দৈনিক সংবাদ ১৯.১২.২০১২
জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকে সারাদেশে যে তা-ব সৃষ্টি করেছে তা এযাবৎকালে কমই দেখা গেছে। যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে ওরা প্রমাণ করেছে যে সাধারণ মানুষের জানমালের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র দরদ নেই। পুলিশকে ওরা নির্মমভাবে পিটিয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর কিংবা মানুষের সহায়সম্পদ ধ্বংস করা যে কত বড় অন্যায়, সে বোধটুকু তাদের নেই। এসব কাজ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য।
হরতালের সময় জামায়াতের কর্মীরা প্রগতি সরণিতে মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়িও ভাঙচুর করেছে, এর চালক ও নিরাপত্তারক্ষীদের আহত করেছে। এ ঘটনা নজিরবিহীন। অনেক হরতাল হয়েছে, রাজপথে অনেক গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু কোন বিদেশি রাষ্ট্রের গাড়ি কখনো আক্রমণের শিকারে পরিণত করা হয়নি। এটা কূটনীতিকদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি।
এ জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর দায়দায়িত্ব জামায়াতকেই বহন করতে হবে। এ সহিংসতা আসলে ছিল গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার ওপর জামায়াতের পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা। পুলিশ সমাবেশ করার অনুমতি না দেয়ায় হরতাল ডেকেছিল বলে জামায়াতের যুক্তি এখন আর ধোপে টেকে না। কারণ, সমাবেশের অনুমতির বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে ওরা।
তাদের যুক্তি ছিল, সভা-সমাবেশ করা একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশ পেটানো কোন গণতন্ত্র? আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই হরতাল সমর্থক নেতাকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগের অপতৎপরতা শুরু করে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে ওরা মাঠে নামে। যখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে, তখন এ ধরনের সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা দেশে আইনের শাসনের প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ কখনো এ ধরনের তৎপরতা মেনে নেবে না।
এর আগে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থা নেই। থাকলে তারা প্রকাশ্য রাজনীতির পথ ত্যাগ করে কেন গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে গেরিলা কায়দায় পুলিশের ওপর হামলা চালায়? পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে সেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে পুলিশকে নির্মমভাবে পেটানোর যে ভিডিওচিত্র বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় এসব কর্মী বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। জামায়াতে ইসলামী দলটি একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, মা-বোনদের নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে, সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটপাট করেছে। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে।
আজ সমগ্র জাতি যখন ৪১তম বিজয় উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী দলটি আবার স্বরূপে আবির্ভূত হলো। জামায়াত-
শিবিরের হিংস্রতার অতীত হত্যার রাজনীতিতে জামায়াত-শিবির কাঁচা খেলোয়াড় নয় বরং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্র হত্যা ও নির্যাতনে অনেক বেশি পটু। ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কিরিচে কুপিয়ে হত্যার রাজনীতি শুরু করে। ১৯৮৪ সালে শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে, ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে জাতীয় ছাত্রসমাজের সভাপতি আবদুল হামিদকে গুলি করে হত্যা করে শিবিরের ক্যাডাররা। ১৯৯০ সালের পর থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর সংঘর্ষে নিহত হওয়া মোট ১৪ জন ছাত্রের মাঝে নয়জনই ছিলেন ছাত্রশিবিরের শিকার।
চট্টগ্রামে আটজন তরতাজা মানুষকে হত্যা করে মাইক্রোবাসে ফেলে রাখে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা। তাদের হল দখলের রাজনীতির হত্যার মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হয় ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন, নৃশংসভাবে লাশ ফেলে রাখা হয় ম্যানহোলে। পূর্বসুরি রাজাকারদের মতোন একের পর এক হত্যাকা- ছাড়াও শিবিরের কর্মীরা হল দখলেও পিছিয়ে ছিল না। কারমাইকেল কলেজ ছাত্রাবাস দখল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হল দখল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে নারীদের ব্যবহার করে গোপনে জঙ্গিবাদের প্রচারণা, রাজশাহী পলিটেকনিক হল দখল, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মী নির্যাতন, আধিপত্য বিস্তারে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা_ অর্থাৎ কোনভাবেই হল দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে পিছিয়ে নেই ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। তাদের হিংস্রতার বলি হয়েছেন ট্রেনের চালক ও যাত্রীরা।
আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ, সাংবাদিকরা। শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে, বিরুদ্ধমতো চাপা দেয়ার জন্য হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে লেখকদের। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও লেখক হাসান আজিজুল হক এবং মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে দেয়া হয়েছে হত্যার হুমকি। জামায়াতিরা সব সময় হিংস্রতাকেই তাদের মতপ্রকাশ এবং প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। অথচ এ ঘাতক গোষ্ঠীকেই অনেকে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক কর্মকা-ের সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে! জামায়াত এবং সাম্প্রদায়িকতা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান মিত্র।
জামায়াতের সার্বিক সহযোগিতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া তখন বাংলাদেশে এত ভয়াবহ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন সম্ভব হতো না। '৭১-এ ইসলামের দোহাই দিয়ে যাবতীয় গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দিয়েছে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ধর্মের নামে গণহত্যার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি অর্থাৎ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। '৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন এবং সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতা খারিজ করে জামায়াত এবং সমচরিত্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে ধর্মের নামে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
তখন থেকে জামায়াতের যে সহিংস রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি আজও তা অব্যাহত রয়েছে বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে। এ শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে জামায়াত কখনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে, কখনো মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা ও নির্যাতন করে এবং কখনো ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে অথবা বিচ্ছিন্নভাবে হত্যা ও সন্ত্রাস চালায়। ইসলামের নামে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুণ্ঠন হচ্ছে জামায়াতের রাজনীতির প্রধান অভিব্যক্তি। বাংলদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর যাবতীয় নির্যাতন, বৈষম্য, পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত, দেশত্যাগে বাধ্য করা প্রভৃতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে জামায়াতে ইসলামী ও সমচরিত্রের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো। তাদের রাজনৈতিক দর্শন অমুসলিমদের হত্যা ও নির্যাতনে উৎসাহিত করে।
তারা মনে করে এতে পরকালে তাদের বেহেশত এবং ইহকালে বৈষয়িক প্রাপ্তি ঘটবে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ চলাকালে যেসব হিন্দু পরিবার ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিজমা-সম্পদ ফেলে জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনে ভারতে চলে গিয়েছিল রাষ্ট্র সেগুলো শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে আইন তৈরি করে অধিগ্রহণ করেছিল। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলেও পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক বৈষম্যমূলক কালো আইনটি নাম পরিবর্তন করে বহাল রাখা হলো। শত্রুসম্পত্তির পরিবর্তে বলা হলো অর্পিত সম্পত্তি।
কোন হিন্দু পরিবারের এক ভাই ভারতে চলে গেছে, অপর ভাই বাংলাদেশে থেকে গেছে_ এমন বহু পরিবারের ঘরবাড়ি ও জমিজমা সরকার অর্পিত সম্পত্তি গণ্য করে অধিগ্রহণ করেছে। অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি, এসব সম্পত্তির সিংহভাগ বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কিতরা ভোগদখল করলেও আওয়ামী লীগও সুযোগমতো দখল করেছে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণা থেকে আমরা জেনেছি_ এ পর্যন্ত অর্পিত সম্পত্তির নামে হিন্দুদের ২.৬ মিলিয়ন একর জমি এবং ১.২ মিলিয়ন ঘরবাড়ি রাষ্ট্র দখল করেছে। ২০০৬ সালের জরিপ থেকে আমরা জেনেছি, এর ভেতর ৬৭.৩% দখলে নিয়েছে বিএনপি, ১৩.৯% আওয়ামী লীগ, ৯% জামায়াতে ইসলামী, ৭% জাতীয় পার্টি এবং অবশিষ্ট জমি ও ঘরবাড়ি অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের লোকজনের দখলে রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে অর্পিত সম্পত্তির নামে হিন্দুদের জমিজমা, ঘরবাড়ি অধিগ্রহণ বন্ধ করলেও বেআইনিভাবে যাদের সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়েছে তারা আজও তা ফেরত পায়নি।
একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমলে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সময় লক্ষাধিক চাকমা গৃহহীন ও জীবিকাহীন হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য সমতলের বাঙালিদের নিয়ে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ পাকিস্তান আমলেই নেয়া হয়েছিল, যা স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদের হাতে পরিপূর্ণ রূপ পায়। সেটেলার বাঙালি ও সামরিক বাহিনীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে চাকমারা একপর্যায়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সংক্ষুব্ধ পাহাড়িদের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বিএনপি ও জামায়াতের প্রবল প্রতিরোধের কারণে এ চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর ওপর সেটেলার বাঙালি ও সামরিক বাহিনীর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণের এখনও অবসান ঘটেনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর সংবিধান ও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ও জামায়াতে ইসলামীর ধারাবাহিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার। পাকিস্তানের মতো জামায়াত বাংলাদেশে আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে না পারলেও যখনই রাজনৈতিকভাবে তারা কোণঠাসা হয়েছে তখনই নিরীহ আহমদিয়াদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের তল্পিবাহক মৌলবাদী সংগঠনগুলো যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা করেছে, মসজিদে বোমা মেরে মুসলি্লদের হত্যা করেছে, কোরআন ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ আগুনে পুড়িয়েছে, ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে।
এসব হামলা থেকে নারী ও শিশুরাও রেহাই পায়নি। আহমদিয়াদের ওপর সর্বশেষ হামলার ঘটনা ঘটেছে গত ৭ নভেম্বর ২০১২ রংপুরের তারাগঞ্জে। জামায়াতের সন্ত্রাসীরা আহমদিয়াদের নির্মীয়মাণ মসজিদে হামলা করে এটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। স্থানীয় আহমদিয়াদের বাড়িতে অগি্নসংযোগ, লুণ্ঠন, শারীরিক নির্যাতন সবই করে। হামলাকারী জামায়াতের প্রধান মিত্র বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আক্রান্ত আহমদিয়াদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে গিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুসলমানরাও নিরাপদ নয়।
অথচ খালেদা জিয়ার শাসনামলেই খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে জামায়াতিরা বোমা মেরে নামাজরত মুসলি্লদের হত্যা করেছে। খালেদা জিয়ার সরকারই বাংলাদেশে আহমদিয়া প্রকাশনী নিষিদ্ধ করেছিল। বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া জামায়াতের পক্ষে কখনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর ধারাবাহিকভাবে এসব হামলা, হত্যা, নির্যাতন, ভাঙচুর, লুণ্ঠন ও ভিটেছাড়া করা সম্ভব হতো না। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ অধিকাংশ সময় শাসিত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা। এসব দল যখন ক্ষমতায় থাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি পায়।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বপ্রদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বন্ধ হয় বটে কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজনও সংখ্যালঘু নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে। অতি সম্প্রতি কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলার সময় মূল পরিকল্পনা ও হামলাকারী জামায়াত স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একটি অংশকেও ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশে '৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমান ১৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, হাজী মোবারক ও পটুয়াখালীর রুস্তম আলী।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচার চলছে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ও সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা এমএ আলীমের। এছাড়া তদন্তকারী সংস্থা ১১ অক্টোবর পলাতক দুই জামায়াত নেতা মো. আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন শাখায় জমা দিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এই ট্রাইব্যুনালে শুধু ব্যক্তির বিচার হবে, কোন সংগঠনের নয়। যদিও আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে প্রথম দফায় ২৪ নাৎসি নেতার বিচারের পাশাপাশি নাৎসি পার্টির হাই কমান্ডসহ ছয়টি সংগঠনের বিচার হয়েছিল। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে '৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে ধর্মের নামে বৈধতা দিয়েছে।
জামায়াতের দলীয় দর্শন, যা মওদুদীবাদ নামে পরিচিত, ধর্মের নামে এ দলের ঘাতক বাহিনীর সদস্যদের যাবতীয় হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞে উৎসাহিত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি সংগঠনের বিচার না হলে ভবিষ্যতে '৭১-এর মতো গণহত্যার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলদেশ গড়তে হলে ধর্মের নামে হানাহানি, সন্ত্রাস, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে জঙ্গি মৌলবাদ নির্মূল করতে হলে, জাতি, ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা, সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে এবং গণতন্ত্র ও আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হলে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের সমান অধিকার যেমন নিশ্চিত করতে হবে, সংখ্যাগুরু-লঘু নির্বিশেষে সব ধর্মকে সরকার ও রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত থাকতে হবে। এ বোধ যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের না থাকে সে দেশ কখনো বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবে না।
চাই বিষবৃক্ষের নির্মূলকরণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই সহজ সরল ও ধর্মপরায়ণ। আর এসব সহজ সরল মানুষের দুর্বল দিক ধর্মকে পুঁজি করে বিশাল মহীরুহে পরিণত হওয়া ধর্মব্যবসায়ী দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। আর আওয়ামী বিরোধিতার নামে এ জামায়াতে ইসলামী সব সময়ই বিএনপির সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। বিচার নিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার খায়েশ থাকতে পারে, বিরোধীদলের নিজ সঙ্গীকে বাঁচানোর প্রয়াস থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের বিবেক কারও খুঁটিতে বাঁধা নেই।
সবাইকে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের দোসরদের ঠেকিয়ে দিতে পারি, রুখে দিতে পারি ধর্মব্যবসায়ীদের। বিষবৃক্ষ নির্মূল করা না হলে তার বীজ থেকেও নতুন বিষবৃক্ষ গজায়। বাংলাদেশে জামায়াতিদের যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি বলেই দেশ স্বাধীন হওয়ার চার দশকের মধ্যে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগিদার হয়ে রাষ্ট্রের চরিত্রই বদলে দিতে পেরেছে এবং বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানদের মতো আরও বড় সন্ত্রাসী এবং ঘাতকদের জন্ম দিতে পেরেছে। দেশের এক বিরাটসংখ্যক মসজিদ ও মাদ্রাসাকে সন্ত্রাসের ঘাঁটিতে পরিণত করতে পেরেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগা-া অত্যন্ত প্রবল।
বিভিন্ন সাইটে-বস্নগে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি জামায়াত-বিএনপিওয়ালারা যেন সিপাহালার হয়ে বসে আছে। নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটে ঢুকেই পায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির অভ্যর্থনা। এ পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার যত বিলম্বিত হবে ততই মুক্তিযোদ্ধারা কষ্ট পাবেন, মুক্তিযুদ্ধ ততই ফিকে হয়ে আসবে জাতির মানসপটে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত মৃত্যুবরণ করছেন, প্রতিদিনই আমরা হারাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের এক একটা স্মৃতি, অন্যদিকে প্রতিটি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে একেকজন যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গী। কমে আসছে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা, বেড়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধ শক্তি, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রপাগা-া তৈরির স্যাঙাতেরা।
আমরা বিএনপি-আওয়ামী লীগ যে দলেরই সমর্থক হই না কেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমরা যদি নূ্যনতম কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করি তবে আমাদের অবশ্যই জামায়াত আর শিবিরকে বর্জন করতে হবে, উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে এদের বিচারের জন্য, এদের জন্য ঘৃণার শেষ বিন্দুটি বরাদ্দ রাখতেই হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।