে কভার করা সম্ভব।

পরষ্পর ১২০ ডিগ্রি কোণে অবস্থানরত জিওস্টেশনারী অরবিটে তিনটি স্যাটেলাইট। ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইট বিমান ও সমুদ্রগামী জাহাজ ডিটেক্ট ও ন্যাভগেট তথা পথ নির্দেশনা করতে ব্যবহার করা হয়। যেমন GPSNAVSTAR স্যাটেলাইট। আর জিপিএস হল স্যাটেলাইট ভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেম । জিপিএস সিস্টেম এমন একটি নেটওয়ার্ক যা ২৪ টি স্যাটেলাইট নিয়ে গঠিত যা নিরবিচ্ছিন্নভাবে তথ্য ও পৃথিবীর কোন অবস্থানের ছবি পাঠাতে সক্ষম যেকোন সময়ে ও যেকোন আবহাওয়ায়।

আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইট পৃথিবী পৃষ্ঠ নিরীক্ষন করতে ও পৃথিবী পৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশের ছবি তুলতে ব্যবহার করা হয়। মিলিটারী স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইট শুধুমাত্র সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এর মুল কাজ হল- নিউক্লিয়ার মনিটরিং, রাডার ইমেজিং, ফটোগ্রাফি ও শত্রুর গতিবিধ পর্যবেক্ষন করা। সবচেয়ে আশার কথা হল বাংলাদেশ ২০১৩ সালের মধ্যেই মহাকাশে একটি যোগাযোগ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপন করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল ( এসপিআই) কোম্পানিকে পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এসপিআই এর কাজ হল স্যাটেলাইট ডিজাইন ও এটির নির্মাণকাজ তদারকি করা,গ্রাউণ্ড স্টেশন তৈরি, বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণ দেয়া ও কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণে সহায়তা করা। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সফল হলে টেলিযোগাযোগ, টিভি ও বেতার সম্প্রচারের মত কাজগুলো এই উপগ্রহ দিয়ে করা সম্ভব হবে এখন যা করা হচ্ছে অন্যদেশের ভাড়া করা উপগ্রহের মাধ্যমে আর যার জন্য প্রতি বছর আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো উপগ্রহের ভাড়া বাবাদ দিচ্ছে ৪০ লাখ ডলার । নিজস্ব উপগ্রহ কক্ষপথে স্থাপিত হলে অন্যদেশকে ভাড়াতো দিতেই হবে না তাছাড়াও অন্যদেশকে এই উপগ্রহ ভাড়া দিয়ে আয় করা যাবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা !!!  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।